ঢাকা ০৮:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাবিতে শিক্ষক রাজনীতির ‘ফাঁদে’ শিক্ষার্থীরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৩৭:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ এপ্রিল ২০১৬
  • ৪০৯ বার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষক রাজনীতির ‘ফাঁদ’ থেকে বের হতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করছেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পেছনে পর্যন্ত লেলিয়ে দিচ্ছেন তারা।
এদিকে আন্দোলনের কারণে বিভাগ গুলোতে দিনের পর দিন ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিগত বছর গুলোতে বেশ কয়েকবার উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনের কারণে শিক্ষাঙ্গনটিতে বর্তমানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
জানা যায়, গত কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষককে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির দাবিতে আন্দোলনে নামে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর ফলে দীর্ঘ দিন বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে ঘটনার রেশ কাটতে না না কাটতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ও একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষাসহ বিভাগের সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা। রোববারও আন্দোলনের কারণে বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন’ এর অভিযোগ এনে তাকে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। সে সময় আন্দোলনের কারণে মাসের পর মাস বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা নেয় নি শিক্ষকরা।
পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোন সতত্যা না পাওয়ায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে তাকে সভাপতি পদে পূনর্বহালের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে গত ২৩ মার্চ অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বিভাগের সভাপতি হিসেবে পুনঃরায় যোগদান করেন।
এরপর গত ২৭ মার্চ বিভাগের কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী আবারো ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে উপাচার্য বরাবার চিঠি দেয়।
পরবর্তীতে গত ৩০ মার্চ বিভাগের শিক্ষকরা অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষাসহ বিভাগের সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বিভাগের সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কালাম, অধ্যাপক আকতার মাহমুদ ও ড. আনিসা নূরী কাঁকনকে একাডেমিক গাফিলতি ও বিভিন্ন অনিয়ম থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ কারণে ক্ষিপ্ত রয়েছেন তিন শিক্ষক।
পরবর্তীতে ওই তিন শিক্ষক তাদের অনুগত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভাগীয় সভাপতির অব্যাহতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
এদিকে অনুসন্ধানে আরো জানা, বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কালাম ২০১১-১২ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ১ম সেমিস্টারে ৫০০৬ কোর্সের ক্লাস নিতেন। তার ওই কোর্সে ১ জন ছাড়া সকল ছাত্র-ছাত্রী সিজিপিএ ৩.৭৫ পায়। যে সকল ছাত্র-ছাত্রী সেমিস্টারে ৫টি কোর্সের মধ্যে ৩ থেকে ৪ টি কোর্সে ফেল করেছে তারাও ওই শিক্ষকের কোর্সে সিজিপিএ ৩.৭৫ পেয়েছেন। যে সকল ছাত্র (ছাত্রলীগ নেতা মামুন খান ও মাহমুদ আল জামান) কখনোই কোন ক্লাস করেনি তাদেরকেও তিনি সিজিপিএ ৩.৭৫ দিয়েছেন। এছাড়া ওই শিক্ষক সেমিস্টার চলাকালে কোন ক্লাস-পরীক্ষা নেন নি। সেমিস্টার পরীক্ষা শেষে তিনি মাত্র একটি প্রেজেন্টেশন (উপস্থাপনা) নেন। তাকেই তিনি ৩ দিয়ে ভাগ করে এ ধরণের গ্রেড প্রদান করেন।
এছাড়াও তিনি ২০১১-১২ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণির তিন শিক্ষার্থীর গবেষণা অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি ওই তিন শিক্ষার্থীর অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ১১ মাস। এরপর ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট ১১ মাস ওই তিন শিক্ষার্থীর অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক থাকা সত্ত্বেও তা সম্পন্ন না করেই তিনি ১ বছরের জন্য কানাডায় সাব আর্টিকেল ছুটিতে যান। এ কারনে ওই ব্যাচের ফলাফল তৈরিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।
অধ্যাপক আবুল কালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত অধ্যাদেশ লংঘন করে দীর্ঘদিন বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অ্যাক্ট অনুযায়ী সভাপতির মেয়াদ তিন বছর। সে হিসেবে ২০০৬ সালে ২য় মেয়াদে সভাপতি হবার পর তা শেষ হওয়ার কথা ২০০৯ সালে। কিন্তু তিনি সভাপতির পদ ছাড়েন ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে।
এদিকে ২০১১-১২ সালে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ হেকেপ এর অধীনে একটি প্রকল্প পায়। এ প্রকল্পের সাব প্রজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। প্রকল্পটির একটি অংশ ছিল বিভাগের জন্য কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, আইপিএস, জরিপ যন্ত্রপাতি ক্রয়। সে সময় টেন্ডারের মাধ্যমে বিভাগের জন্য ৩৭টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, ৩টি ল্যাপটপ কম্পিউটার, ২টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ২টি আইপিএস ক্রয় করা হয়। কিন্তু ক্রয়কৃত এ সকল যন্ত্রপাতি পরবর্তী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ক্রয়কৃত এসব যন্ত্রপাতি গুলো ছিলো অখ্যাত ব্রান্ডের। অথচ বিভাগের জন্মলগ্ন হতে ক্রয়কৃত কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দীর্ঘদিন ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শিক্ষকরা।
এছাড়া অধ্যাপক আখতার মাহমুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় সভাপতির বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনের সময় বিভাগের এক শিক্ষক ক্লাস নিতে চাইলে তিনি টেলিফোনে ওই শিক্ষককে জানান যে, ‘ক্লাস নেয়া যাবে না। এরপর যদি তিনি ক্লাস নিতে উদ্দ্যেগী হন, তবে তিনি বিভাগের অন্য সকল শিক্ষককে অপমান করবেন এবং এর দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।’ এছাড়াও তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের একই ভাবে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহন না করতে বাধ্য করেছেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বিভাগের শিক্ষক ড. আনিসা নূরী কাঁকন বিভাগে পাঠদানে খুবই অনিয়মিত। জানা যায়, ২০১১-১২ সেশনে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ২য় সেমিস্টারে তিনি ৫০১৩ নং কোর্সের কোর্স শিক্ষক ছিলেন। সেমিস্টার ফাইনালের পরীক্ষা শেষে তিনি নম্বরপত্র জমা দেন ৮৪ দিন পরে। অথচ খাতা ও নম্বরপত্র প্রদানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিলো ১৪ দিন। তার এ ধরণের দায়িত্বহীনতার কারণে সে সময় সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়। এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড. আনিসা নূরী কাঁকন সপ্তাহে মাত্র ২ দিন (৪ ঘণ্টা) বিভাগে উপস্থিত থাকেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে (২০১০ সাল থেকে) এ ধরণের দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি করে চলেছেন বলে জানান বিভাগের শিক্ষকরা। এসব বিষয়ে অবহিত করায় তিনি বিভাগের বর্তমান সভাপতির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বলেন, ‘কতিপয় শিক্ষক তাদের স্বার্থ আদায় করার জন্য ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছেন। ছাত্ররা আমাদের সন্তানতুল্য। শিক্ষকরা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কোমলমতি ছাত্রদের লেলিয়ে দিলেন। এর থেকে দুঃভাগ্যজনক আর কি হতে পারে?’
পরীক্ষায় ঢালাওভাবে নম্বর প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবুল কালাম বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের বিষয়। না জেনে কিছু বলা যাবে না।’
ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পেছনে লেলিয়ে দেয়ার বিষয়ে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘এটা ছাত্রদের আন্দোলন। তার সঙ্গে পরবর্তীতে শিক্ষকরা এসেছেন। এটা তো ভিত্তিহীন অভিযোগ।’
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অনিয়মিত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আনিসা নূরী কাঁকন বলেন, ‘গত ছয় মাস ছুটিতে ছিলাম। কয়েকদিন আগে জয়েন্ট করেছি। কিন্তু আমার তো ক্লাস নাই।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কলহের কারণে ছাত্ররা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। দুই পক্ষই যাতে সমযোতার মাধ্যমে ক্লাসে ফিরে যায় এটাই শিক্ষকদের প্রতি আমার প্রত্যাশা।’
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জাবিতে শিক্ষক রাজনীতির ‘ফাঁদে’ শিক্ষার্থীরা

আপডেট টাইম : ০৯:৩৭:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ এপ্রিল ২০১৬

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষক রাজনীতির ‘ফাঁদ’ থেকে বের হতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করছেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পেছনে পর্যন্ত লেলিয়ে দিচ্ছেন তারা।
এদিকে আন্দোলনের কারণে বিভাগ গুলোতে দিনের পর দিন ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিগত বছর গুলোতে বেশ কয়েকবার উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনের কারণে শিক্ষাঙ্গনটিতে বর্তমানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
জানা যায়, গত কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষককে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির দাবিতে আন্দোলনে নামে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর ফলে দীর্ঘ দিন বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে ঘটনার রেশ কাটতে না না কাটতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ও একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষাসহ বিভাগের সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা। রোববারও আন্দোলনের কারণে বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন’ এর অভিযোগ এনে তাকে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। সে সময় আন্দোলনের কারণে মাসের পর মাস বিভাগটিতে কোন ক্লাস-পরীক্ষা নেয় নি শিক্ষকরা।
পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোন সতত্যা না পাওয়ায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে তাকে সভাপতি পদে পূনর্বহালের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে গত ২৩ মার্চ অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বিভাগের সভাপতি হিসেবে পুনঃরায় যোগদান করেন।
এরপর গত ২৭ মার্চ বিভাগের কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী আবারো ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে উপাচার্য বরাবার চিঠি দেয়।
পরবর্তীতে গত ৩০ মার্চ বিভাগের শিক্ষকরা অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে বিভাগের সভাপতির পদে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষাসহ বিভাগের সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বিভাগের সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কালাম, অধ্যাপক আকতার মাহমুদ ও ড. আনিসা নূরী কাঁকনকে একাডেমিক গাফিলতি ও বিভিন্ন অনিয়ম থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ কারণে ক্ষিপ্ত রয়েছেন তিন শিক্ষক।
পরবর্তীতে ওই তিন শিক্ষক তাদের অনুগত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভাগীয় সভাপতির অব্যাহতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
এদিকে অনুসন্ধানে আরো জানা, বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কালাম ২০১১-১২ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ১ম সেমিস্টারে ৫০০৬ কোর্সের ক্লাস নিতেন। তার ওই কোর্সে ১ জন ছাড়া সকল ছাত্র-ছাত্রী সিজিপিএ ৩.৭৫ পায়। যে সকল ছাত্র-ছাত্রী সেমিস্টারে ৫টি কোর্সের মধ্যে ৩ থেকে ৪ টি কোর্সে ফেল করেছে তারাও ওই শিক্ষকের কোর্সে সিজিপিএ ৩.৭৫ পেয়েছেন। যে সকল ছাত্র (ছাত্রলীগ নেতা মামুন খান ও মাহমুদ আল জামান) কখনোই কোন ক্লাস করেনি তাদেরকেও তিনি সিজিপিএ ৩.৭৫ দিয়েছেন। এছাড়া ওই শিক্ষক সেমিস্টার চলাকালে কোন ক্লাস-পরীক্ষা নেন নি। সেমিস্টার পরীক্ষা শেষে তিনি মাত্র একটি প্রেজেন্টেশন (উপস্থাপনা) নেন। তাকেই তিনি ৩ দিয়ে ভাগ করে এ ধরণের গ্রেড প্রদান করেন।
এছাড়াও তিনি ২০১১-১২ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণির তিন শিক্ষার্থীর গবেষণা অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি ওই তিন শিক্ষার্থীর অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ১১ মাস। এরপর ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট ১১ মাস ওই তিন শিক্ষার্থীর অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধায়ক থাকা সত্ত্বেও তা সম্পন্ন না করেই তিনি ১ বছরের জন্য কানাডায় সাব আর্টিকেল ছুটিতে যান। এ কারনে ওই ব্যাচের ফলাফল তৈরিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।
অধ্যাপক আবুল কালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত অধ্যাদেশ লংঘন করে দীর্ঘদিন বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অ্যাক্ট অনুযায়ী সভাপতির মেয়াদ তিন বছর। সে হিসেবে ২০০৬ সালে ২য় মেয়াদে সভাপতি হবার পর তা শেষ হওয়ার কথা ২০০৯ সালে। কিন্তু তিনি সভাপতির পদ ছাড়েন ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে।
এদিকে ২০১১-১২ সালে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ হেকেপ এর অধীনে একটি প্রকল্প পায়। এ প্রকল্পের সাব প্রজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। প্রকল্পটির একটি অংশ ছিল বিভাগের জন্য কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, আইপিএস, জরিপ যন্ত্রপাতি ক্রয়। সে সময় টেন্ডারের মাধ্যমে বিভাগের জন্য ৩৭টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, ৩টি ল্যাপটপ কম্পিউটার, ২টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ২টি আইপিএস ক্রয় করা হয়। কিন্তু ক্রয়কৃত এ সকল যন্ত্রপাতি পরবর্তী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ক্রয়কৃত এসব যন্ত্রপাতি গুলো ছিলো অখ্যাত ব্রান্ডের। অথচ বিভাগের জন্মলগ্ন হতে ক্রয়কৃত কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দীর্ঘদিন ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শিক্ষকরা।
এছাড়া অধ্যাপক আখতার মাহমুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় সভাপতির বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনের সময় বিভাগের এক শিক্ষক ক্লাস নিতে চাইলে তিনি টেলিফোনে ওই শিক্ষককে জানান যে, ‘ক্লাস নেয়া যাবে না। এরপর যদি তিনি ক্লাস নিতে উদ্দ্যেগী হন, তবে তিনি বিভাগের অন্য সকল শিক্ষককে অপমান করবেন এবং এর দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।’ এছাড়াও তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের একই ভাবে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহন না করতে বাধ্য করেছেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বিভাগের শিক্ষক ড. আনিসা নূরী কাঁকন বিভাগে পাঠদানে খুবই অনিয়মিত। জানা যায়, ২০১১-১২ সেশনে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ২য় সেমিস্টারে তিনি ৫০১৩ নং কোর্সের কোর্স শিক্ষক ছিলেন। সেমিস্টার ফাইনালের পরীক্ষা শেষে তিনি নম্বরপত্র জমা দেন ৮৪ দিন পরে। অথচ খাতা ও নম্বরপত্র প্রদানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিলো ১৪ দিন। তার এ ধরণের দায়িত্বহীনতার কারণে সে সময় সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়। এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড. আনিসা নূরী কাঁকন সপ্তাহে মাত্র ২ দিন (৪ ঘণ্টা) বিভাগে উপস্থিত থাকেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে (২০১০ সাল থেকে) এ ধরণের দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি করে চলেছেন বলে জানান বিভাগের শিক্ষকরা। এসব বিষয়ে অবহিত করায় তিনি বিভাগের বর্তমান সভাপতির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিন বলেন, ‘কতিপয় শিক্ষক তাদের স্বার্থ আদায় করার জন্য ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছেন। ছাত্ররা আমাদের সন্তানতুল্য। শিক্ষকরা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কোমলমতি ছাত্রদের লেলিয়ে দিলেন। এর থেকে দুঃভাগ্যজনক আর কি হতে পারে?’
পরীক্ষায় ঢালাওভাবে নম্বর প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবুল কালাম বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের বিষয়। না জেনে কিছু বলা যাবে না।’
ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পেছনে লেলিয়ে দেয়ার বিষয়ে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘এটা ছাত্রদের আন্দোলন। তার সঙ্গে পরবর্তীতে শিক্ষকরা এসেছেন। এটা তো ভিত্তিহীন অভিযোগ।’
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অনিয়মিত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আনিসা নূরী কাঁকন বলেন, ‘গত ছয় মাস ছুটিতে ছিলাম। কয়েকদিন আগে জয়েন্ট করেছি। কিন্তু আমার তো ক্লাস নাই।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কলহের কারণে ছাত্ররা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। দুই পক্ষই যাতে সমযোতার মাধ্যমে ক্লাসে ফিরে যায় এটাই শিক্ষকদের প্রতি আমার প্রত্যাশা।’
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।