ঢাকা ০২:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমলয় পদ্ধিতে হাওরে বোরো রোপণ শুরু

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:১৩:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১
  • ২১৯ বার

রফিকুল ইসলামঃ “কৃষিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিটা নয়া। এতে কম সময়ে ও সাশ্রয়ে ফলন নাকি বেশি। এই মর্মে স্থানীয় কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরণে ভরসা পাইয়া চাষাবাদ করছি দলবদ্ধ উদ্যোগে। আমরা ৪০ জন কৃষান-কৃষানি মিইল্যা ৫০ একর ক্ষেতে ধানের বীজতলার কামও সাইরা লাইছি। এহন ক্ষেত লাগানোর (রোপণ) পালা।”

মুজিববর্ষে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় সমবায়ের ভিত্তিতে গড়া কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদর ব্লকের খুলিয়াপাড়ার কৃষক লাল মোহন দাস (৫৫) এসব কথা বলেন।

দেশের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে চলছে বোরো ধানের মৌসুম। ধুম লেগেছে বীজতলা তৈরির কাজে। কোথাও কোথাও ধানের চারা রোপণের কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ লাভজনক বলে কৃষকের মাঝে সাড়াও পরেছে বেশ। শুধু মিঠামইন উপজেলায় ১৫০ একর জমিতে তিনটি সমলয় চাষাবাদের কার্যক্রমের বীজতলায় চারা তৈরি করা হয়েছে।

মিঠামইন উপজেলার চলতি বোরো মৌসুমে সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে  বীজতলা তৈরি নিয়ে সারাদেশে সাড়া পড়ার কথা উল্লেখ করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে রাজশাহী, নীলফামারী, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার উপজেলাগুলো থেকে কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তারা মোবাইলে এবং মিঠামইনের সমলয়ের ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন। এই সমলয় পদ্ধতি কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণও বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমলয় পদ্ধিতিতে চাষাবাদের কার্যক্রম প্রদর্শনী আকারে দেশের ১২টি জেলার ১২টি উপজেলায় প্রথম বাস্তবায়ন শুরু করার অভিপ্রায় প্রকাশ করে ডিপ্লোমা কৃষিবিদ আনিছুর রহমান বলেন, এর মধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পিতৃভূমি মিঠামইন উপজেলার খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছে সবখানে।

ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়কের জিরো পয়েন্টের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত বাটুয়াখালী বোরো ধানের মাঠে সমলয় চাষাবাদের সভাপতি লাল মোহন দাস। তিনি জানান, প্রকল্পের অধীন চাষিদের চাষাবাদের যাবতীয় খরচ অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ট্রেতে বীজতলা তৈরি, সার-বীজ-কীটনাশকের সুষম ব্যবহার, ধান রোপণযন্ত্রের সাহায্যে রোয়া লাগানো (রোপণ), হারভেস্টার মেশিনে ঝাড়াই-মাড়াইসহ সবকিছু দিছে ও দিবো স্থানীয় কৃষি বিভাগ।

চাষি লাল মোহন দাস জানান, হাইব্রিড টিয়া জাতের ৫০ একর মূল ক্ষেতের লাইগা (জন্য) ৩শ কেজি বীজ ৪ হাজার ৫শ ট্রেতে এবং প্রতিটা ট্রেতে ৬৬.৬৭ গ্রাম অঙ্কুরিত বীজ বপন করা অইছে। ২০-২৫ দিনের চারা ধান রোপণযন্ত্র (রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার) দিয়া কাঁদা মাটিতে লাগানো (রোপণ) অইবো। টিয়া জাতের হাইব্রিড ধান ১৩০-১৩৫ দিনে পাকার কথা। এরপর হারভেস্টার মেশিন দিয়া ধান কাটা অইবো। প্রতি একরে একশ মণ ধান ফলনের আশা করছেন তিনি ও তাঁর সমবায় চাষিরা।

তাছাড়া মিঠামইন সদর ইউনিয়নে ইসলামপুর ব্লকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে খুনখুনির হাওরে ৪৫ একর জমির জন্য ইসলামপুর গ্রামের কৃষক মো. চান মিয়া (৪৫) ২ হাজার ট্রেতে ও ২ হাজার ট্রের পরিমাণ পলিথিনে হাইব্রিড ও উফসী জাতের বীজতলা তৈরিতে ইতোমধ্যে ১৬ একর জমি রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের সাহায্যে চারা রোপণের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছেন বলে জানান।

সমলয় পদ্ধতিতের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে মহিষারকান্দি ব্লকের মহিষারকান্দি গ্রামেরই সমন্বিত খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সভাপতি মো. জিল্লুর রহমানের (৪৫)। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সমলয়’ চাষাবাদকে অধিক সুবিধা ও লাভজনক উল্লেখ করে জানান, সরকারি প্রকল্পে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০ একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে চাষাবাদ কইরা একরপ্রতি ব্রি-৮৮তে ৭০ মণ ও ব্রি-৮৯তে ৮০ মণ ধান ফলন পাইছি ধানটি চিকন বইল্যা। হাইব্রিড জাত ধান মোটা ধরনের। এই জাতটা করলে ১০০ মণ পাইতাম।

কৃষক জিল্লুর রহমান ২০২০-২১ অর্থবছরেও কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে নিজ উদ্যোগে ৫৫ একর জমির মধ্যে হাইব্রিড হিরা জাতের বীজে ১০ একর, ব্রি-৮৮ জাতের বীজে ২০ একর ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে ২৫ একর জমিতে চাষাবাদ করেছিলেন। এতে হাইব্রিড হিরা জাতের বীজে ১০০ মণ, ব্রি-৮৮ জাতের বীজে ৭৫ মণ ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে ৮০ মণ ধান ফলন পেয়েছিলেন বলে সুখ প্রকাশ করেন।

তিনি এবারও সরকারি প্রকল্পের অধীনে ৬০ জন কৃষান-কৃষানি মিলে দশালিয়া মাঠে ৫০ একর জমিতে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতের চাষ করবেন। এর জন্য বীজতলাও সম্পন্ন করে ফেলেছেন, যা ২৫ ডিসেম্বর রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার মেশিনের সাহায্যে রোপণ করা হবে।

কৃষক জিল্লুর রহমান ও তাঁর সমবায় সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হবার কথা জানিয়ে বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে একরপ্রতি খরচ হয় ২৯-৩০ হাজার ট্যাকা। লগে দাওয়াল (কৃষিশ্রমিক) সংকটের ভোগান্তি ত আছেই। আর ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে সেই খরচ অই ১৫-১৭ ট্যাকা; যার খরচ অনেক কম।

সম্প্রতি এসব সমলয়ের বীজতলা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন কিশোরগঞ্জ খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম, অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম আলামিন ও কৃষিবিদ মো. মাহবুবুর রহমান ও জেলা কৃষি প্রকৌশলী মো. মোখলেসুজ্জামান তালুকদার।

এর আগো আরও দুই বছর সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাফিউল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকার কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যার একটি হচ্ছে সমবায়ভিত্তিক সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ভোগান্তি ছাড়া একযোগে কৃষকের বোরো ধান উৎপাদন করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা কম সময়ে ও কম খরচে বেশি ফলন পাবেন। এই পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে চারা তোলা, চারা রোপণ, ধান কাটা-মাড়াইসহ সব প্রক্রিয়া যন্ত্রের সাহায্যে সবসময় সম্পাদন করা হবে।’ নতুন এ লাভজনক সমলয় পদ্ধতিটি সম্পর্কে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে সম্প্রসারণের কাজও জোরালোভাবে চলছে বলে জানান তিনি।

কিশোরগঞ্জ খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে ৭ হাজার ৫শ ৯৯ হেক্টর জমিতে। সম্পন্ন হয়েছে ২২ হেক্টর জমিতে এবং এর মধ্যে সরকারি প্রণোদনার আওতায় ৫৫০ একর, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৪০০ একর। মোট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৬৪ হাজার ৪শ ৮৫ হেক্টর জমি।

জেলা কৃষি প্রকৌশলী মোখলেসুজ্জামান তালুকদার জানান, ১৩টি উপজেলার মধ্যে কৃষি প্রণোদনার আওতায় রয়েছে ৩টি উপজেলা- মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ সদর ও কটিয়াদী এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৮টি উপজেলা- ইটনা, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ সদর, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, কটিয়াদী ও কুলিয়ারচর। আর উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে  সমলয়ে চাষাবাদের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে শুধু মিঠামইন উপজেলায়।

উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম বলেন, মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে সফলভাবে ফসল উৎপাদনের জন্য সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সমলয়ে চাষাবাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগসহ বোরো ধানের উৎপাদন খরচ কমানো, কৃষি শ্রমিকসংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় সম্ভব। সুবিধাভোগীদের সকল ব্যয় প্রকল্প খাত থেকে প্রণোদনা হিসেবে সরকারের কৃষি বিভাগ প্রদান করবে। উদ্বুদ্ধকরণে সমলয় পদ্ধতিতে এ অঞ্চলে বোরো আবাদে কৃষকের আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে। এই ধরনের সমবায়ের মডেল অনুসরণ করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সকল প্রকার প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকের সেতুবন্ধন তৈরিতেও কৃষি বিভাগনিরন্তর কাজ করছে বলে জানান তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বড় ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনেের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি সারাহাওর তথা সরাবাংলায় ছড়িয়ে দেওয়া গেলে কম খরচে ধান উৎপাদন বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রতিবছরই কৃষিখাতে যে দাওয়াল বা কৃষিশ্রমিকের সংকট দেখা দেয়, তা-ও দূর হবে। কৃষিতে কৃষকের এ যেন লাল সবুজের হাসি।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সমলয় পদ্ধিতে হাওরে বোরো রোপণ শুরু

আপডেট টাইম : ০৯:১৩:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

রফিকুল ইসলামঃ “কৃষিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিটা নয়া। এতে কম সময়ে ও সাশ্রয়ে ফলন নাকি বেশি। এই মর্মে স্থানীয় কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরণে ভরসা পাইয়া চাষাবাদ করছি দলবদ্ধ উদ্যোগে। আমরা ৪০ জন কৃষান-কৃষানি মিইল্যা ৫০ একর ক্ষেতে ধানের বীজতলার কামও সাইরা লাইছি। এহন ক্ষেত লাগানোর (রোপণ) পালা।”

মুজিববর্ষে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় সমবায়ের ভিত্তিতে গড়া কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদর ব্লকের খুলিয়াপাড়ার কৃষক লাল মোহন দাস (৫৫) এসব কথা বলেন।

দেশের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে চলছে বোরো ধানের মৌসুম। ধুম লেগেছে বীজতলা তৈরির কাজে। কোথাও কোথাও ধানের চারা রোপণের কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ লাভজনক বলে কৃষকের মাঝে সাড়াও পরেছে বেশ। শুধু মিঠামইন উপজেলায় ১৫০ একর জমিতে তিনটি সমলয় চাষাবাদের কার্যক্রমের বীজতলায় চারা তৈরি করা হয়েছে।

মিঠামইন উপজেলার চলতি বোরো মৌসুমে সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে  বীজতলা তৈরি নিয়ে সারাদেশে সাড়া পড়ার কথা উল্লেখ করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে রাজশাহী, নীলফামারী, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার উপজেলাগুলো থেকে কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তারা মোবাইলে এবং মিঠামইনের সমলয়ের ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন। এই সমলয় পদ্ধতি কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণও বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমলয় পদ্ধিতিতে চাষাবাদের কার্যক্রম প্রদর্শনী আকারে দেশের ১২টি জেলার ১২টি উপজেলায় প্রথম বাস্তবায়ন শুরু করার অভিপ্রায় প্রকাশ করে ডিপ্লোমা কৃষিবিদ আনিছুর রহমান বলেন, এর মধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পিতৃভূমি মিঠামইন উপজেলার খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছে সবখানে।

ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়কের জিরো পয়েন্টের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত বাটুয়াখালী বোরো ধানের মাঠে সমলয় চাষাবাদের সভাপতি লাল মোহন দাস। তিনি জানান, প্রকল্পের অধীন চাষিদের চাষাবাদের যাবতীয় খরচ অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ট্রেতে বীজতলা তৈরি, সার-বীজ-কীটনাশকের সুষম ব্যবহার, ধান রোপণযন্ত্রের সাহায্যে রোয়া লাগানো (রোপণ), হারভেস্টার মেশিনে ঝাড়াই-মাড়াইসহ সবকিছু দিছে ও দিবো স্থানীয় কৃষি বিভাগ।

চাষি লাল মোহন দাস জানান, হাইব্রিড টিয়া জাতের ৫০ একর মূল ক্ষেতের লাইগা (জন্য) ৩শ কেজি বীজ ৪ হাজার ৫শ ট্রেতে এবং প্রতিটা ট্রেতে ৬৬.৬৭ গ্রাম অঙ্কুরিত বীজ বপন করা অইছে। ২০-২৫ দিনের চারা ধান রোপণযন্ত্র (রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার) দিয়া কাঁদা মাটিতে লাগানো (রোপণ) অইবো। টিয়া জাতের হাইব্রিড ধান ১৩০-১৩৫ দিনে পাকার কথা। এরপর হারভেস্টার মেশিন দিয়া ধান কাটা অইবো। প্রতি একরে একশ মণ ধান ফলনের আশা করছেন তিনি ও তাঁর সমবায় চাষিরা।

তাছাড়া মিঠামইন সদর ইউনিয়নে ইসলামপুর ব্লকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে খুনখুনির হাওরে ৪৫ একর জমির জন্য ইসলামপুর গ্রামের কৃষক মো. চান মিয়া (৪৫) ২ হাজার ট্রেতে ও ২ হাজার ট্রের পরিমাণ পলিথিনে হাইব্রিড ও উফসী জাতের বীজতলা তৈরিতে ইতোমধ্যে ১৬ একর জমি রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের সাহায্যে চারা রোপণের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছেন বলে জানান।

সমলয় পদ্ধতিতের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে মহিষারকান্দি ব্লকের মহিষারকান্দি গ্রামেরই সমন্বিত খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সভাপতি মো. জিল্লুর রহমানের (৪৫)। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সমলয়’ চাষাবাদকে অধিক সুবিধা ও লাভজনক উল্লেখ করে জানান, সরকারি প্রকল্পে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০ একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে চাষাবাদ কইরা একরপ্রতি ব্রি-৮৮তে ৭০ মণ ও ব্রি-৮৯তে ৮০ মণ ধান ফলন পাইছি ধানটি চিকন বইল্যা। হাইব্রিড জাত ধান মোটা ধরনের। এই জাতটা করলে ১০০ মণ পাইতাম।

কৃষক জিল্লুর রহমান ২০২০-২১ অর্থবছরেও কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে নিজ উদ্যোগে ৫৫ একর জমির মধ্যে হাইব্রিড হিরা জাতের বীজে ১০ একর, ব্রি-৮৮ জাতের বীজে ২০ একর ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে ২৫ একর জমিতে চাষাবাদ করেছিলেন। এতে হাইব্রিড হিরা জাতের বীজে ১০০ মণ, ব্রি-৮৮ জাতের বীজে ৭৫ মণ ও ব্রি-৮৯ জাতের বীজে ৮০ মণ ধান ফলন পেয়েছিলেন বলে সুখ প্রকাশ করেন।

তিনি এবারও সরকারি প্রকল্পের অধীনে ৬০ জন কৃষান-কৃষানি মিলে দশালিয়া মাঠে ৫০ একর জমিতে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতের চাষ করবেন। এর জন্য বীজতলাও সম্পন্ন করে ফেলেছেন, যা ২৫ ডিসেম্বর রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার মেশিনের সাহায্যে রোপণ করা হবে।

কৃষক জিল্লুর রহমান ও তাঁর সমবায় সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হবার কথা জানিয়ে বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে একরপ্রতি খরচ হয় ২৯-৩০ হাজার ট্যাকা। লগে দাওয়াল (কৃষিশ্রমিক) সংকটের ভোগান্তি ত আছেই। আর ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে সেই খরচ অই ১৫-১৭ ট্যাকা; যার খরচ অনেক কম।

সম্প্রতি এসব সমলয়ের বীজতলা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন কিশোরগঞ্জ খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম, অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম আলামিন ও কৃষিবিদ মো. মাহবুবুর রহমান ও জেলা কৃষি প্রকৌশলী মো. মোখলেসুজ্জামান তালুকদার।

এর আগো আরও দুই বছর সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাফিউল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকার কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যার একটি হচ্ছে সমবায়ভিত্তিক সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ভোগান্তি ছাড়া একযোগে কৃষকের বোরো ধান উৎপাদন করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা কম সময়ে ও কম খরচে বেশি ফলন পাবেন। এই পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে চারা তোলা, চারা রোপণ, ধান কাটা-মাড়াইসহ সব প্রক্রিয়া যন্ত্রের সাহায্যে সবসময় সম্পাদন করা হবে।’ নতুন এ লাভজনক সমলয় পদ্ধতিটি সম্পর্কে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে সম্প্রসারণের কাজও জোরালোভাবে চলছে বলে জানান তিনি।

কিশোরগঞ্জ খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে ৭ হাজার ৫শ ৯৯ হেক্টর জমিতে। সম্পন্ন হয়েছে ২২ হেক্টর জমিতে এবং এর মধ্যে সরকারি প্রণোদনার আওতায় ৫৫০ একর, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৪০০ একর। মোট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৬৪ হাজার ৪শ ৮৫ হেক্টর জমি।

জেলা কৃষি প্রকৌশলী মোখলেসুজ্জামান তালুকদার জানান, ১৩টি উপজেলার মধ্যে কৃষি প্রণোদনার আওতায় রয়েছে ৩টি উপজেলা- মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ সদর ও কটিয়াদী এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৮টি উপজেলা- ইটনা, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ সদর, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, কটিয়াদী ও কুলিয়ারচর। আর উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে  সমলয়ে চাষাবাদের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে শুধু মিঠামইন উপজেলায়।

উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম বলেন, মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে সফলভাবে ফসল উৎপাদনের জন্য সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সমলয়ে চাষাবাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগসহ বোরো ধানের উৎপাদন খরচ কমানো, কৃষি শ্রমিকসংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় সম্ভব। সুবিধাভোগীদের সকল ব্যয় প্রকল্প খাত থেকে প্রণোদনা হিসেবে সরকারের কৃষি বিভাগ প্রদান করবে। উদ্বুদ্ধকরণে সমলয় পদ্ধতিতে এ অঞ্চলে বোরো আবাদে কৃষকের আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে। এই ধরনের সমবায়ের মডেল অনুসরণ করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সকল প্রকার প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকের সেতুবন্ধন তৈরিতেও কৃষি বিভাগনিরন্তর কাজ করছে বলে জানান তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বড় ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনেের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি সারাহাওর তথা সরাবাংলায় ছড়িয়ে দেওয়া গেলে কম খরচে ধান উৎপাদন বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রতিবছরই কৃষিখাতে যে দাওয়াল বা কৃষিশ্রমিকের সংকট দেখা দেয়, তা-ও দূর হবে। কৃষিতে কৃষকের এ যেন লাল সবুজের হাসি।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।