হাওর বার্তা ডেস্কঃ সংবিধানে নির্বাচন কমিশন আইনের কথা বলা আছে। কিন্তু গত ৫০ বছরেও সেই আইন হয়নি। আইন না হওয়ায় প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠনে জটিলতা দেখা দেয়। জটিলতা এড়াতে গত দুইবার সার্চ কমিটির ব্যবস্থা হলেও বিতর্ক থামেনি।
এরই মধ্যে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ শেষ হচ্ছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। তার আগেই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নতুন কমিশনের ওপরই থাকবে। সেজন্য বর্তমানে এ ইস্যুতে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।
নির্বাচন কমিশন আইন গঠনের সুবিধার্থে গত ১৮ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ আইন, ২০২১’ শীর্ষক খসড়া জমা দিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
কিন্তু খসড়া এখনই আমলে নিতে চান না আইনমন্ত্রী। তার দাবি, ‘জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে এ আইন প্রণয়ন করা ঠিক হবে না।’ তবে মন্ত্রীর এ দাবির সঙ্গে একমত নয় সুজন। সংস্থাটি বলছে, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা নেই।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদকে পাশ কাটিয়ে এ আইন প্রণয়ন করা ঠিক হবে না। আগামী জানুয়ারিতে সংসদের পরবর্তী অধিবেশন বসবে, ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হবে। এই স্বল্প সময়ে ইসি গঠনের আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়।’
তবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য বিপরীতমুখী বলে দাবি করেছেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলছেন সময় নেই, এতে সংসদকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। সংসদকে যুক্ত করার নাকি সময় নেই। আমরা বলেছি, এখনো অনেক সময় আছে। এটা একটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ আইন। আমরা একটি খসড়া করেছি। এটা অতি সহজেই অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করতে পারেন। তারপর সংসদে এটার অনুমোদন হবে।’
তিনি বলেন, ‘উনি সংসদের সংক্ষিপ্ততার কথা বলছেন। কিন্তু উনারা যেভাবে এই নিয়োগ দিতে বদ্ধপরিকর, সেভাবে তো সংসদের কোনো সংশ্লিষ্টতাই থাকবে না। উনার কথা বিপরীতমুখী। এটার মধ্যে যৌক্তিকতা নেই।’
এ বিষয়ে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে আইন তৈরি করতে পারেন।’
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ইসি গঠনের জন্য যে সার্চ কমিটির নিয়ম চালু আছে, তা আইন না হলেও আইনের কাছাকাছি। কারণ এ সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতি নিজে গঠন করেন।’
তবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলেছেন সংসদকে সংশ্লিষ্ট করা যাবে না বলে আইন করা যাবে না, কিন্তু সংসদকে সংশ্লিষ্ট না করেই তারা অনুসন্ধান কমিটি করে নিয়োগ দিয়ে ফেলবেন! এটাতো কোনোভাবেই যায় না, কারণ দুটো একত্রে যায় না।’
যা আছে খসড়ায়
এ বিষয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘যারা নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাবেন, তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি আমরা সেখানে উল্লেখ করেছি।’
কী প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হবে সে বিষয়েও খসড়ায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যাদেরকে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হবে তাদের সব তথ্য জনগণের কাছে প্রকাশ করা। আর যখন রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের নাম সুপারিশ করা হবে তখন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা যে, কোন ভিত্তিতে এবং কোন যোগ্যতায় তাদের নাম সুপারিশ করা হলো। এগুলো আমরা খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করেছি।’
জানা গেছে, খসড়ায় কমিশনারদের যোগ্যতা ও অনুসন্ধান কমিটি গঠনসহ নানা ইস্যুতে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
খসড়ায় কমিশনারদের যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিক, বয়স ন্যূনতম ৪৫ বছর, প্রমাণিত প্রশাসনিক দক্ষতা, সততা ও অনুমিত নিরপেক্ষতাসহ আইন বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি বা বেসরকারি পদে অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিষয়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি কমিশনারের শূন্যপদে নিয়োগদানের জন্য ধারা ৪-এর অধীন বর্ণিত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্যানেল তৈরির উদ্দেশ্যে ন্যূনতম একজন নারীসহ, নিম্নবর্ণিত সাত সদস্য সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন।
সাত সদস্যের পরিচয়ে বলা হয়- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, যিনি কমিটির আহ্বায়ক হবেন। সংসদ নেতা থেকে মনোনীত জাতীয় সংসদের একজন সংসদ সদস্য, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা থেকে মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, সংসদের আসন সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি যিনি প্রথম পাঁচ জনের সর্বসম্মত অথবা সর্বসম্মত না হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত হবেন এবং গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি যিনি প্রথম পাঁচজনের সর্বসম্মত অথবা সর্বসম্মত না হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত হবেন।
খসড়ায় কমিটির কার্যাবলী প্রসঙ্গেও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কমিটি কমিশনে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে ধারা ৪-এ বর্ণিত ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে এবং পেশাজীবী সংগঠনসহ নাগরিকদের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। কমিটি প্রাপ্ত নামগুলো থেকে ধারা ৪-এর আলোকে বাছাই করে ন্যূনতম পাঁচজন নারীসহ অন্যূন ১৫ জন এবং অনূর্ধ্ব ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা করবে ও তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্মতিক্রমে গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে।
এতে বলা হয়, সুপারিশ করা প্যানেলভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি হলফনামা সহকারে/লিখিতভাবে ঘোষণা করবেন যে, তিনি ধারা ৯-এ বর্ণিত কোনো অযোগ্যতা দ্বারা বারিত নয়। সুপারিশ করা প্যানেলভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্ধারিত ছকে সম্পদের হিসাব দাখিল করবেন, যা অনুসন্ধান কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে।
খসড়ায় বলা হয়, প্রকাশিত প্রাথমিক তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে গণশুনানির আয়োজন করা হবে। তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে এবং কমিটি সর্বসম্মতভাবে ন্যূনতম দুজন নারীসহ সাতজনের একটি প্যানেল প্রস্তুত করবে। কী কী ধরনের যোগ্যতা ও বিবেচনার ভিত্তিতে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে সে সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবে।
তবে শর্ত থাকে যে, কমিটি প্যানেল প্রস্তুত করতে সর্বসম্মত হতে না পারলে সভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে প্যানেল প্রস্তুত করবে। কমিটির প্রস্তুত করা প্যানেল নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির বরাবর প্রেরণ করবে এবং রাষ্ট্রপতি এরমধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে এবং অনধিক চারজনকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
কোনো পদ শূন্য হলে পূরণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তবে শর্ত থাকে যে, উপরোল্লিখিত পন্থায় গঠিত কমিশনের কোনো পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি উপ ধারা ৫-এর অধীন প্রণীত তালিকা থেকে শূন্য পদ যতদূর সম্ভব পূরণ করবেন। কমিটিকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য অন্যূন এক মাস ও অনূর্ধ্ব দুই মাস সময় প্রদান করা হবে।
কমিশনের কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা প্রসঙ্গে খসড়ায় বলা হয়, গঠিত কমিশনের পরের মেয়াদ থেকে কমিশনের কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে রাষ্ট্রপতি পূর্ববর্তী কমিশনের জ্যেষ্ঠতম কমিশনারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগদান করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, দায়িত্বপালনকালে যদি তিনি দুর্নীতি ও কোনোরূপ গুরুতর অসদাচরণে জড়িত হয়ে থাকেন অথবা পুনরায় কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মত হন, তাহলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠতম কমিশনারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হবে। এ নিয়োগের ক্ষেত্রেও ধারা ৫ অনুসরণে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।