ঢাকা ০২:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিভেদ বাড়িয়ে ঐক্যের ডাকে কাজ হবে তো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৫৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
  • ৮ বার

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছিলেন কেবল সজীব ওয়াজেদ জয়। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের সেসব বক্তব্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সীমাহীন দুর্নীতি, নির্বাচনের নামে বারবার তামাশা এবং সর্বোপরি আন্দোলনকারীদের দমাতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যা-নৃশংসতার জন্য এতটুকু অনুশোচনা প্রকাশ পায়নি। উল্টো তিনি গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে আইনসংগত সংস্কার ও নির্বাচন অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত জয় দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দল বলতে নিজের দল আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘না শুধরে কি পাবে আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে তখনই লিখেছিলাম, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী করে নিজেদের শুধরে নেওয়ার বদলে অনুকূল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের শোধরানোর উদ্যোগ না নিলে তাঁদের সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কি না, সেই প্রশ্নও রেখেছিলাম।

আমার মতো এক নগণ্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিমতের বিষয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন—এমন আশা কস্মিনকালেও পোষণ করি না। তবে গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা নানা বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপের লেশমাত্রও দেখা যায়নি। উল্টো তাঁরা আদৌ কোনো অপরাধ বা ভুল করেছেন কি না, সে বিষয়ে জনমত জানতে আগে তাঁদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়ার সুযোগ চান দলটির কোনো কোনো নেতা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ভুল-ত্রুটি সামনে এনেই রাজনীতিতে এবং জনগণের কাছে ফিরতে চায় তাঁদের দল।

নাছিম আরও বলেন, ‘আমরা যদি ভুল করি, মানুষ খারাপ বললে সেই সমালোচনা মেনে নিয়ে আমরা শোধরাবার চেষ্টা করব। অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও সমৃদ্ধ কাজ করার চেষ্টা করব। আমরা খারাপটাকে বর্জন করব। খারাপ যদি করে থাকি, সেটার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমরা দলীয় মূল্যায়ন করে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরব।’

দলীয় বা সরকারি পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার যাঁরা করেছেন, তাঁদের মনোভাব এমন হলেও সাধারণ অনেক কর্মী-সমর্থকের কাছ থেকে শোধরানোর পক্ষেই মত পেয়েছি। ফোনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি সরাসরি আলাপচারিতায় চেনাজানা বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগারের কাছ থেকে এমন অভিমত পাই। আমার নিজ এলাকার একজন সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগার তো ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে সরাসরি লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারক মহলের ভাববার সময় এখনই’।

আওয়ামী লীগারদের প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, লেখাটি ছাপা হওয়ার পর একদা বামপন্থী দু-একজন বন্ধু কিন্তু আমার ওপর বেজায় চটেছিলেন। একজন লিখেছিলেন, ‘আপনাদের লজ্জা করে না ইনিয়ে-বিনিয়ে, প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা বলতে?’ ওই বন্ধুটির কাছে আওয়ামী লীগকে শোধরানোর তাগিদ দেওয়ার মানে হলো ‘প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা’ বলা!

পুরোনো প্রসঙ্গটি টেনে আনলাম ‘রিফাইন্ড (পরিশীলিত বা সংশোধিত) আওয়ামী লীগ’ নিয়ে হঠাৎ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে। রাজনীতিতে এই নতুন উত্তাপ দেখা দিয়েছে মূলত ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই’ বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক মন্তব্যের পর। ড. ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলের কাছে ওই মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার বেশ কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’ এর ঘণ্টাখানেক পর আরেকটি বড় পোস্টে হাসনাত দাবি করেন, ভারতের পরিকল্পনায় ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি লেখেন, ‘আমিসহ আরও দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ মার্চ দুপুর ২: ৩০-এ। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই।’ হাসনাত আরও লেখেন, ‘আমাদের আরও বলা হয়, “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে—এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।’

দেশের সক্রিয় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই কৌশল নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাইলে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন কোনো কোনো রাজনীতিক। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘যাঁরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী, তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না কেন?’ তাঁর এই বক্তব্য নিয়েও দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করছেন বিএনপিরও কিছু লোক। রিজভী কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরাধী নেতাদের বিচারের বিপক্ষে কিছু বলেননি। তাঁর বক্তব্যেও মূলত পরিশীলিত আওয়ামী লীগের ধারণারই সমর্থন মেলে। কিন্তু তাঁকে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির শিকার বানানোর চেষ্টা চলছে। কিছু মহল বিষয়টিকে ফ্যাসিস্ট দলের পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে নিজস্ব গোষ্ঠীস্বার্থে সাধারণ মানুষকে পক্ষে টানার চেষ্টায় লিপ্ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টায়ও আছে কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী। কেউ কেউ এই ইস্যুতে নিরাপত্তা বাহিনীকেও জনগণের প্রতিপক্ষ বানাতে চাইছে। এতে যে সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না চিন্তাবিদ তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও।

হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় পোস্টের একেবারে শেষে লিখেছেন, ‘আসুন, সকল যদি কিন্তু পাশে রেখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।’ যদিও একটি বিষয়েই শুধু নয়, বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্যই অপরিহার্য ছিল ঐক্য। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টোটা। শুরু থেকেই উপেক্ষা করা হতে থাকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের। দিনে দিনে নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে মতভেদও প্রকাশ পায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের। এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নানা ইস্যুতে বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসা ব্যক্তি-সংগঠনকেও কখনো ‘শাহবাগি’, কখনো ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মব লেলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ‘শক্তি-সামর্থ্য’ কম বলেই বোধ করি বিষয়টি অনেকের কাছে ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু একপর্যায়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গেও মতভিন্নতা দেখা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত এনসিপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের। রাষ্ট্রপতিকে সরানো, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জাতীয় নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও স্থানীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে এই মতভেদ দেখা যায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো শনিবারও এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে কিংবা নির্বাচন আগে, সংস্কার পরে—এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। জাতীয় সংস্কার কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে, যা অনভিপ্রেত।

আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আগাগোড়াই আন্দোলনে ছিল বিএনপি ও তার সমমনা বিভিন্ন দল, সিপিবি-বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চাসহ অনেক রাজনৈতিক দল। আন্দোলনকারী অনেক দলের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে নিজেদের সুবিধামতো ঐক্যের ডাক কতটা ফলদায়ক হবে সেটা অচিরেই স্পষ্ট হবে বলে আশা করা যায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বিভেদ বাড়িয়ে ঐক্যের ডাকে কাজ হবে তো

আপডেট টাইম : ১০:৫৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছিলেন কেবল সজীব ওয়াজেদ জয়। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের সেসব বক্তব্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সীমাহীন দুর্নীতি, নির্বাচনের নামে বারবার তামাশা এবং সর্বোপরি আন্দোলনকারীদের দমাতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যা-নৃশংসতার জন্য এতটুকু অনুশোচনা প্রকাশ পায়নি। উল্টো তিনি গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে আইনসংগত সংস্কার ও নির্বাচন অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত জয় দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দল বলতে নিজের দল আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘না শুধরে কি পাবে আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে তখনই লিখেছিলাম, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী করে নিজেদের শুধরে নেওয়ার বদলে অনুকূল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের শোধরানোর উদ্যোগ না নিলে তাঁদের সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কি না, সেই প্রশ্নও রেখেছিলাম।

আমার মতো এক নগণ্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিমতের বিষয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন—এমন আশা কস্মিনকালেও পোষণ করি না। তবে গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা নানা বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপের লেশমাত্রও দেখা যায়নি। উল্টো তাঁরা আদৌ কোনো অপরাধ বা ভুল করেছেন কি না, সে বিষয়ে জনমত জানতে আগে তাঁদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়ার সুযোগ চান দলটির কোনো কোনো নেতা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ভুল-ত্রুটি সামনে এনেই রাজনীতিতে এবং জনগণের কাছে ফিরতে চায় তাঁদের দল।

নাছিম আরও বলেন, ‘আমরা যদি ভুল করি, মানুষ খারাপ বললে সেই সমালোচনা মেনে নিয়ে আমরা শোধরাবার চেষ্টা করব। অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও সমৃদ্ধ কাজ করার চেষ্টা করব। আমরা খারাপটাকে বর্জন করব। খারাপ যদি করে থাকি, সেটার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমরা দলীয় মূল্যায়ন করে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরব।’

দলীয় বা সরকারি পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার যাঁরা করেছেন, তাঁদের মনোভাব এমন হলেও সাধারণ অনেক কর্মী-সমর্থকের কাছ থেকে শোধরানোর পক্ষেই মত পেয়েছি। ফোনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি সরাসরি আলাপচারিতায় চেনাজানা বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগারের কাছ থেকে এমন অভিমত পাই। আমার নিজ এলাকার একজন সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগার তো ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে সরাসরি লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারক মহলের ভাববার সময় এখনই’।

আওয়ামী লীগারদের প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, লেখাটি ছাপা হওয়ার পর একদা বামপন্থী দু-একজন বন্ধু কিন্তু আমার ওপর বেজায় চটেছিলেন। একজন লিখেছিলেন, ‘আপনাদের লজ্জা করে না ইনিয়ে-বিনিয়ে, প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা বলতে?’ ওই বন্ধুটির কাছে আওয়ামী লীগকে শোধরানোর তাগিদ দেওয়ার মানে হলো ‘প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা’ বলা!

পুরোনো প্রসঙ্গটি টেনে আনলাম ‘রিফাইন্ড (পরিশীলিত বা সংশোধিত) আওয়ামী লীগ’ নিয়ে হঠাৎ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে। রাজনীতিতে এই নতুন উত্তাপ দেখা দিয়েছে মূলত ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই’ বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক মন্তব্যের পর। ড. ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলের কাছে ওই মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার বেশ কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’ এর ঘণ্টাখানেক পর আরেকটি বড় পোস্টে হাসনাত দাবি করেন, ভারতের পরিকল্পনায় ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি লেখেন, ‘আমিসহ আরও দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ মার্চ দুপুর ২: ৩০-এ। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই।’ হাসনাত আরও লেখেন, ‘আমাদের আরও বলা হয়, “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে—এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।’

দেশের সক্রিয় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই কৌশল নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাইলে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন কোনো কোনো রাজনীতিক। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘যাঁরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী, তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না কেন?’ তাঁর এই বক্তব্য নিয়েও দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করছেন বিএনপিরও কিছু লোক। রিজভী কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরাধী নেতাদের বিচারের বিপক্ষে কিছু বলেননি। তাঁর বক্তব্যেও মূলত পরিশীলিত আওয়ামী লীগের ধারণারই সমর্থন মেলে। কিন্তু তাঁকে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির শিকার বানানোর চেষ্টা চলছে। কিছু মহল বিষয়টিকে ফ্যাসিস্ট দলের পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে নিজস্ব গোষ্ঠীস্বার্থে সাধারণ মানুষকে পক্ষে টানার চেষ্টায় লিপ্ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টায়ও আছে কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী। কেউ কেউ এই ইস্যুতে নিরাপত্তা বাহিনীকেও জনগণের প্রতিপক্ষ বানাতে চাইছে। এতে যে সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না চিন্তাবিদ তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও।

হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় পোস্টের একেবারে শেষে লিখেছেন, ‘আসুন, সকল যদি কিন্তু পাশে রেখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।’ যদিও একটি বিষয়েই শুধু নয়, বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্যই অপরিহার্য ছিল ঐক্য। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টোটা। শুরু থেকেই উপেক্ষা করা হতে থাকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের। দিনে দিনে নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে মতভেদও প্রকাশ পায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের। এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নানা ইস্যুতে বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসা ব্যক্তি-সংগঠনকেও কখনো ‘শাহবাগি’, কখনো ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মব লেলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ‘শক্তি-সামর্থ্য’ কম বলেই বোধ করি বিষয়টি অনেকের কাছে ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু একপর্যায়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গেও মতভিন্নতা দেখা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত এনসিপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের। রাষ্ট্রপতিকে সরানো, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জাতীয় নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও স্থানীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে এই মতভেদ দেখা যায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো শনিবারও এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে কিংবা নির্বাচন আগে, সংস্কার পরে—এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। জাতীয় সংস্কার কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে, যা অনভিপ্রেত।

আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আগাগোড়াই আন্দোলনে ছিল বিএনপি ও তার সমমনা বিভিন্ন দল, সিপিবি-বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চাসহ অনেক রাজনৈতিক দল। আন্দোলনকারী অনেক দলের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে নিজেদের সুবিধামতো ঐক্যের ডাক কতটা ফলদায়ক হবে সেটা অচিরেই স্পষ্ট হবে বলে আশা করা যায়।