হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইতিহাসের মহানায়ক বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যে নোবেল পাওয়া বার্ট্রান্ড রাসেল পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের একজন বড় নেতাও ছিলেন। বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশ্ব মানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মানবিক নেতা। বড় হয়ে নিজ শিশু পুত্র এমন মানবিকতার আলোয় আলোকিত হবে এই মহৎ আশায় বঙ্গবন্ধু তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল।
বঙ্গবন্ধু অনিশ্চয়তা ও অন্ধকারের মাঝে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের রাজনীতির উত্তাল সময় বঙ্গবন্ধুর ঘর আলোকিত করে ১৯৬৪ সালে ১৮ই অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িতে জন্ম নিলেন একটি ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল। শেখ রাসেলের জীবনের বেশিভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়া। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষে মুক্তির জন্য বৎসরের পর বৎসর কারাবরণ করেছে। বাঙ্গালী অধিকার আদায় ছাড়া বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার কোন আকর্ষণ ছিল না। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শে বাবা মার উভয়ের ভালবাসা দিয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট এক অভিশপ্ত ভোরে শেখ রাসেলকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চোখের সামনে বাবা-মা-ভাই-ভাবীদের রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়তে দেখেছে শিশু রাসেল। এক পর্যায়ে তার বক্ষভেদ করেছে তপ্ত বুলেট।কলিতেই ঝরে গেল একটি ফুল। একটি সম্ভাবনাময় জীবন। ফুটতে পারলো না সে। তার আলোয় আলোকিত হতে পারতো বাংলাদেশ। হেমন্তে তার জন্ম, কিন্তু ঝরা পালকের মতো অন্তর্ধান ছিল তার নিয়তি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের স্বপ্নস্রষ্টা, তার আজন্মকালের সংগ্রামের ফসল এই বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’
বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে অনেক বেশী ভালবাসতেন। কোন বাঙ্গালী তাকে হত্যা করতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু দুর্ভোগ বাঙ্গালী জাতির ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের নায়ক বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ খন্দকার মোস্তাক। ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দেয় তার প্রমাণ এ হত্যাকাণ্ড।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেসা মুজিব মোশতাকে ভাই ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি কেঁদেছিলেন মোশতাক কবরে নেমে নিজের হাতে দাফন করেছিলেন লাশ। তার কান্না থামাতে আসতে হয়েছিলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু তনয়, শেখ কামালের বিয়ের ‘উকিল বাপ’ ছিলেন এই মানুষটি। এতোটাই ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধুকে, তার মাথার উপরে বঙ্গবন্ধুর ছায়া বোঝানোর জন্য সোনা দিয়ে একটা বটবৃক্ষ তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন।
১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল, যে রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাঙালির জাতির পিতাকে, নিজ হাতে হাঁসের মাংস রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলেন এই খন্দকার মোশতাক। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে যারা অংশগ্রহণ করেছিল এবং যারা নেপথ্যর নায়ক ছিলেন তাদের অনেককেই বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু ভাইয়েরমত সন্তানেরমত আদর করতেন ।তারা কি করে পারলো হিমালয়ের মত যার হৃদয় ১৮টি বুলেটে তার বুকটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে? কি করে গুলি করলো সকলের আদরে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের বুকে? কি দোষ করেছিল রাসেল? সে তো রাজনীতি করতো না। ক্ষমতার দম্ভ দেখানো বা কারো ক্ষতি বা অনিষ্ট করার বয়সও তার হয়নি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি শেষ চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করতেই শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হাজার বছরে একজনই জন্মায়। কিন্তু, পথ-কুকুরের মতো, মোশতাকেরা বারবার ফিরে আসে। তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। বারবার জন্মায় মোশতাকের দল, নানা সময়ে, নানা চরিত্রে। একজন ‘মুজিব’ আসে না।
আমরা আর কোথাও একটি মুজিব দেখিনা!! মুজিবরা পৃথিবীতে বারবার আসে না, একবারই আসে। কিন্তু, মোশতাকরা পৃথিবীতে আজীবনই থাকে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মানবতার শত্রুরা পৃথিবীতে আসে অসুরের অপশক্তি নিয়ে কিন্তু চূড়ান্তভাবে প্রগতি ও মানবিক শক্তির কাছে পরাজিত হয়, তাই দেখা যায় মীর জাফর, মোশতাক, নাথুরাম গডসরা ইতিহাসের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঐ নরপিশাচরা যুগ যুগ ধরে ঘৃণিত অভিশপ্ত হয়ে থাকবে।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন। শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হঠাৎ জন্ডিস হওয়ায় শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে বেগম মুজিব তাকে আর শেখ হাসিনার সঙ্গে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাকে আর হারাতে হতো না।
আমাদের সকলেরই বাবা মা ভাই বোন আত্মীয়স্বজন আছে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি বারও যদি আমরা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের সকলকে হারানোর যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করি। তাহলে ভালবাসার ছোট্ট রাসেলকে হারানোর কষ্টটা বোধ করি প্রতিটি মানুষের বিবেকে নাড়া দিবে।
বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বাবা, ফজিলাতুননেসার মতো মমতাময়ী মা, শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রাসেলসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়-পরিজনকে হারানোর বিষাদ বেদনাকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা। আর আজও তাঁরা যে শোক যন্ত্রণায় মূহ্যমান তা তাদের জীবনের কোন প্রাপ্তিতেও মুছে যাবে না। তবু তারা তাদের মহান পিতার স্বপ্ন দুঃখী মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে, বার বার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে মানবমুক্তির জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সমগ্র পরিবারকে হারিয়ে সমগ্র জাতিকে, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের নিজ পরিবারের আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর পরিবার একটি আলোকিত পরিবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বারবার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া বাঙ্গালী জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ও আদর্শের উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একজন সফল প্রধানমন্ত্রী। একটি উদীয়মান জাতির অনুপ্রেরণা। একটি অগ্রসরমান জাতির সাহসের প্রতীক। যার যাদুকরী নেতৃত্বে ঝলমল করে আলোকিত হয়েছে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া একটি দেশ।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের তালিকায় নাম লেখানোর স্বপ্নময় পথ অতিক্রম করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্নের গণ্ডি ছড়িয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আজ রাসেল বেঁচে থাকলে রাসেলও হতে পারতো বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি। বার্ট্রান্ড রাসেল মত বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশ্ব মানবতার প্রতীক হয়ে। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। শেখ রাসেল তোমার মৃত্যু নাই, তুমি বেঁচে আছ কোটি শিশুর প্রদীপ হয়ে। ‘‘তোমাদের বুলেটবিদ্ধ রক্তের ঋণ জাতি শোধিতে পারিবে না কোনদিন।” শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল শুভ জন্মদিন।
লেখক: সাবেক সভাপতি বার্লিন আওয়ামী লীগ।