শয়তানের চ্যালেঞ্জ ও আল্লাহর ক্ষমার নমুনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বান্দার গোনাহ ক্ষমা করায় আল্লাহ তাআলা কত মহান! শয়তান মানুষকে বিপথগামী করার যে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছে, এর প্রেক্ষিতে বান্দা ইসতেগফার করলেই আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। আবার ক্ষমার দরজার বিশালতার বিবরণও এসেছে হাদিসের বর্ণনায়। শয়তানের চ্যালেঞ্জ ও ক্ষমার বর্ণনায় কী সুসংবাদ দিয়েছেন বিশ্বনবি?

উম্মতে মুহাম্মাদিকে ক্ষমা প্রার্থনায় মনোযোগী হতে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য হাদিসের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহ একাধিক আয়াত নাজিল করে বান্দাকে ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবার কথা বলেছেন। মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাকে এ মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন যে-
১. وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ
‘আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমলকারীকে বেশি করে (প্রতিদান) দেবেন আর যদি তোমরা বিমুখ হতে থাক, তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আজাবের আশঙ্কা করছি।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৩)

২. وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩১)

৩. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা কর- ‘আন্তরিক তওবা’। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মুচে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করবেন; যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। আল্লাহ সেদিন নবি এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। তারা বলবে- হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর উপর সর্ব শক্তিমান।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৮)

আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা নির্দেশ এবং ফজিলত শুনে প্রিয় নবি উম্মতে মুহাম্মাদিকে বেশি বেশি ক্ষমা-প্রার্থনায় দিকনির্দেশনা দেন। তিনি নিজেও প্রতিদিন ৭০/১০০ বার তাওবাহ করতেন। যা উম্মতের জন্য এক মহান শিক্ষা। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় ওঠে এসেছে-

১. ক্ষমা প্রার্থনায় বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
‘ইবলিস তার রবকে বলেছে, আপনার ইজ্জত ও বড়ত্বের কসম! আমি বনি আদমকে পথভ্রষ্ট করতেই থাকবো; যতক্ষণ তাদের মধ্যে রূহ থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার ইজ্জত ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের ক্ষমা করতে থাকবো; যতক্ষণ তারা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (তাওবাহ-ইসতেগফার) করে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

উম্মতকে তাওবাহ-ইসতেগফারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন ৭০/১০০ বার তাওবা করতেন। হাদিসে এসেছে-
> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করি।’ (বুখারি, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)

হজরত আগার্র ইবনে ইয়াসির মুযানি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর সমীপে তওবাগ কর ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাও! কেননা, আমি প্রতিদিন ১০০ বার করে তওবাহ করে থাকি।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)

২. বান্দার প্রতি মহান আল্লাহ ক্ষমার বিশালতা
মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর ক্ষমা ও উদারতা কত বেশি তা ফুটে ওঠেছে অন্য এক হাদিসে। দীর্ঘ এক হাদিসের শেষ দিকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওবার দরজার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
হজরত জির্র ইবনে হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি মোজার উপর মাসাহ করার মাসআলা জিজ্ঞাসা করার জন্য সাফওয়ান ইবনু আস্‌সালের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘হে জির্র! তোমার আগমনের উদ্দেশ্য কি?’ আমি বললাম, ‘জ্ঞান অন্বেষণ।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই ফেরেশতামণ্ডলী ঐ অন্বেষণের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বিদ্যার্থীর জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন।’
এরপর আমি বললাম, ‘পেশাব-পায়খানার পর মোজার উপর মাসাহ করার ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু আপনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সাহাবি, তাই আপনার কাছে জানতে এলাম যে, আপনি এ ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু আলোচনা করতে শুনেছেন কি না?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! যখন আমরা বিদেশ সফরে বের হতাম, তখন তিনি আমাদেরকে (সফরে) তিনদিন ও তিন রাত মোজা না খোলার আদেশ দিতেন (অর্থাৎ আমরা যেন এই সময়সীমা পর্যন্ত মাসেহ করতে থাকি), কিন্তু বড় অপবিত্রতা (সঙ্গম, বীর্যপাত ইত্যাদি) হেতু অপবিত্র হলে (মোজা খুলতে হবে)। কিন্তু পেশাব-পায়খানা ও ঘুম থেকে উঠলে নয়। (এ সবের পর রীতিমত মাসেহ করা বৈধ)।’

আমি বললাম, ‘আপনি কি তাঁকে ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে শুনেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সফরে ছিলাম।

(একবার) আমরা তাঁর সঙ্গে বসা ছিলাম। এমন সময় এক বেদুঈন অতি উঁচু গলায় ডাক দিল- ‘হে মুহাম্মাদ!’
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে উঁচু আওয়াজে জবাব দিলেন, ‘এখানে এস!’

আমি তাকে (বেদুঈনকে) বললাম, ‘আরে তুমি নিজের আওয়াজ নীচু কর! কেননা, তুমি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছো। তাঁর কাছে এ রকম উঁচু গলায় কথা বলা তোমার (বরং সকলের) জন্য নিষিদ্ধ।’
সে (বেদুঈন) বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি তো আস্তে কথা বলবই না।’
বেদুঈন (প্রিয় নবির কাছে জানতে চেয়ে) বলল, ‘কোনো ব্যক্তি কিছু লোককে ভালোবাসে; কিন্তু সে তাদের (মর্যাদায়) পৌঁছতে পারেনি? (এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?)।’
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘মানুষ কেয়ামতের দিন ঐ লোকদের সঙ্গে থাকবে, যাদেরকে সে ভালবাসবে।’
পুনরায় তিনি আমাদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকলেন। এমনকি তিনি পশ্চিম দিকের একটি দরজার কথা উল্লেখ করলেন- ‘যার প্রস্থের দূরত্ব ৪০ কিংবা ৭০ বছরের পথ অথবা তিনি বললেন, ওর প্রস্থে একজন আরোহী ৪০ কিম্বা ৭০ বছর চলতে থাকবে।
(এই হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হজরত সুফিয়ান বলেন যে, এই দরজা সিরিয়ার দিকে অবস্থিত।) আল্লাহ তাআলা আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন এই দরজাটি সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সময় থেকে তা তওবার জন্য খোলা রয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য না উঠা পর্যন্ত এটা বন্ধ হবে না।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)

৩. ক্ষমা চলবে অবিরাম
হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রাতে নিজ হাত প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে এবং দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবাহ করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত (ক্ষমার এ ধারা অবিরাম) এই রীতি চালু থাকবে।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হওয়ার আগে তওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ করবেন।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)

হজরত আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবাহ সে পর্যন্ত কবুল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয়।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)

সুতরাং মানুষের উচিত, গুনাহ বা অন্যায়র ধরন যেমনই হোক সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাওবাহ করে সঠিক পথে ফিরে আসা। বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। তার তাতেই মুমিন হবে সফলকাম।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পায় পেতে বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

           

          Print Friendly, PDF & Email

               এ ক্যাটাগরীর আরো খবর