ঢাকা ০৭:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মা তুঝে তসলিম, মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অশ্বত্থ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১১:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১
  • ২৫১ বার

রফিকুল ইসলামঃ ‘আমি ভীষণ ভালোবাসতাম মা-কে /কখনো মুখ ফুটে বলিনি। /আমার ভালোবাসার কথা /মা-কে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি। /কেমন করে তোমাকে আমি বলি… ‘

মায়ের প্রথম বার্ষিকী আজ। গতবছর ২ অক্টোবর পরলোক গমন করেছেন। কবর দেওয়া পর্যন্ত ভেঙে পরিনি এতটুকুও, না বিচলিত; কাঁদিনি। বরং অন্যদের বারণ করে চলেছি ভাই-বোনসহ সবাই শিয়রে যখন অঝোরে বুকফাটা কান্না করছিল। কী নিষ্ঠুর আমি! চোখে কোণে পানি নেই। কান্নায় বাতাস ভারি করিনি। উল্টো কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। বড়দের উপরও ছিল খবরদারি। সূরা ইয়াছিনসহ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের এক অঘোষিত হুকুম চালিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী মমতাময়ী মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর নিরন্তর চেষ্টা ছিল আমার, যেন মহামন্ত্রজ্ঞ পবিত্র কালিমা নসিব হয়।

জন্মের মৃত্যু অবিনশ্বর জেনেও প্রেক্ষাপট নিয়ে সন্দিহানে পেয়ে বসে বিচ্ছিন্ন ভাবনা। পারিবারিক কবরস্থান, যেখানে বাবা শায়িত; তা বর্ষায় হাওরের অথৈ জলরাশীর তলে। শরিয়তের দৃষ্টিতে মানবজাতির সৃষ্টিলগ্নেই নির্ধারিত থাকে ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু ও কবরস্থান। নিয়তিতে বাবার সাথে কবর স্থিরীকৃত থাকলে তো বর্ষা মৌসুমে মারা যাবার কথা নয়। মনে আশা জাগে বাবার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতকে ঘিরে। বাবার মৃত্যুকালীন শয়নশিয়র উত্তরমুখীর করার পরও প্রাণ পেয়ে সুস্থ শরীরে সকলের মাঝে বেঁচে ছিলেন বর্ষা মৌসুম হতে শুকনা মৌসুম পর্যন্ত। বাধভাঙা বিচ্ছিন্ন ভাবনা আছড়ে পড়ে মন ভারি করে তুলে।

Screenshot_20211001-152352_Gmail
‘বড়বাড়ি’ খ্যত (নানার বাড়ি) কবরস্থানটি জাগানো। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের বদান্যতায় মিঠামইনের ধলাই-বগাদিয়া বাগে জান্নাত কবরস্থানের সাথে সংযুক্তিতে উঁচু করে মাটি ফেলায় জলরাশীর ওপর জেগে রয়েছে ভাবতেই শঙ্কা ঝেঁকে বসে। মা’র ক্ষেত্রে ভিন্নতা হলো তো মা-কে হারাবো। তাহলে কি মা নশ্বর আর থাকছে না! আজ তো জুম্মাবার। মানে শুক্রবার। ধর্মে দিনটি বরকতময়। ওইদিন কেউ মারা গেলে গোরাযাব বা কবরের শাস্তি হয় না – মনে উদয় হতেই নির্দয়ভাবে মায়ের মৃত্যু কামনা করেছি সেদিন।

হৃদরোগে আক্রান্ত শ্বাশুড়ির অবনতির সংবাদে যেতে হয়েছিল। ছুটে আসতে হলো মায়ের ‘জওয়াব বদ্ধ’ খবরে। এসে শুনি আমাদের নাম ধরে জানতে চেয়েছেন ফিরেছি কি না। ডাক দিতেই ‘তোরা আইছত পুত? খাইছত নি?’- সম্বিত ফিরে পেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জীবনসায়াহ্নেও আমাদের ছুঁয়ে সুখ নেবার কি যে ব্যাকুলতা! এটা তাঁর সহজাত ও মজ্জাগত চেতনা। নিজের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তুচ্ছ করে সন্তানদের মুখের হাসি দেখতে চেয়েছেন। কেবল ক্লান্তিহীনভাবে দিতেই জেনেছেন, নেবার প্রত্যাশা করেননি। ছিলাম আদরের, মমতার, সাত রাজার ধন। কত সাধনায়, কত যত্নে লালন-পালন করেছেন। মায়ের শরীরের অংশ নয় শুধু, পুরো হৃদয় জুড়েই ছিলাম। সমস্ত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুখ দুঃখ দূরে সরিয়ে অহর্নিশি সন্তানদের মঙ্গল কামনায় কাটিয়েছেন প্রতিটা মুহূর্ত। একমাত্র সন্তানদের ঘিরেই ছিল দিনযাপন, স্বপ্ন, আনন্দ। জায়নামাজে দু’হাত তুলে নিরন্তর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় সাফল্য কামনায় নিমগ্ন থেকেছেন। ভালোটা নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছেন। সন্তানদের মুখপানে তাকিয়ে নিজের শত বেদনা সয়েছেন, কত না কষ্ট, যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা আর কতই না অশ্রু সঙ্গোপনে আড়াল করে রেখেছেন। নিজেকে নিঃশেষ করে সন্তানদের পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন। তাঁর সমস্ত বিসর্জন সন্তানদের মানুষ করার পেছনে। আমাদের সমস্ত অর্জন কেবই তাঁর একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, বিসর্জনের ফলশ্রুতিতে। বাবার অপূর্ণ ভালোবাসা ভরিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয়ের প্রত্যাশা; মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা।

১৯৮৮ সালেই বাবাকে হারিয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবারে মায়ের আঁচল ছিল মজবুত গিঁট। আসুরিক শ্যেনদৃষ্টি, বিভীষণ বন্ধুর পথ ডিঙিয়ে আমাদের সকলকে আজকের এই প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে দাঁড় করানোর পথ মসৃণ ছিল না বলেই বীরাঙ্গনা। মা হিসেবে সার্থক। রিপোর্টিংয়ে ক্রাইম এবং পরবর্তীতে পার্লামেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল বিট করতাম বলে আতঙ্ক কাটতো না মায়ের। আমার দুটি কলাম ‘দেশচিন্তা’ ও ‘তথ্যতরঙ্গ’ কলাম দুটি বন্ধ করে দেবার উপর্যুপরি হুমকিতে মায়ের আঁচল থেকে শক্তি সঞ্চয়ে গর্জে উঠে কলাম লিখেছিলাম – ‘হুমকি নয়, আনতে হবে রাঙা প্রভাত’। আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-যন্ত্রণা আর স্বপ্নরাজ্যের যত সুখ অনুভূতির আলোড়ন সবই যাকে ঘিরে; তাঁকেই কি না একলা ফেলে যাচ্ছি! ভাবনাতে সৃষ্ট চাপা কান্নার প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাধীনে থেকে আজও শরীর পুনরুদ্ধার হয়নি।

মায়ের মৃত্যু হয়েছে বার্ধক্যজনিত কারণে। তবে, কোমড়ের একপাশের বাটি ভেঙে পরায় প্রায় ছয় বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। ঢাকাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ও পরামর্শে অপারেশনে যাওয়া হয়নি। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে খোলামেলা পরিসরে থাকতে বাচ্চাদের মতো উপর্যুপরি আবদারে পরিত্যক্ত সংস্কার করা একটি হাফ বিল্ডিংয়ে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও রাতে? দেখাশোনা, হুট-ফরমায়েশ ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কি হবে? সেবার সহযোগিতায় একত্রে রাত্রিযাপন শুরু হয় আমাকে দিয়ে। পরে ভাইয়াচারীরা যার যার কর্মস্থল ও অবস্থানের সুবিধা মতে পালাক্রমে প্রাণান্ত সেবা দিয়ে গেছেন। বাকিসময় বউচারীরা। যারা চাকরি করতেন, সময় ভাগাভাগি করে নিতেন। যে মা মাথার কাপড়টুকুও ফেলতেন না আমার সামনে, তিনি অবশেষে প্রকৃতির ডাকে পানি খরচের সেবাটিও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন শিশুটির মতো, নেহায়েত অপারগতায়। এ ছিল বিরল সুযোগ, যা অনেকের ভাগ্যেই জুটে না।

মা-বাবার কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। তাঁদের আদর আর শাসন এক হয়ে যেতো। শৈশবে কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত গন্ডগোল বাধিয়ে বাড়ি ফিরলে প্রথমেই তোপের মুখে পরতে হতো ‘আগে তুই কী করেছিলি’ প্রশ্নবাণে। আদুরী সাজার পরিমণামও ছিল পাঙক্তেয়, যার বুমেরাং ভুলবার নয়। বেত দিয়ে মারায় হেড স্যারকে উচিত শিক্ষা দিতে প্রাইমারি স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে মা-বাবার কাছে এসে চোখ আর নাকের পানি মিশিয়ে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে নালিশ জানালে কারণ জানতে চায়লে তুমুলে ধরা খেতে হয়। ‘পড়া কইতে একটু আইটকা গেছিলাম গা’ শোনাতেই শোধালেন, ‘আইটকা কেন’? প্রত্যত্তরে ‘বেশি পড়ছিলাম না’ বলতেই একাট্টা হয়ে তাঁরা জানতে চায়লেন, ‘কেরে? দোষটা তাইলে কার?’ দু’জনাতে একরত্তি ছাড় না মিলার জেরে ‘আগে নিজেকে চিনো’ দীক্ষা লাভ আজও চলার পাথেয়। একটা করতে গিয়ে দশটা ভাবায়। কোনো পদক্ষেপ বা কাজে অন্যায় কি অসঙ্গতি রয়ে না যায় – বিষয়টি বিবেকের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সায় নিই আগে।

মা- একটি মাত্র অক্ষর। কিন্তু বিশালতা অসীম এবং গভীরতা অতল। পৃথিবীর তাবৎ শব্দ দলা করেও এর ধারেকাছেও যাবে না। সৃষ্টিকর্তার পর যে ডাকটি বুকের ভিতর এক অদ্ভুত শান্তি লাগে, তা হলো ‘মা’। মা’র চাইতে সমধুর ডাক পৃথিবীতে আর নেই। মানবজাতি তাই প্রিয় স্বদেশকেই কেবল মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ভীষণ আরাধ্যা একজন হয়ে তোমার জন্যই আজকের আমি। তোমাতে মা গর্বিত আমি। কী শীতল, স্নিগ্ধ ও শান্তির ছায়াটিই না হারিয়েছি; যেখানে স্বার্থের ঘোর টোপ ছিল না। মায়ের ঋণ আমৃত্যু শোধ হবার নয়। মায়ের সম্মানের ব্যাপ্তী সম্পর্কে ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সন্তানের উত্তম ও শ্রদ্ধা পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকারী হচ্ছেন মা।’  তিনি আরও বলেছেন, ‘মাযের পদতলে সন্তানের বেহেশত্।’

মাগো …  /তুমি এসেছো তাই /আলোকিত হয়েছে এ ভুবন, /জন্মেছি আমি তোমার কোলে /ধন্য হয়েছে জীবন। /শত জনমেও তোমাকেই /যেনো বারবার ফিরে পাই, /পরকালেও আমি শুধু / মা – তোমাকেই চাই।’

মা-কে আম্মা ডাকতাম। বাবাকে আব্বা। মা আমার জান্নাত। বাবাও। ইসলাম ধর্মের মহানবীকে (সা.) চতুর্থবার জিজ্ঞাসায় ‘মা-বাবার পদতলে সন্তানের বেহেশত্’ ঘোষণা করেছেন।

মা তুঝে তসলিম। বাবাকেও। শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে ঋণ শোধবার নয়। প্রার্থনা কেবল – ‘হে আমার প্রভু, আপনি তাঁদের (মাতা-পিতা) প্রতি দয়া করুন; যেমনিভাবে তাঁরা আমাদের প্রতি দয়া করতেন।’

পরিশেষে প্রতিটি মা-বাবাকে তোমার দিদার (সন্তুষ্টি) লাভ করাইও এবং অধিষ্ঠিত করাইও সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

মা তুঝে তসলিম, মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অশ্বত্থ

আপডেট টাইম : ০৪:১১:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১

রফিকুল ইসলামঃ ‘আমি ভীষণ ভালোবাসতাম মা-কে /কখনো মুখ ফুটে বলিনি। /আমার ভালোবাসার কথা /মা-কে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি। /কেমন করে তোমাকে আমি বলি… ‘

মায়ের প্রথম বার্ষিকী আজ। গতবছর ২ অক্টোবর পরলোক গমন করেছেন। কবর দেওয়া পর্যন্ত ভেঙে পরিনি এতটুকুও, না বিচলিত; কাঁদিনি। বরং অন্যদের বারণ করে চলেছি ভাই-বোনসহ সবাই শিয়রে যখন অঝোরে বুকফাটা কান্না করছিল। কী নিষ্ঠুর আমি! চোখে কোণে পানি নেই। কান্নায় বাতাস ভারি করিনি। উল্টো কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। বড়দের উপরও ছিল খবরদারি। সূরা ইয়াছিনসহ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের এক অঘোষিত হুকুম চালিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী মমতাময়ী মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর নিরন্তর চেষ্টা ছিল আমার, যেন মহামন্ত্রজ্ঞ পবিত্র কালিমা নসিব হয়।

জন্মের মৃত্যু অবিনশ্বর জেনেও প্রেক্ষাপট নিয়ে সন্দিহানে পেয়ে বসে বিচ্ছিন্ন ভাবনা। পারিবারিক কবরস্থান, যেখানে বাবা শায়িত; তা বর্ষায় হাওরের অথৈ জলরাশীর তলে। শরিয়তের দৃষ্টিতে মানবজাতির সৃষ্টিলগ্নেই নির্ধারিত থাকে ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু ও কবরস্থান। নিয়তিতে বাবার সাথে কবর স্থিরীকৃত থাকলে তো বর্ষা মৌসুমে মারা যাবার কথা নয়। মনে আশা জাগে বাবার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতকে ঘিরে। বাবার মৃত্যুকালীন শয়নশিয়র উত্তরমুখীর করার পরও প্রাণ পেয়ে সুস্থ শরীরে সকলের মাঝে বেঁচে ছিলেন বর্ষা মৌসুম হতে শুকনা মৌসুম পর্যন্ত। বাধভাঙা বিচ্ছিন্ন ভাবনা আছড়ে পড়ে মন ভারি করে তুলে।

Screenshot_20211001-152352_Gmail
‘বড়বাড়ি’ খ্যত (নানার বাড়ি) কবরস্থানটি জাগানো। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের বদান্যতায় মিঠামইনের ধলাই-বগাদিয়া বাগে জান্নাত কবরস্থানের সাথে সংযুক্তিতে উঁচু করে মাটি ফেলায় জলরাশীর ওপর জেগে রয়েছে ভাবতেই শঙ্কা ঝেঁকে বসে। মা’র ক্ষেত্রে ভিন্নতা হলো তো মা-কে হারাবো। তাহলে কি মা নশ্বর আর থাকছে না! আজ তো জুম্মাবার। মানে শুক্রবার। ধর্মে দিনটি বরকতময়। ওইদিন কেউ মারা গেলে গোরাযাব বা কবরের শাস্তি হয় না – মনে উদয় হতেই নির্দয়ভাবে মায়ের মৃত্যু কামনা করেছি সেদিন।

হৃদরোগে আক্রান্ত শ্বাশুড়ির অবনতির সংবাদে যেতে হয়েছিল। ছুটে আসতে হলো মায়ের ‘জওয়াব বদ্ধ’ খবরে। এসে শুনি আমাদের নাম ধরে জানতে চেয়েছেন ফিরেছি কি না। ডাক দিতেই ‘তোরা আইছত পুত? খাইছত নি?’- সম্বিত ফিরে পেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জীবনসায়াহ্নেও আমাদের ছুঁয়ে সুখ নেবার কি যে ব্যাকুলতা! এটা তাঁর সহজাত ও মজ্জাগত চেতনা। নিজের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তুচ্ছ করে সন্তানদের মুখের হাসি দেখতে চেয়েছেন। কেবল ক্লান্তিহীনভাবে দিতেই জেনেছেন, নেবার প্রত্যাশা করেননি। ছিলাম আদরের, মমতার, সাত রাজার ধন। কত সাধনায়, কত যত্নে লালন-পালন করেছেন। মায়ের শরীরের অংশ নয় শুধু, পুরো হৃদয় জুড়েই ছিলাম। সমস্ত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুখ দুঃখ দূরে সরিয়ে অহর্নিশি সন্তানদের মঙ্গল কামনায় কাটিয়েছেন প্রতিটা মুহূর্ত। একমাত্র সন্তানদের ঘিরেই ছিল দিনযাপন, স্বপ্ন, আনন্দ। জায়নামাজে দু’হাত তুলে নিরন্তর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় সাফল্য কামনায় নিমগ্ন থেকেছেন। ভালোটা নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছেন। সন্তানদের মুখপানে তাকিয়ে নিজের শত বেদনা সয়েছেন, কত না কষ্ট, যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা আর কতই না অশ্রু সঙ্গোপনে আড়াল করে রেখেছেন। নিজেকে নিঃশেষ করে সন্তানদের পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন। তাঁর সমস্ত বিসর্জন সন্তানদের মানুষ করার পেছনে। আমাদের সমস্ত অর্জন কেবই তাঁর একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, বিসর্জনের ফলশ্রুতিতে। বাবার অপূর্ণ ভালোবাসা ভরিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয়ের প্রত্যাশা; মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা।

১৯৮৮ সালেই বাবাকে হারিয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবারে মায়ের আঁচল ছিল মজবুত গিঁট। আসুরিক শ্যেনদৃষ্টি, বিভীষণ বন্ধুর পথ ডিঙিয়ে আমাদের সকলকে আজকের এই প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে দাঁড় করানোর পথ মসৃণ ছিল না বলেই বীরাঙ্গনা। মা হিসেবে সার্থক। রিপোর্টিংয়ে ক্রাইম এবং পরবর্তীতে পার্লামেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল বিট করতাম বলে আতঙ্ক কাটতো না মায়ের। আমার দুটি কলাম ‘দেশচিন্তা’ ও ‘তথ্যতরঙ্গ’ কলাম দুটি বন্ধ করে দেবার উপর্যুপরি হুমকিতে মায়ের আঁচল থেকে শক্তি সঞ্চয়ে গর্জে উঠে কলাম লিখেছিলাম – ‘হুমকি নয়, আনতে হবে রাঙা প্রভাত’। আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-যন্ত্রণা আর স্বপ্নরাজ্যের যত সুখ অনুভূতির আলোড়ন সবই যাকে ঘিরে; তাঁকেই কি না একলা ফেলে যাচ্ছি! ভাবনাতে সৃষ্ট চাপা কান্নার প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাধীনে থেকে আজও শরীর পুনরুদ্ধার হয়নি।

মায়ের মৃত্যু হয়েছে বার্ধক্যজনিত কারণে। তবে, কোমড়ের একপাশের বাটি ভেঙে পরায় প্রায় ছয় বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। ঢাকাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ও পরামর্শে অপারেশনে যাওয়া হয়নি। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে খোলামেলা পরিসরে থাকতে বাচ্চাদের মতো উপর্যুপরি আবদারে পরিত্যক্ত সংস্কার করা একটি হাফ বিল্ডিংয়ে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও রাতে? দেখাশোনা, হুট-ফরমায়েশ ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কি হবে? সেবার সহযোগিতায় একত্রে রাত্রিযাপন শুরু হয় আমাকে দিয়ে। পরে ভাইয়াচারীরা যার যার কর্মস্থল ও অবস্থানের সুবিধা মতে পালাক্রমে প্রাণান্ত সেবা দিয়ে গেছেন। বাকিসময় বউচারীরা। যারা চাকরি করতেন, সময় ভাগাভাগি করে নিতেন। যে মা মাথার কাপড়টুকুও ফেলতেন না আমার সামনে, তিনি অবশেষে প্রকৃতির ডাকে পানি খরচের সেবাটিও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন শিশুটির মতো, নেহায়েত অপারগতায়। এ ছিল বিরল সুযোগ, যা অনেকের ভাগ্যেই জুটে না।

মা-বাবার কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। তাঁদের আদর আর শাসন এক হয়ে যেতো। শৈশবে কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত গন্ডগোল বাধিয়ে বাড়ি ফিরলে প্রথমেই তোপের মুখে পরতে হতো ‘আগে তুই কী করেছিলি’ প্রশ্নবাণে। আদুরী সাজার পরিমণামও ছিল পাঙক্তেয়, যার বুমেরাং ভুলবার নয়। বেত দিয়ে মারায় হেড স্যারকে উচিত শিক্ষা দিতে প্রাইমারি স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে মা-বাবার কাছে এসে চোখ আর নাকের পানি মিশিয়ে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে নালিশ জানালে কারণ জানতে চায়লে তুমুলে ধরা খেতে হয়। ‘পড়া কইতে একটু আইটকা গেছিলাম গা’ শোনাতেই শোধালেন, ‘আইটকা কেন’? প্রত্যত্তরে ‘বেশি পড়ছিলাম না’ বলতেই একাট্টা হয়ে তাঁরা জানতে চায়লেন, ‘কেরে? দোষটা তাইলে কার?’ দু’জনাতে একরত্তি ছাড় না মিলার জেরে ‘আগে নিজেকে চিনো’ দীক্ষা লাভ আজও চলার পাথেয়। একটা করতে গিয়ে দশটা ভাবায়। কোনো পদক্ষেপ বা কাজে অন্যায় কি অসঙ্গতি রয়ে না যায় – বিষয়টি বিবেকের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সায় নিই আগে।

মা- একটি মাত্র অক্ষর। কিন্তু বিশালতা অসীম এবং গভীরতা অতল। পৃথিবীর তাবৎ শব্দ দলা করেও এর ধারেকাছেও যাবে না। সৃষ্টিকর্তার পর যে ডাকটি বুকের ভিতর এক অদ্ভুত শান্তি লাগে, তা হলো ‘মা’। মা’র চাইতে সমধুর ডাক পৃথিবীতে আর নেই। মানবজাতি তাই প্রিয় স্বদেশকেই কেবল মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ভীষণ আরাধ্যা একজন হয়ে তোমার জন্যই আজকের আমি। তোমাতে মা গর্বিত আমি। কী শীতল, স্নিগ্ধ ও শান্তির ছায়াটিই না হারিয়েছি; যেখানে স্বার্থের ঘোর টোপ ছিল না। মায়ের ঋণ আমৃত্যু শোধ হবার নয়। মায়ের সম্মানের ব্যাপ্তী সম্পর্কে ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সন্তানের উত্তম ও শ্রদ্ধা পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকারী হচ্ছেন মা।’  তিনি আরও বলেছেন, ‘মাযের পদতলে সন্তানের বেহেশত্।’

মাগো …  /তুমি এসেছো তাই /আলোকিত হয়েছে এ ভুবন, /জন্মেছি আমি তোমার কোলে /ধন্য হয়েছে জীবন। /শত জনমেও তোমাকেই /যেনো বারবার ফিরে পাই, /পরকালেও আমি শুধু / মা – তোমাকেই চাই।’

মা-কে আম্মা ডাকতাম। বাবাকে আব্বা। মা আমার জান্নাত। বাবাও। ইসলাম ধর্মের মহানবীকে (সা.) চতুর্থবার জিজ্ঞাসায় ‘মা-বাবার পদতলে সন্তানের বেহেশত্’ ঘোষণা করেছেন।

মা তুঝে তসলিম। বাবাকেও। শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে ঋণ শোধবার নয়। প্রার্থনা কেবল – ‘হে আমার প্রভু, আপনি তাঁদের (মাতা-পিতা) প্রতি দয়া করুন; যেমনিভাবে তাঁরা আমাদের প্রতি দয়া করতেন।’

পরিশেষে প্রতিটি মা-বাবাকে তোমার দিদার (সন্তুষ্টি) লাভ করাইও এবং অধিষ্ঠিত করাইও সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।