ঢাকা ১১:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বার্ধক্য হোক শান্তি ও স্বস্তিময়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১৪:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অক্টোবর ২০২১
  • ২১৭ বার
অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেনঃ “আগের বাহাদুরী এখন গেলো কই/চলিতে চরণ চলেনা দিনে দিনে অবশ হই” বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের বিখ্যাত একটি গানের চরণ যা আমাদেরকে জীবনের গতি প্রবাহের একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অর্থাৎ বার্ধক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বার্ধক্য জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য। মৃত্যুর মত বার্ধক্যও জীবনের এক অনিবার্য অবস্থা, চরম বাস্তবতা। কৈশোর, তারুণ্য, যুব বয়স পেরিয়ে বার্ধক্য মানব জীবনের এক অলংঘনীয় সত্য। বর্তমান বিশ্বের সামাজিক সমস্যার তালিকায় একটি উদ্বেগজনক সংযোজন হচ্ছে বয়স্ক সমস্যা। পরিবার কাঠামোর পরিবর্তন ঘটায় চিরাচরিত ঐতিহ্যগত নিয়মে এখন আগের মত পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের বাড়তি চাহিদা পূরণ ও সেবাদান সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। ক্ষয়িষ্ণ শরীর কাঠামো, রোগ—শোক, আন্তরিক ও ইনফরমাল সামাজিক সম্পর্কের অনুপস্থিতি, একক পরিবারের প্রাধান্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের নিরাপত্তাহীনতা বয়স্ক সমস্যাকে জটিলতর করে তুলেছে। সন্তানকে বড় করাসহ সারাজীবন পরিবারের দায়িত্ব পালন করার পর প্রত্যেক মা—বাবাই চান শেষ বয়সটা অন্তত নিশ্চিন্তে কাটাবেন। সন্তানেরা পরিবারের হাল ধরবে, বয়স্ক মা—বাবার সেবা করবে, এটি তো আমাদের সামাজিক নৈতিকতা ও পারিবারিক দায়বোধেরই অংশ। প্রতিটি ধর্মেও মা—বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি হতে পারছি তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়?
জনসংখ্যাবিদেরা বয়সের কারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর হারকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো দেশ বা সমাজকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করার চেষ্টা করেন। মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে সেটি তাদের দৃষ্টিতে প্রবীণপ্রবণ সমাজ (এজিং সোসাইটি)। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা তার বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণপ্রধান সমাজ (এজড সোসাইটি) । দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হওয়ার আভাস দিয়েছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশ প্রবীণপ্রবণ সমাজে পদার্পন করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে আস্তে আস্তে প্রবীণপ্রধান সমাজ পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর।  ৫০ বছরে সেই আয়ু বেড়েছে ২৪ বছরেরও বেশী। একই সময়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১২ বছর। অন্য কথায়, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৈশ্বিক বৃদ্ধির দ্বিগুণ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে মালদ্বীপের মানুষ। তাদের গড় আয়ু ৭৬ বছর। ১৯৭১ সালে ছিল ৪৪ বছর। অর্থাৎ ৫০ বছরে দেশটির গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। এই অঞ্চলে দ্বিতীয় সবোর্চ্চ গড় আয়ুর দেশ শ্রীলঙ্কা (৭৪ বছর)। ১৯৭১ সালে এই অঞ্চলে গড় আয়ুতে প্রথম ছিল শ্রীলঙ্কা (৬৪ বছর)। ’৭১ —এর তুললনায় ভুটানের গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খবর দিয়েছে, বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর । বাংলাদেশে ৬০ (ষাট) বছর এবং তদুর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল ষ্ট্যাটিসটিকস ২০২০ অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ, যার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ষাটোর্ধ্বে। সে হিসাবে ১ কোটি ৪০ লাখ ৩৬ হাজার ১৩০ জন সরকারি বিবেচনায় সিনিয়র সিটিজেন।
 দ্রুত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর হার বেড়ে যাওয়ার কিছু অসুবিধার কথাও বলছে ইউনিসেফ। ২০২০ সালে কর্মক্ষম ১৩ জন মানুষের উপার্জনের ওপর একজন প্রবীণ মানুষ নির্ভরশীল থাকতে দেখা গেছে। ২০৪০ সালে ছয়জন কর্মক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল থাকবে একজন প্রবীণ। অর্থাৎ কর্মক্ষম ও প্রবীণ জনসংখ্যার অনুপাত ক্রমশ কমতে থাকবে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এও বলা হয়েছে, জনমিতিক পরিবর্তন যুব জনগোষ্ঠীর কাজ পাওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতে পারে। প্রবীণদের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা না থাকলেও তাঁদের ভরণ—পোষণ ও স্বাস্থ্যসেবার ভার নিতে গিয়ে অর্থনীতি হিমশিম খায়।এ জন্য জরুরিভাবে এদের জন্য নীতিগত মনোযোগ দরকার। একইভাবে ক্রমর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও সুযোগ—সুবিধার বিষয়ে নীতিগত মনোযোগ বাড়াতে হবে।
সুষম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএ) তৃতীয় উদ্দেশ্যে পরিস্কারভাবে সকল মানুষ এবং সকল বয়সী মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ এর বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হয়েছেন। উক্ত সনদের অন্যতম স্বাক্ষর দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করেছেন। এ নীতিমালায় প্রবীণ জীবনের প্রায় সব ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং এর প্রতিকারের দিকনির্দেশনা রয়েছে। পরিবার—পরিজন বেষ্টিত হয়ে থাকতেই প্রবীণরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রবীণ ব্যক্তিরা পরিবারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে বিশেষ করে শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে এ তথ্য উঠে এসেছে বিখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেটে’। ২০২০ সালের একটি গবেষণা কর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে জার্নালটি  বলছে শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে দাদা—দাদি, নানা—নানীদের গুরুত্ব অনেক বেশি। দাদা—দাদি, নানা—নানিরা শিশুদের সঙ্গে থাকেন, সারা বিশে^ এমন পরিবার ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়াতে এমন পরিবার ৫০ শতাংশ। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ৪০% শিশুর ক্ষেত্রে দাদা—দাদি, নানা—নানি প্রত্যক্ষ পরিচর্যাকারি। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়। মাতা—পিতা ভরণপোষণ আইন (২০১৩) পাস হয়েছে। সরকার ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল অনুমোদন করে। সবক্ষেত্রে সহনশীলতার বিকাশ ও চর্চাকে উৎসাহিত করা এই শুদ্ধাচার নীতি—কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য। এতে পরিবার থেকে নৈতিকতার চর্চা, তথা মানুষকে অবহেলা, অবজ্ঞা না করার শিক্ষা ও তার অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বারবার।
মানব জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা হলো বার্ধক্য। প্রবীণরা তাদের সারা জীবন পার করেছেন পরিবার—পরিজন, সন্তান—সন্তুতি ও সমাজের মঙ্গল কামনায়। সবোর্পরি দেশের জন্য রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান, অর্থনীতি বিনির্মাণে তাদের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। তাই বৃদ্ধ বয়সে তাদের এই ত্যাগের মূল্য আমাদের অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত। আর তা  পরিশোধের অন্যতম উপায় হল তাদের বার্ধক্যকে সহজতর করে তোলা। একটি সুস্থ, সুন্দর ও প্রবীণবান্ধব সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা। যারা ইতোমধ্যেই পরিবারহারা হয়ে গিয়েছেন, নিঃসন্তান অথবা সন্তানরা এলাকার বাইরে, প্রবাসে থাকেন তাদেরকে ডে—কেয়ার সেন্টার, শিশু নিবাস এর সাথে যুক্থ করা যেতে পারে। প্রবীণদের জন্য প্রবীণ ক্লাব, ডে—কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রবীণরা সাধারণত বেশি মাত্রায় রোগে শোকে ভোগেন তাই কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে শিশু, মাতৃ—স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি প্রবীণদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনেকেই আয়—রোজগারহীন হয়ে পড়েন সরকারি ভাতা তারা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। অনেকে সেবা করার মত কেয়ারগিভার পাননা সেক্ষেত্রে সরকারি—বেসরকারি উদ্যোগে সেবা প্রদান ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। সুস্থ—সবল যারা আছেন তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কানাডাতে দেখেছি প্রবীণরা স্কুলের পাশে রাস্তার ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে যাতে ছোট ছোট স্কুল ছাত্ররা নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যাল পর্যায়ের পরীক্ষায় ইনিভিজিলেটর এর দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। তাদের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাকে এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজে লাগাতে পারে।
সর্বোপরি নতুন প্রজন্ম যাতে প্রবীণদের সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে সে সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে প্রবীণ বিষয়ক প্রবন্ধ যুক্ত করা যেতে পারে। বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে প্রবীণদের সমস্যাগুলো ভিন্ন তাই এক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ, অরিয়েন্টেশন সভা, সেমিনারের মাধ্যমে বার্ধক্য মোকাবেলার কৌশলগুলো প্রচার করা যেতে পারে। আমরা জানি যে কোন দুর্যোগে প্রবীণ এবং শিশুরা সর্বাগ্রে এবং সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে কোভিডকালীন এই দুর্যোগে আমরা দেখেছি অনেক জায়গাতেই প্রবীণদের ক্ষেত্রে সমাজ এমনকি পরিবার সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে যা পত্রপত্রিকায় এসেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা সবাই দিনে দিনে বার্ধক্যের দিকে এগুচ্ছি। মনে রাখতে হবে আমাকেও একদিন এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাই আমার দ্বারা যেন কোনো প্রবীণদের অমর্যাদা না হয় সে ব্যাপারে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। উন্নয়নের পাশ^র্ প্রতিক্রিয়ায় আমাদের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে, সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার কাছে আমরা অনেকটাই পরাস্ত। মানবিকতা, নীতি—নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আজ ভয়ংকরভাবে প্রশ্নের সম্মুখিন। এ অবস্থায় অনেক পরিবারই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজ তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। নোবেলজয়ী আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ৬১ বছর বয়সে ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তম পুরুষে লেখা এই কবিতায় একটি কল্পিত বৃদ্ধ চরিত্রের মধ্য দিযে ইয়েটস বলেছিলেন, “তার নিজের দেশ তরুণ প্রজন্মের দাবি ও সমস্যা নিরসনে অতিশয় ব্যস্ত এবং তারা ভোগবিলাসী, যৌবন উন্মাদনায় মোহগ্রস্ত। যেহেতু তার দেশে সম্মানিত প্রবীণেরা উপেক্ষিত ও অবহেলিত, সেহেতু সে দেশে তিন আর থাকতে চান না। সে কারনে তিনি ‘বাইজন্টিয়াম’ (আজকের ইস্তাম্বুল) নগরে পাড়ি জমাচ্ছেন, যেখানে বৃ্দ্ধরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পান।” সকল বয়সী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, এক সাগর রক্ত এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রবীণ প্রজন্মের মধ্যে এ ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হোক তা আমরা কখনই চাইতে পারিনা। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক,
অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন,
সমাজকর্ম বিভাগ
    ও
পরিচালক
সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বার্ধক্য হোক শান্তি ও স্বস্তিময়

আপডেট টাইম : ০৪:১৪:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অক্টোবর ২০২১
অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেনঃ “আগের বাহাদুরী এখন গেলো কই/চলিতে চরণ চলেনা দিনে দিনে অবশ হই” বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের বিখ্যাত একটি গানের চরণ যা আমাদেরকে জীবনের গতি প্রবাহের একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অর্থাৎ বার্ধক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বার্ধক্য জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য। মৃত্যুর মত বার্ধক্যও জীবনের এক অনিবার্য অবস্থা, চরম বাস্তবতা। কৈশোর, তারুণ্য, যুব বয়স পেরিয়ে বার্ধক্য মানব জীবনের এক অলংঘনীয় সত্য। বর্তমান বিশ্বের সামাজিক সমস্যার তালিকায় একটি উদ্বেগজনক সংযোজন হচ্ছে বয়স্ক সমস্যা। পরিবার কাঠামোর পরিবর্তন ঘটায় চিরাচরিত ঐতিহ্যগত নিয়মে এখন আগের মত পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের বাড়তি চাহিদা পূরণ ও সেবাদান সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। ক্ষয়িষ্ণ শরীর কাঠামো, রোগ—শোক, আন্তরিক ও ইনফরমাল সামাজিক সম্পর্কের অনুপস্থিতি, একক পরিবারের প্রাধান্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের নিরাপত্তাহীনতা বয়স্ক সমস্যাকে জটিলতর করে তুলেছে। সন্তানকে বড় করাসহ সারাজীবন পরিবারের দায়িত্ব পালন করার পর প্রত্যেক মা—বাবাই চান শেষ বয়সটা অন্তত নিশ্চিন্তে কাটাবেন। সন্তানেরা পরিবারের হাল ধরবে, বয়স্ক মা—বাবার সেবা করবে, এটি তো আমাদের সামাজিক নৈতিকতা ও পারিবারিক দায়বোধেরই অংশ। প্রতিটি ধর্মেও মা—বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি হতে পারছি তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়?
জনসংখ্যাবিদেরা বয়সের কারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর হারকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো দেশ বা সমাজকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করার চেষ্টা করেন। মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে সেটি তাদের দৃষ্টিতে প্রবীণপ্রবণ সমাজ (এজিং সোসাইটি)। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা তার বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণপ্রধান সমাজ (এজড সোসাইটি) । দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হওয়ার আভাস দিয়েছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশ প্রবীণপ্রবণ সমাজে পদার্পন করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে আস্তে আস্তে প্রবীণপ্রধান সমাজ পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর।  ৫০ বছরে সেই আয়ু বেড়েছে ২৪ বছরেরও বেশী। একই সময়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১২ বছর। অন্য কথায়, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৈশ্বিক বৃদ্ধির দ্বিগুণ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে মালদ্বীপের মানুষ। তাদের গড় আয়ু ৭৬ বছর। ১৯৭১ সালে ছিল ৪৪ বছর। অর্থাৎ ৫০ বছরে দেশটির গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। এই অঞ্চলে দ্বিতীয় সবোর্চ্চ গড় আয়ুর দেশ শ্রীলঙ্কা (৭৪ বছর)। ১৯৭১ সালে এই অঞ্চলে গড় আয়ুতে প্রথম ছিল শ্রীলঙ্কা (৬৪ বছর)। ’৭১ —এর তুললনায় ভুটানের গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খবর দিয়েছে, বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর । বাংলাদেশে ৬০ (ষাট) বছর এবং তদুর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল ষ্ট্যাটিসটিকস ২০২০ অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ, যার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ষাটোর্ধ্বে। সে হিসাবে ১ কোটি ৪০ লাখ ৩৬ হাজার ১৩০ জন সরকারি বিবেচনায় সিনিয়র সিটিজেন।
 দ্রুত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর হার বেড়ে যাওয়ার কিছু অসুবিধার কথাও বলছে ইউনিসেফ। ২০২০ সালে কর্মক্ষম ১৩ জন মানুষের উপার্জনের ওপর একজন প্রবীণ মানুষ নির্ভরশীল থাকতে দেখা গেছে। ২০৪০ সালে ছয়জন কর্মক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল থাকবে একজন প্রবীণ। অর্থাৎ কর্মক্ষম ও প্রবীণ জনসংখ্যার অনুপাত ক্রমশ কমতে থাকবে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এও বলা হয়েছে, জনমিতিক পরিবর্তন যুব জনগোষ্ঠীর কাজ পাওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতে পারে। প্রবীণদের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা না থাকলেও তাঁদের ভরণ—পোষণ ও স্বাস্থ্যসেবার ভার নিতে গিয়ে অর্থনীতি হিমশিম খায়।এ জন্য জরুরিভাবে এদের জন্য নীতিগত মনোযোগ দরকার। একইভাবে ক্রমর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও সুযোগ—সুবিধার বিষয়ে নীতিগত মনোযোগ বাড়াতে হবে।
সুষম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএ) তৃতীয় উদ্দেশ্যে পরিস্কারভাবে সকল মানুষ এবং সকল বয়সী মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ এর বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হয়েছেন। উক্ত সনদের অন্যতম স্বাক্ষর দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করেছেন। এ নীতিমালায় প্রবীণ জীবনের প্রায় সব ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং এর প্রতিকারের দিকনির্দেশনা রয়েছে। পরিবার—পরিজন বেষ্টিত হয়ে থাকতেই প্রবীণরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রবীণ ব্যক্তিরা পরিবারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে বিশেষ করে শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে এ তথ্য উঠে এসেছে বিখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেটে’। ২০২০ সালের একটি গবেষণা কর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে জার্নালটি  বলছে শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে দাদা—দাদি, নানা—নানীদের গুরুত্ব অনেক বেশি। দাদা—দাদি, নানা—নানিরা শিশুদের সঙ্গে থাকেন, সারা বিশে^ এমন পরিবার ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়াতে এমন পরিবার ৫০ শতাংশ। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ৪০% শিশুর ক্ষেত্রে দাদা—দাদি, নানা—নানি প্রত্যক্ষ পরিচর্যাকারি। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়। মাতা—পিতা ভরণপোষণ আইন (২০১৩) পাস হয়েছে। সরকার ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল অনুমোদন করে। সবক্ষেত্রে সহনশীলতার বিকাশ ও চর্চাকে উৎসাহিত করা এই শুদ্ধাচার নীতি—কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য। এতে পরিবার থেকে নৈতিকতার চর্চা, তথা মানুষকে অবহেলা, অবজ্ঞা না করার শিক্ষা ও তার অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বারবার।
মানব জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা হলো বার্ধক্য। প্রবীণরা তাদের সারা জীবন পার করেছেন পরিবার—পরিজন, সন্তান—সন্তুতি ও সমাজের মঙ্গল কামনায়। সবোর্পরি দেশের জন্য রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান, অর্থনীতি বিনির্মাণে তাদের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। তাই বৃদ্ধ বয়সে তাদের এই ত্যাগের মূল্য আমাদের অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত। আর তা  পরিশোধের অন্যতম উপায় হল তাদের বার্ধক্যকে সহজতর করে তোলা। একটি সুস্থ, সুন্দর ও প্রবীণবান্ধব সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা। যারা ইতোমধ্যেই পরিবারহারা হয়ে গিয়েছেন, নিঃসন্তান অথবা সন্তানরা এলাকার বাইরে, প্রবাসে থাকেন তাদেরকে ডে—কেয়ার সেন্টার, শিশু নিবাস এর সাথে যুক্থ করা যেতে পারে। প্রবীণদের জন্য প্রবীণ ক্লাব, ডে—কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রবীণরা সাধারণত বেশি মাত্রায় রোগে শোকে ভোগেন তাই কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে শিশু, মাতৃ—স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি প্রবীণদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনেকেই আয়—রোজগারহীন হয়ে পড়েন সরকারি ভাতা তারা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। অনেকে সেবা করার মত কেয়ারগিভার পাননা সেক্ষেত্রে সরকারি—বেসরকারি উদ্যোগে সেবা প্রদান ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। সুস্থ—সবল যারা আছেন তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কানাডাতে দেখেছি প্রবীণরা স্কুলের পাশে রাস্তার ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে যাতে ছোট ছোট স্কুল ছাত্ররা নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যাল পর্যায়ের পরীক্ষায় ইনিভিজিলেটর এর দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। তাদের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাকে এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজে লাগাতে পারে।
সর্বোপরি নতুন প্রজন্ম যাতে প্রবীণদের সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে সে সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে প্রবীণ বিষয়ক প্রবন্ধ যুক্ত করা যেতে পারে। বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে প্রবীণদের সমস্যাগুলো ভিন্ন তাই এক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ, অরিয়েন্টেশন সভা, সেমিনারের মাধ্যমে বার্ধক্য মোকাবেলার কৌশলগুলো প্রচার করা যেতে পারে। আমরা জানি যে কোন দুর্যোগে প্রবীণ এবং শিশুরা সর্বাগ্রে এবং সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে কোভিডকালীন এই দুর্যোগে আমরা দেখেছি অনেক জায়গাতেই প্রবীণদের ক্ষেত্রে সমাজ এমনকি পরিবার সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে যা পত্রপত্রিকায় এসেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা সবাই দিনে দিনে বার্ধক্যের দিকে এগুচ্ছি। মনে রাখতে হবে আমাকেও একদিন এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাই আমার দ্বারা যেন কোনো প্রবীণদের অমর্যাদা না হয় সে ব্যাপারে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। উন্নয়নের পাশ^র্ প্রতিক্রিয়ায় আমাদের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে, সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার কাছে আমরা অনেকটাই পরাস্ত। মানবিকতা, নীতি—নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আজ ভয়ংকরভাবে প্রশ্নের সম্মুখিন। এ অবস্থায় অনেক পরিবারই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজ তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। নোবেলজয়ী আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ৬১ বছর বয়সে ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তম পুরুষে লেখা এই কবিতায় একটি কল্পিত বৃদ্ধ চরিত্রের মধ্য দিযে ইয়েটস বলেছিলেন, “তার নিজের দেশ তরুণ প্রজন্মের দাবি ও সমস্যা নিরসনে অতিশয় ব্যস্ত এবং তারা ভোগবিলাসী, যৌবন উন্মাদনায় মোহগ্রস্ত। যেহেতু তার দেশে সম্মানিত প্রবীণেরা উপেক্ষিত ও অবহেলিত, সেহেতু সে দেশে তিন আর থাকতে চান না। সে কারনে তিনি ‘বাইজন্টিয়াম’ (আজকের ইস্তাম্বুল) নগরে পাড়ি জমাচ্ছেন, যেখানে বৃ্দ্ধরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পান।” সকল বয়সী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, এক সাগর রক্ত এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রবীণ প্রজন্মের মধ্যে এ ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হোক তা আমরা কখনই চাইতে পারিনা। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক,
অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন,
সমাজকর্ম বিভাগ
    ও
পরিচালক
সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।