ঢাকা ১১:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
ভারতে ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার কবরের পাশে দিন-রাত বসে থাকি, ছেলে ফিরে আসে না সংস্কার না করলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে অন্যায় করা হবে : উপদেষ্টা সাখাওয়াত কাকে ‘ননসেন্স’ বললেন বুবলী ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়সসীমা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আপত্তি বিএনপি মহাসচিবের সচিবালয়ে প্রবেশে অস্থায়ী পাসের ব্যাপারে বিশেষ সেল গঠন জর্জিনাকে ‘স্ত্রী’ সম্বোধন, তবে কি বিয়েটা সেরেই ফেলেছেন রোনালদো ৩১ ডিসেম্বর আসছে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা মহাখালীতে আবাসিক ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২ ইউনিট ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়সসীমা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আপত্তি বিএনপি মহাসচিবের

দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের প্রাচীন স্বর্গ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:১৯:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অগাস্ট ২০২১
  • ১৮০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ মূলত স্পেনীয় নাম। বেশ কিছু আগ্নেয় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। দক্ষিণ আমেরিকা উপকূল থেকে এক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। অসাধারণ সুন্দর গালাপাগোস দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের অন্তর্ভুক্ত।  গালাপাগোসকে বলা হয় জীবন্ত জাদুঘর। কারণ এই দ্বীপপুঞ্জের জলে স্থলে ছড়িয়ে রয়েছে বহু বিরল প্রজাতির প্রাণী। সুদীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এখানকার প্রাণীগুলো সমগ্র পৃথিবী থেকে আলাদা। বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউইন গালাপাগোসে ভ্রমণের কারণে দ্বীপপুঞ্জটি একসময় বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিল।

এই দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছে ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে। গালাপাগোসের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হলো অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর চমকপ্রদ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্ত প্রাণী। শত শত ছোট বড় দ্বীপ এবং সমুদ্রের উপরে জেগে থাকা বড় বড় পাথরের সমন্বয়ে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ গঠিত হয়েছে। ভৌগলিকভাবে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে। এদের একটি হলো এন্টার্কটিকা থেকে আগত হামবোল্ড কারেন্ট আর একটি হলো মধ্য আমেরিকা থেকে আগত পানামা কারেন্ট।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে

বরফ শীতল হামবোল্ড কারেন্টের তীব্র স্রোত বছরের অর্ধেক সময় গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের উপর সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে বছরের বাকি ছয় মাস উষ্ণ স্রোতবিশিষ্ট পানামা কারেন্ট গালাপাগোসের উপর আছড়ে পড়ে। এই দুই ধরনের সামুদ্রিক স্রোত গালাপাগোসের জীববৈচিত্র্যের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।

গালাপাগোসের প্রকৃত দ্বীপ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই দ্বীপপুঞ্জে ১২৭টি দ্বীপ রয়েছে। যাদের মধ্যে মাত্র চারটি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এই দ্বীপপুঞ্জের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো বার্থোলোমে, এস্পানোলা, ফার্নান্দিনো, ইসাবেলা, নর্থ সেমুর, সাউথ প্লাজা, ডারউইন দ্বীপ ইত্যাদি। এসব দ্বীপ একসঙ্গে উৎপন্ন হয়নি।

ডারউইন দ্বীপ

ডারউইন দ্বীপ

এখানকার সবচেয়ে পুরনো দ্বীপগুলো প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে উৎপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে এর তুলনামূলক নতুন দ্বীপগুলোর বয়স প্রায় সাত লাখ বছর। গালাপাগোসের পুরনো দ্বীপগুলো ধীরে ধীরে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন দ্বীপগুলোর উচ্চতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটা ভিনগ্রহের মতো। দ্বীপপুঞ্জটি ইকুয়েডরের একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৫৯ সালে এই দ্বীপপুঞ্জের মাত্র ৩ শতাংশ এলাকায় মানববসতির জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। গালাপাগোসের বাকি ৯৭ শতাংশ অঞ্চল ইকুয়েডরের জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেকারণে গালাপাগোসের দ্বীপগুলো সম্পূর্ণ সংরক্ষিত এলাকা।

অনুমোদিত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। জন উদ্যসিত চারটি দ্বীপের বাইরে আরো একটি দ্বীপে কিছু অবকাঠামো রয়েছে। এখানকার মানববসতিহীন দ্বীপগুলোতে পর্যটন ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৮৬ সালে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের চারদিকে ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সংরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে এই সংরক্ষিত এলাকার আয়তন এক লাখ ৩৩ হাজার বর্গ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম

বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরি এখনো সক্রিয় আছে। বিগত ১০০ বছরে বেশ কয়েকবার অগ্নুৎপাতও হয়েছে। তিনটি টেকটনিক প্লেটের উপর অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত একটি নিয়মিত ঘটনা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ইসাবেলা দ্বীপের সিয়েরা নেগ্রা অংশে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বিষুবরেখা বরাবর অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার দিন আর রাতের দৈর্ঘ্য সমান। এখানে সারাবছর প্রায় ১২ ঘন্টা দিন আর ১২ ঘন্টা রাত থাকে। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে বছরের যেকোনো সময় আরামদায়ক তাপমাত্রা বিরাজ করে এখানকার স্থলভাগের তাপমাত্রা সাধারণত ২৬ থেকে ৩০ ডিগ্রি এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা ২১ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।

সেকারণে সারা বছরই গালাপাগোস ভ্রমণের জন্য ভালো সময়। তবে প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে পর্যটকের চাপ বেশি থাকে। এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়। অধিক পর্যটকের চাপে গালাপাগোসের প্রাকৃতিক পরিবেশ যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেজন্য পর্যটকের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়

এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়

প্রতি বছর মাত্র ৭৯ হাজার পর্যটক এই গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সুযোগ পায়। গালাপাগোসে ঘুরে বেড়ানোর সময় যেকোনো প্রাণী থেকে কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। অনন্য সাধারণ জীব বৈচিত্র্যের কারণে ১৯৭৮ সালে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কো কর্তৃক মনোনীত এটি সর্বপ্রথম বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের অন্যতম। প্রবাল থেকে হাঙ্গর, পেঙ্গুইন থেকে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী কোনটিই বাদ নেই। সামুদ্রিক প্রাণীর এমন বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এই সব নানা বৈচিত্র্যের প্রাণীর কারণে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের খ্যাতি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। কারণ এখানকার বৈচিত্র্যময় বিরল প্রজাতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডারউইন প্রথমবারের মতো বিবর্তনের পক্ষে ধারণা পেতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এখান থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু আলামতের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের অবতারণা করেন।

চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে

চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে

বর্তমানে এই সব দ্বীপে বহু বিলুপ্ত প্রাণী আছে। যাদেরকে গালাপাগোসের বাইরে অন্য কোথাও দেখা যায় না। গালাপাগোসের দৈত্যাকার কচ্ছপ এখানকার প্রাণী বৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ। এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে। এরা প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সেকারণে এদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের ওজন প্রায় ২২৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে

এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে

গালাপাগোস পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ। এখানে প্রায় ৫৬ প্রজাতির পাখি আছে। যাদের মধ্যে ৪৫ প্রজাতির পাখি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের পেঙ্গুইন হলো পৃথিবীর সর্ব উত্তরে বসবাসকারী পেঙ্গুইন। ধারণা করা হয়, অতীতে হামবোল্ড কারেন্টের সাথে এন্টার্কটিকা থেকে এই প্রাণীগুলো গালাপাগোসে এসে পৌঁছে ছিল।

পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। হামবোল্ড কারেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ছোট থেকে বড় অসংখ্য প্রকারের মাছ এখানে আসে। এছাড়া গালাপাগোসে প্রায় ৮০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা। এরা টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। একাধিক প্রজাতির ইগুয়ানা এখানে দেখা যায়। তাদের মধ্যে মেরিন ইগুয়ানা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এরাই একমাত্র টিকটিকি, যারা পানির নিচে প্রায় ৩০ মিনিট ডুবে থাকতে পারে। ইগুয়ানা আকারে বেশ বড় হলেও এগুলোই সবচেয়ে বড় টিকটিকি নয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকটিকি জাতীয় প্রাণী হলো কোমোডো ড্রাগন। একটি কোমোডো ড্রাগন সাধারণত আট থেকে দশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা মারাত্মক হিংস্র এবং বিষাক্ত মাংসাশী প্রাণী। ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো দ্বীপসহ মাত্র পাঁচটি দ্বীপে এই প্রাণীদেরকে দেখা যায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ভারতে ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার

দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের প্রাচীন স্বর্গ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ

আপডেট টাইম : ০৭:১৯:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অগাস্ট ২০২১

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ মূলত স্পেনীয় নাম। বেশ কিছু আগ্নেয় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। দক্ষিণ আমেরিকা উপকূল থেকে এক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। অসাধারণ সুন্দর গালাপাগোস দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের অন্তর্ভুক্ত।  গালাপাগোসকে বলা হয় জীবন্ত জাদুঘর। কারণ এই দ্বীপপুঞ্জের জলে স্থলে ছড়িয়ে রয়েছে বহু বিরল প্রজাতির প্রাণী। সুদীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এখানকার প্রাণীগুলো সমগ্র পৃথিবী থেকে আলাদা। বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউইন গালাপাগোসে ভ্রমণের কারণে দ্বীপপুঞ্জটি একসময় বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিল।

এই দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছে ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে। গালাপাগোসের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হলো অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর চমকপ্রদ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্ত প্রাণী। শত শত ছোট বড় দ্বীপ এবং সমুদ্রের উপরে জেগে থাকা বড় বড় পাথরের সমন্বয়ে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ গঠিত হয়েছে। ভৌগলিকভাবে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে। এদের একটি হলো এন্টার্কটিকা থেকে আগত হামবোল্ড কারেন্ট আর একটি হলো মধ্য আমেরিকা থেকে আগত পানামা কারেন্ট।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়ে

বরফ শীতল হামবোল্ড কারেন্টের তীব্র স্রোত বছরের অর্ধেক সময় গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের উপর সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে বছরের বাকি ছয় মাস উষ্ণ স্রোতবিশিষ্ট পানামা কারেন্ট গালাপাগোসের উপর আছড়ে পড়ে। এই দুই ধরনের সামুদ্রিক স্রোত গালাপাগোসের জীববৈচিত্র্যের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।

গালাপাগোসের প্রকৃত দ্বীপ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই দ্বীপপুঞ্জে ১২৭টি দ্বীপ রয়েছে। যাদের মধ্যে মাত্র চারটি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এই দ্বীপপুঞ্জের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো বার্থোলোমে, এস্পানোলা, ফার্নান্দিনো, ইসাবেলা, নর্থ সেমুর, সাউথ প্লাজা, ডারউইন দ্বীপ ইত্যাদি। এসব দ্বীপ একসঙ্গে উৎপন্ন হয়নি।

ডারউইন দ্বীপ

ডারউইন দ্বীপ

এখানকার সবচেয়ে পুরনো দ্বীপগুলো প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে উৎপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে এর তুলনামূলক নতুন দ্বীপগুলোর বয়স প্রায় সাত লাখ বছর। গালাপাগোসের পুরনো দ্বীপগুলো ধীরে ধীরে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন দ্বীপগুলোর উচ্চতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটা ভিনগ্রহের মতো। দ্বীপপুঞ্জটি ইকুয়েডরের একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৫৯ সালে এই দ্বীপপুঞ্জের মাত্র ৩ শতাংশ এলাকায় মানববসতির জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। গালাপাগোসের বাকি ৯৭ শতাংশ অঞ্চল ইকুয়েডরের জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেকারণে গালাপাগোসের দ্বীপগুলো সম্পূর্ণ সংরক্ষিত এলাকা।

অনুমোদিত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। জন উদ্যসিত চারটি দ্বীপের বাইরে আরো একটি দ্বীপে কিছু অবকাঠামো রয়েছে। এখানকার মানববসতিহীন দ্বীপগুলোতে পর্যটন ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৮৬ সালে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের চারদিকে ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সংরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে এই সংরক্ষিত এলাকার আয়তন এক লাখ ৩৩ হাজার বর্গ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম

বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরিন রিজার্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরি এখনো সক্রিয় আছে। বিগত ১০০ বছরে বেশ কয়েকবার অগ্নুৎপাতও হয়েছে। তিনটি টেকটনিক প্লেটের উপর অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত একটি নিয়মিত ঘটনা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ইসাবেলা দ্বীপের সিয়েরা নেগ্রা অংশে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বিষুবরেখা বরাবর অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার দিন আর রাতের দৈর্ঘ্য সমান। এখানে সারাবছর প্রায় ১২ ঘন্টা দিন আর ১২ ঘন্টা রাত থাকে। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে বছরের যেকোনো সময় আরামদায়ক তাপমাত্রা বিরাজ করে এখানকার স্থলভাগের তাপমাত্রা সাধারণত ২৬ থেকে ৩০ ডিগ্রি এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা ২১ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।

সেকারণে সারা বছরই গালাপাগোস ভ্রমণের জন্য ভালো সময়। তবে প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে পর্যটকের চাপ বেশি থাকে। এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়। অধিক পর্যটকের চাপে গালাপাগোসের প্রাকৃতিক পরিবেশ যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেজন্য পর্যটকের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়

এখানে ঘুরতে আসা সিংহভাগ পর্যটকদের জাহাজেই অবস্থান করতে হয়

প্রতি বছর মাত্র ৭৯ হাজার পর্যটক এই গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সুযোগ পায়। গালাপাগোসে ঘুরে বেড়ানোর সময় যেকোনো প্রাণী থেকে কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। অনন্য সাধারণ জীব বৈচিত্র্যের কারণে ১৯৭৮ সালে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কো কর্তৃক মনোনীত এটি সর্বপ্রথম বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের অন্যতম। প্রবাল থেকে হাঙ্গর, পেঙ্গুইন থেকে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী কোনটিই বাদ নেই। সামুদ্রিক প্রাণীর এমন বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এই সব নানা বৈচিত্র্যের প্রাণীর কারণে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের খ্যাতি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। কারণ এখানকার বৈচিত্র্যময় বিরল প্রজাতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডারউইন প্রথমবারের মতো বিবর্তনের পক্ষে ধারণা পেতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এখান থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু আলামতের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের অবতারণা করেন।

চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে

চার্লস ডারউইনের আগমনের পর থেকে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে

বর্তমানে এই সব দ্বীপে বহু বিলুপ্ত প্রাণী আছে। যাদেরকে গালাপাগোসের বাইরে অন্য কোথাও দেখা যায় না। গালাপাগোসের দৈত্যাকার কচ্ছপ এখানকার প্রাণী বৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ। এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে। এরা প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সেকারণে এদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের ওজন প্রায় ২২৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে

এই দৈত্যাকার কচ্ছপ থেকেই গালাপাগোস নামটি এসেছে

গালাপাগোস পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ। এখানে প্রায় ৫৬ প্রজাতির পাখি আছে। যাদের মধ্যে ৪৫ প্রজাতির পাখি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের পেঙ্গুইন হলো পৃথিবীর সর্ব উত্তরে বসবাসকারী পেঙ্গুইন। ধারণা করা হয়, অতীতে হামবোল্ড কারেন্টের সাথে এন্টার্কটিকা থেকে এই প্রাণীগুলো গালাপাগোসে এসে পৌঁছে ছিল।

পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। হামবোল্ড কারেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ছোট থেকে বড় অসংখ্য প্রকারের মাছ এখানে আসে। এছাড়া গালাপাগোসে প্রায় ৮০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা

গালাপাগোসের আরেকটি বিশেষ প্রাণী হলো ইগুয়ানা। এরা টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। একাধিক প্রজাতির ইগুয়ানা এখানে দেখা যায়। তাদের মধ্যে মেরিন ইগুয়ানা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এরাই একমাত্র টিকটিকি, যারা পানির নিচে প্রায় ৩০ মিনিট ডুবে থাকতে পারে। ইগুয়ানা আকারে বেশ বড় হলেও এগুলোই সবচেয়ে বড় টিকটিকি নয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকটিকি জাতীয় প্রাণী হলো কোমোডো ড্রাগন। একটি কোমোডো ড্রাগন সাধারণত আট থেকে দশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা মারাত্মক হিংস্র এবং বিষাক্ত মাংসাশী প্রাণী। ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো দ্বীপসহ মাত্র পাঁচটি দ্বীপে এই প্রাণীদেরকে দেখা যায়।