রফিকুল ইসলামঃ এই বিজয়হাসিতে যে কারো মতিভ্রম হবে। মনে হতে পারে সত্যি সত্যিই বুঝি কোনো জয়যাত্রা। জয়যাত্রা — একটি টিভি চ্যানেলের নাম।
সত্যিই কি গণমাধ্যমের জয়যাত্রা? হলে জাতির গর্বের অনুষঙ্গ হতো। কেননা, এই বিজয়হাসি ‘জয়যাত্রা’ টিভির পরিচালক হেলেনা জাহাঙ্গীরের। যিনি ক’দিন আগেও ছিলেন আওয়ামী হেভিওয়েট নেত্রী।
গণমাধ্যমকে বলা হয় ‘জাতির বিবেক’। বিবেক বিস্তৃত অর্থ বহন করে। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যা, বৈধ-অবৈধ, আচার-অনাচার প্রভৃতি বিষয়ের পার্থক্য সম্পর্কে অন্তর্নিহিত শক্তি বা বিচারবোধ। মানুষের বিচারবুদ্ধি জাগ্রতকারী বা সচেতনকারী অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সেই বেবেকেরই পরিচালক নাকি ইঁনি।
কিন্তু গণমাধ্যমে ছবিটির নিচে ‘জয়যাত্রা টিভিতে সাংবাদিক নিয়োগের নামে চাঁদাবাজি করতেন হেলেনা’ শিরোনাম দেখে হতবাকই হয়েছিলাম বৈকি।
যে কোনো বিষয়ে যুক্তি খাড়া করা গেলেও এ ক্ষেত্রে হবে অনৈতিক। চেষ্টা করাটাও হবে গণমাধ্যমের গায়ে হলুদ মাখানো।
আলোকপাতের বিষয়টি উদ্ভিদবিদেরা ভালো জানবেন। আঞ্চলিক ভাষায় ‘লজ্জাবতী’ নামে একটি তৃণলতা আছে, যা কারো স্পর্শ পেলে মিইয়ে যায়। জাতির বিবেক পরিচয়ে যে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন হেলেনা, ইঁনি মিইয়ে গেলেন না; বরং দন্ত মেলিয়ে হাসলেন বিজয়েরি হাসি। এতে প্রস্ফুটিত হয়েছে আসুরিক শক্তির আছর এবং বডি ল্যাঙ্গোয়েজও বলে দেয়, জয়যাত্রা’র যেন যাত্রার জয়।
হলুদ সাংবাদিকতা নিপাতে সরকারের এ অভিযাত্রা যেন আইওয়াশ বা লোক দেখানো না হয়। সন্দেহের উদ্রেক হবেই, যদি না যথোপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা হয় এবং এ পথের অনুসারীদেরও আইনের আওতায় না আনা হয়।
মানে, এরূপ ‘জয়যাত্রা’ টিভির মতো সারাদেশ বাদ দিলেও খোদ রাজধানী ঢাকাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কত যে টিভি চ্যানেল আর অনলাইন পত্রিকা, যার ইয়ত্তা নেই। উদ্বেগের বিষয় হলো, যাঁদের দেখার কথা, তাঁদের ফেসভেল্যুর ফটোগ্রাফি ব্যবহার করেই ইঁনারা আজ বড় সাংবাদিক।
ওঁরা মাগনা বা অবৈতনিক সাংবাদিক এবং দু’কলম লেখার মুরোদ না থাকলেও দাপট সাংঘাতিক। দামি গাড়ি হাকিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়, পাশাপাশি ব্যবসা করলে পাঠক আরো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাবেন।
ইঁনাদের দৃষ্টিতে ওই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ হলো, যাঁকে দিয়ে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা লোটা সম্ভব তথা আখের গোছানো যায়। তাঁদেরই ক’খানা ‘মেইড ইন ডেস্ক’ রিপোর্ট প্রচার করে কতইনা উঁচুসিড়ি বাই। এসব মেইড ইন সাংবাদিকদের ভিড়ে ভরা ইত্যাকার সাংবাদিক সংগঠনগুলোও।
দৌড়ঝাঁপে পন-পন হলেও ওইসমস্ত বড় সাংবাদিকদের অতিসাধারণ একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে দেখেছি বাক্যগঠনে ঠনঠন, শব্দচয়নে শন-শন ও বানানে ভন-ভন।
একবার জনৈক মহিলা সম্পাদকের কথায় আমার প্রধান সম্পাদকের স্মরণে একটা লেখা দিয়েছিলাম ‘ঢাকানিউজ’ অনলাইন পত্রিকায়, যার সহকারী সম্পাদক আমার পত্রিকার প্রধান সম্পদককে অগাধ শ্রদ্ধা করেন।
কিন্তু সম্পাদক সাহেব মুঠোফোনে ‘এসব হাবিজাবি লেখা কে এখানে পাঠাতে বলছে’ — ঝাঁঝালো ভাষায় জানতে চাইলে বললাম, থুক্কু (Sorry) মি. এডিটর, আমি অ্যাসোসিয়েট এডিটর মাত্র, আপনার পত্রিকাকে ‘টয়লেট পেপার’ ভেবে ফেলেছিলাম।
যাক্, এদিনই লেখাটি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জাগোনিউজ ও সারাবাংলাসহ আরো ৩টি অনলাইনে ছাপা হলে ওই টয়লেট পেপারে পোস্টের লিংকটি আমার মেইলে পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে জাতে উঠালেন।
তেলে মধ্যে ডুবে থাকা তথাকথিত এসব গণমাধ্যম জিইয়ে থাকে কীসের ঘৃতাক্তিতে — জবাব মিলবে কি?
জাগুক বিবেক। জয়যাত্রা’র যেন যাত্রার জয়ে না গড়ায়। চলুক না এ শুদ্ধি অভিযান, এগোবে বাংলাদেশ।
কলমে: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।