দুই নেতার পদত্যাগ নিয়ে বিএনপিতে নানা আলোচনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত ২৮ জুন ‘শারীরিক অসুস্থতা’ দেখিয়ে বিএনপি থেকে অব্যাহতি চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন দলের সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব.) শাহজাহান মিয়া ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হানিফ। এরই মধ্যে আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন।’

দুই নেতার অব্যাহতির পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যে বিএনপিতে নানা গুঞ্জন ডালপালা মেলছে। দলের অন্দরে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন অনেকে। অনেকে এ দুই ঘটনায় ‘দুয়ে দুয়ে চার’ মেলাচ্ছেন। তবে অনেকে একে কেবলই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।

দলীয় একটি সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং সরকারবিরোধী কার্যকর কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারায় রাজনৈতিক হতাশায় ভুগছেন বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা। দলের ভবিষ্যৎ শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।

বিএনপির চেয়ারপরসন খালেদা জিয়া সরকারের ইচ্ছায় মুক্ত থাকলেও কার্যত তিনি রাজনীতিতে অংশ নিতে পারছেন না। ফলে দলের নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপির নেতৃত্বের একটি অংশ মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারেকের অনুসারীরা দলের সিনিয়র নেতাদের কোণঠাসা করতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই সম্মান বাঁচাতে সিনিয়র নেতৃত্বের একাংশ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ দল ছেড়ে দিচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন সামরিক কর্মকর্তা বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। এ তালিকায় সামনে আরও নাম যোগ হতে পারে।

একটি সূত্রের দাবি, যারা নেতৃত্ব প্রতিযোগিতায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, তারাও পদত্যাগের মিছিলে শামিল হতে পারেন। এমনকি বিএনপি সরকারের এমপি-মন্ত্রী হয়ে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এমন সুবিধাবাদী কাউকেও দেখা যেতে পারে পদত্যাগের মিছিলে।

যদিও বিএনপির নেতৃত্বের আরেকটি অংশের দাবি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল ভাঙার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখানে ইন্ধন যোগাচ্ছে বিরোধী শক্তি। এমনকি ‘বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন’ বলে ওবায়দুল কাদেরের করা মন্তব্যে এই ইন্ধনের সূত্র পাচ্ছে ওই অংশ। যদিও এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাইছেন না।

২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ই বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সিনিয়র সদস্য দলত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। সে যাত্রায় তাদের পদত্যাগ করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পরে পদত্যাগ করেন দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মোর্শেদ খান। যদিও তাদের পদত্যাগের বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা হয়নি।

সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সঙ্গেও বিএনপির হাইকমান্ডের দূরত্ব দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকে একটি মহল প্রচার করছে, মির্জা আব্বাস দল ছাড়ছেন। যদিও মির্জা আব্বাস এসবকে ‘অপপ্রচার’ বলে আসছেন।

সদ্য পদত্যাকারী একজন নেতা বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে এক ধরনের অহংকার বিরাজ করছে। তারা মনে করেন, আমাদের মতো ছোট-খাট শত নেতা পদত্যাগ করলেও দলের কোনো ক্ষতি হবে না। আর এই অহংকারের কারণেই আজ দলের এই করুণ পরিণতি। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়েই বিএনপির পতনের শুরু হয়। পরে জামায়াতকে খুশি করতে গিয়ে বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদকে দলত্যাগে বাধ্য করা হয়। এগুলো আজ বিএনপিকে এই করুণ অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আর এসব কিছুর পেছনের নেপথ্য কারিগর হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও তার দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট।’

বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার দাবি, ‘প্রথমে দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে (হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদ) এবং পরে স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক সদস্যকে (মির্জা আব্বাস) কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেয়া, দুজন কেন্দ্রীয় নেতা দল থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়ার পর হাইকমান্ড থেকে এ বিষয়ে কোনো সাড়া না পাওয়ায় একটা বার্তা স্পষ্ট যে, দলীয় হাইকমান্ড একদিকে বয়স্ক এবং এলাকায় অজনপ্রিয় নেতাদের যেমন পাত্তা দিচ্ছে না, তেমনি যারা দলের আনুগত্য স্বীকার করছে না, তাদেরও গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাছাড়া নেতৃত্বের সমালোচনা করায় ছাত্রদলের এক নেতার মাধ্যমে (বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী) ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী বক্তব্য দিলে সবার পরিণতি এমন হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে কোনো কোনো মহলের পক্ষ থেকে দল ভাঙার একটা প্রক্রিয়া চালানো হয়ে থাকতে পারে। হতাশায় ভুগে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন, এটাও আরেকটা বিষয়। বিএনপি থেকে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগে গিয়ে লাভবান হবেন, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাই নানান গুঞ্জন থাকলেও সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সতর্ক রয়েছে। কারণ কোনো নেতাকর্মীর পাশ থেকে যদি দলীয় হাইকমান্ডের ছায়া সরে যায়, তখন তার আর অস্তিত্ব থাকে না।’

দলীয় নেতাদের পদত্যাগের গুঞ্জন প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার বলেন, ‘স্বাধীন দেশ, গণতান্ত্রিক দেশ। যে কেউই যে কোনো দল করতে পারে, আবার তার ইচ্ছা হলে তিনি সেই দল থেকে পদত্যাগ করতে পারেন, অন্য দলও করতে পারেন। তবে এই মুহূর্তে দুইজন কেন্দ্রীয় নেতা পদত্যাগের কথা আমরা জানি। তারা ব্যক্তিগত কারণে এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেছেন। অন্য কেউ এখনো পদত্যাগ করেননি। বিএনপি থেকে কেউ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে গেছে, সমসাময়িক রাজনীতিতে এমন কোনো উদাহরণ নেই।’

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের দলের যে দুজনের পদত্যাগের কথা বলা হচ্ছে তারা ব্যক্তিগত কারণের কথা বলেছেন। আর আওয়ামী লীগ হচ্ছে এখন ডুবন্ত জাহাজ, ডুবন্ত জাহাজে কেউ ওঠে না বরং ডুবন্ত জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার জন্য।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ কয়েকদিন আগে ভার্চুয়াল এক সভায় মন্তব্য করেছেন যে, তিনি অস্বস্তি নিয়ে বিএনপি করছেন।

দলীয় নেতাদের পদত্যাগের গুঞ্জনের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি এ পর্যন্ত দুইজন তাদের ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া আমি কিছু জানি না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে দল থেকে দুইজন পদত্যাগ করেছেন। জানা মতে, আমাদের দলের কোনো নেতাকর্মী পদত্যাগ করছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ তো অনেক কথা বলে, অনেক কিছু করে। আমরা মনে করি এটা ভিত্তিহীন খবর।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর