গত বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীর দুর্গাপুর হাটে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল পেঁয়াজের হাট দেখবো। সেখানে পেঁয়াজে বড় হাট বসে। বাজার ঘুরে দুপুরের খাবার খেতে হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হোটেলের সামনের এক জায়গায় দেখলাম ঝুড়িতে স্ট্রবেরি বিক্রি করছেন এক কৃষক। আগ্রহ নিয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, স্ট্রবেরির বীজ কোথায় পেলেন।
তিনি বললেন, ‘রাজশাহীর মনজুর স্যারের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। তখনও তিনি জানতেন না, আমিই সেই ব্যক্তি। স্থানীয় গাইড সেলিম যখন আমাকে দেখিয়ে বললো ইনিই ‘মনজুর স্যার’, তখন কৃষকের চোখে মুখে আশ্চর্যের চিহ্ন দেখতে পেলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে তার স্ট্রবেরি খাইয়ে ছেড়েছেন।’
মনের ভালোলাগা একটি বিশেষ মুহূর্তের কথাগুলো হাসতে হাসতে এভাবেই বলছিলেন বাংলাদেশে স্ট্রবেরি চাষের উদ্ভাবক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স (আইবিএস) এর পরিচালক প্রফেসর ড. এম. মনজুর হোসেন।
এ প্রতিবেদকের কাছে অনুভূতি প্রকাশের পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে স্থির দৃষ্টিতে আবারও হারিয়ে যান পুরোনো দিনের সেই স্মৃতিতে।
প্রফেসর ড. এম. মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল পথের ধারে খুব সাধারণ ফেরিওয়ালারা ভ্যানগাড়িতে করে স্ট্রবেরি বিক্রি করবে। আজ আমি ক্যাম্পাস থেকে বাইরে গেলেই দেখতে পাই ভ্যানগাড়িতে স্ট্রবেরি বিক্রি হচ্ছে। কেবল ইট-পাথরের শহরেই নয়, গ্রামের প্রত্যন্ত মেঠোপথ, হাট-বাজারেও এখন স্ট্রবেরি বিক্রি হয়। আমি মনে করি, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লতা দিয়ে আবিষ্ট থাকায় শুরুর দিকে এ অঞ্চলের মানুষ স্ট্রবেরির নাম দিয়েছিল ‘লতানো লিচু’। সমার্থক চেহারা থাকায় লিচুর সঙ্গেই কল্পনা করতো উদ্ভিদ জাতীয় এ বিদেশি ফলের। স্বাদটাও তাই লিচুর মতোই আশা করেন তারা। কিন্তু সেখানেই ভিন্নতা।
তিনি বলেন, স্ট্রবেরি হলো এক ধরণের ‘ফ্র্যাগারিয়া’ (-গোলাপ প্রজাতির এক ধরনের ফুল) জাতীয় উদ্ভিদ। তবে সারা বিশ্বে এটি ফল হিসেবেই চাষ করা হয় এখন। গন্ধ, বর্ণ ও স্বাদে আকর্ষণীয় এই ফল, ফলের রস, জ্যাম, আইসক্রিম, মিল্ক শেক এবং আরও অনেক খাদ্য তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। শিল্পায়িত খাদ্য তৈরিতেও স্ট্রবেরির সুগন্ধ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে সর্বপ্রথম স্ট্রবেরির চাষ করা হয়। এটি পরবর্তীতে চিলি, আর্জেন্টিনা এবং কালক্রমে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে স্ট্রবেরি চাষের উদ্ভাবনের কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর ড. এম. মনজুর হোসেন জানান, প্রায় দেড় যুগ আগে বাংলাদেশের স্ট্রবেরি চাষ উদ্ভাবনে কাজ শুরু করেন তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে গবেষণা চালান। দীর্ঘ চেষ্টার মধ্য দিয়ে অবশেষে সোমা ক্লোনাল ভেরিয়েশন প্রযুক্তির সাহায্যে এ দেশে চাষ উপযোগী করে রাবি-১, রাবি-২, রাবি-৩ নামে তিনটি জাত উদ্ভাবন করেন।
স্ট্রবেরি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও বেশি দিন থাকে এমন এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। এখানে রাবি স্ট্রবেরি-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। অক্টোবর থেকে নভেম্বর দুই মাস স্ট্রবেরির চারা লাগানোর জন্য উপযুক্ত। এতে শক্ত কোনো ডালপালা নেই। পাতা সবুজ, ছোট কিনারা খাঁজকাটা, থানকুনি পাতার মতো; পাতার বোঁটাও লম্বা, সরু, নরম। বর্তমানে চাহিদা থাকায় কৃষক ছাড়াও দেশের শিক্ষিত যুবকরা স্ট্রবেরির চাষ করছে।
এখনও স্ট্রবেরির স্বাদ, গুণ ও আকার নিয়েই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে প্রফেসর ড. এম মনজুর হোসেন বলেন, ‘গবেষণাই আমার সাধনা। এর মধ্য দিয়েই হয়তো আমি সবার মাঝে অমর হয়ে থাকবো। আমি চিরকাল বাঁচবো না। তবে আমার উদ্ভাবন হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইনস্টিটিউট, মতিহারের এই সবুজ ক্যাম্পাসই আমার জীবনের সব।’
শিক্ষকরা তার উৎসাহদাতা। এখানকার শিক্ষার্থীরাই তার পরিবার। তাই পরিবারের তরুণ সদস্যদের নিয়ে নতুন নতুন গবেষণায় মগ্ন থাকতেই তার বেশি ভালো লাগে বলে জানান এ উদ্ভাবক।
১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি উত্তরের অন্যতম জেলা নাটোরের সিংড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স অর্থাৎ জীব বিজ্ঞান বিভাগের (আইবিএস) পরিচালক। এছাড়া বর্তমানে উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ প্রজনন ও জিন প্রকৌশল গবেষণাগারে গবেষণা কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন দেশের স্বনামধন্য এ উদ্ভাবক।
ড. এম. মনজুর হোসেন ইতোমধ্যে মহাত্মা গান্ধী শামীত্ম পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে সাধারণ কৃষকদের উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, স্ট্রবেরির জাত উদ্ভাবন, টিস্যু কালচারের বীজ আলু ও জাবেরা ফুলের চারা তৈরি এবং কৃষি গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য এ পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়া ড. মনজুর হোসেন ১৯৯৫ সালে পিএইচডি গবেষণার কৃতিত্ব স্বরূপ স্বর্ণপদক অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে আমেরিকান সরপটিমিস্ট ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও ১৯৯৫ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে জাপান ইয়াগামাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করায় গোল্ড মেডেল, ২০০২ সালে ইংল্যান্ডে কমনওয়েলথ ফেলো, ২০১১ সালে হেলেন কেলার গোল্ড মেডেলসহ অর্ধ শতাধিক সম্মাননা ও পুরস্কার পান। দেশি-বিদেশি জার্নালে বর্তমানে তার দু’শতাধিক গবেষণা প্রকাশনা রয়েছে। তার অধীনে এখন পর্যন্ত ২৭ জন পিএইচডি ও ৯ জন শিক্ষার্থী এমফিল গবেষণা করেছেন।