ঢাকা ১২:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বুড়ো বয়সে সুসন্তানের বড়ই দরকার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৩৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ মার্চ ২০১৬
  • ৩১৮ বার

১. সেদিন আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম এক নেফ্রোলজিস্টের (কিডনি বিশেষজ্ঞ) কাছে। ঢুকেই ডাক্তারের অফিসের ফ্রন্টডেস্কে রিপোর্ট করে ওয়েটিংরুমে বসে আছি। কিছুই করার নেই তাই হাতের কাছে পেয়ে এক পুরনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছি। এমন সময় দরজায় আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি দু’জন রোগী এসে ঢুকছেন। দেখতে যদিও দু’জনকেই রোগী মনে হচ্ছিল, তথাপি আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, নেফ্রোলজিস্টের কাছে রোগী এসেছেন একজনই এবং অন্যজন নিছক সঙ্গ দিচ্ছেন। ডাক্তারের অফিসে অহরহই তো কত সুখী-অসুখী মানুষ আসা-যাওয়া করেন, কিন্তু ওই দিন এ দু’জনের প্রতি আমার বিশেষ নজর পড়ল কেন? কারণ অবশ্য একটা আছে, আর এ নিয়েই আজকের এ ছোট্ট কথিকা। যাঁদের কথা বলছি তাঁরা দুজনই বৃদ্ধ। বয়স আনুমানিক আশির বেশি বৈ কম হবে না। একজন পুরুষ আরেকজন মহিলা। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম, তাঁরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। কীভাবে বুঝলাম সেটা একটু পরেই আপনাদের কাছে খোলাসা হয়ে যাবে। ভদ্রমহিলা বয়সের ভারে অথবা অগ্রসরমান জটিল
কিডনি রোগে একেবারে কাবু হয়ে গেছেন, হাঁটতে পারছেন না। অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলছেন তাও আবার চার চাকার ওয়াকারের ওপর ভর করে। ভদ্রলোক একহাতে স্ত্রীকে ধরেছেন এবং আরেক হাতে লাঠির সাহায্যে এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন এবং হাঁফাচ্ছেন। এভাবে অতি কষ্টে তাঁরা দুজন এসে ঢুকলেন ডাক্তারের ঘরে। ক্লান্ত হয়ে এসে দুজনই চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন। তাঁদের দেখে ভীষণ করুণা হল, ভাবলাম, দু’জনই তো রোগী, কে কাকে দেখে!

২. পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে ফ্রন্টডেস্কে কর্তব্যরত ডাক্তারের নার্স মিসেস লিলি বলে ইনসুরেন্সের কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে ডাক দিলেন রোগিনীকে। পেশেন্ট ডাক শুনতে পেলেন কী না বুঝলাম না, ইত্যবসরে ভদ্রলোক পড়িমরি করে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘আই অ্যাম মিস্টার লিলি’। অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর হয়ে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করে দিয়ে দর্শনার্থী রোগীদের হাজিরা খাতায় মিসেস লিলির নাম লিখে আবার গিয়ে চেয়ারে বসলেন তাঁর সহধর্মিনীর
পাশে। যেভাবে তাঁরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে লিফ্টে চড়ে তিনতালায় উঠে ওয়াকার ও লাঠির ওপর ভর করে ডাক্তারের অফিসে এসে ঢুকলেন, তা মারাত্মকরকম ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি। নিরুপায় হয়ে জেনেশুনেই তাঁরা এভাবে আসতে যে বাধ্য হয়েছেন সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ চলার পথে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে গিয়ে তাঁদের একজনের কিংবা দু’জনেরই হাত পা ভেঙে যেতে পারত। এ অবস্থায় নিজেদের ছেলেমেয়ে, অথবা আরো অল্পবয়সী আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কিংবা প্রতিবেশী কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। হাতের কাছে কাউকে পাননি নিশ্চয়ই। জীবনটা বড়ই কঠিন! ‘‘জগতে কে কাহার!’’ বস্তুবাদি পাশ্চাত্য সমাজের এটা একটা ভীষণ খারাপ দিক। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের দেখাশোনা ইউরোপ আমেরিকায় একটা বিশাল পারিবারিক, সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা হয়ে আছে। এটা আজ নতুন নয়, অনেক দিন ধরেই চলছে

এভাবে। আজকাল বাংলাদেশেও এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। মিস্টার ও মিসেস লিলির দুরবস্থা দেখে মনে মনে ভাবলাম, এ দু’জন লিলির জীবনই শুধু এমন বিষাদময় নয়। আরো অনেক লোক, এমন কী আমার জানামতে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও এমন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ
অনেক আছেন যাঁদের নিত্যদিন এভাবে অসহায়ের মতই কাটছে, অর্থাৎ কে কাকে দেখে! দুঃসময়ে প্রিয়জনরা থেকেও কাছে থাকে না বা থাকতে পারে না। অন্যের কথাইবা বলি কী করে, মাত্র ক’বছর হল আমার শ্বশুর মারা গেছেন। তাঁকে শেষ সময়ে দেখার জন্য না পেরেছি আমি যেতে না আমার

৩. স্ত্রী। কিছুটা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে পেরেশানির কারণে, কিছুটা গাফলতির জন্য। এ জন্য আমার আফসোস্ হয় আর আমার স্ত্রীর তো দুঃখের সীমা নেই। ঊনিশ শ’ ছিয়াশি সালে আমার বাবা মারা গেছেন। সে সময় নিজে ছাত্র ছিলাম বাবাকে দেখতে যেতে পারিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে থাকা হয়নি বলে আজও আমার প্রাণ কাঁদে। আমার মা এবং শাশুড়ি যখন মারা যান তখনও আমি দেশে যেতে পারিনি। এ তো গেল এক কথা, কিন্তু তাঁরা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনও কি তাদের প্রতি সঠিক দায়িত্বটা পালন করতে পেরেছি? তাও তো পারিনি! বৈষয়িক দিক থেকে অসুবিধা না হলেও বয়সকালে সকল মা-বাবাই তাঁর
সন্তানদেরকে দেখতে চান, কাছে পেতে চান। তাঁদের এমন আশাও তো আমরা পুরণ করতে পারিনি। এটাই বা কম দুঃখের কী! নিজেরা যখন বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করতে পারিনি, আমরা যখন বুড়ো হব তখন কীভাবে আমাদের সন্তানদের কাছে দাবি করব আমাদের কাছে থাকার জন্য বা তাদের কাছে আমাদেরকে রাখার জন্য। ডাক্তারের অফিসে বসে এলোপাথাড়ি এ-সব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব খারাপ হয়ে আসল। দেহের চোখ মুছে মুছে মনের চোখে পেছন ফিরে তাকালাম। মনে পড়ল অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডির ছাত্র। সে সময় ওই ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে প্রতি শ্রμবার বিকেলে বিভাগীয় সেমিনার হত। সেমিনারে একেক দিন একেকজন প্রফেসর একেকটা বিষয়ের ওপর তাঁদের গবেষণাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকেও সেমিনার উপলক্ষে ভিজিটিং প্রফেসররা আসতেন। সেমিনারে উপস্থাপকরা তাঁদের গবেষণার ফলাফল জানাতেন এবং এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হত, গভীর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হত, উত্তপ্ত তর্ক- বিতর্ক হত। ওইসব সেমিনারে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস হিসেবে আমাদেরও থাকতে দেওয়া হতো। দেওয়া হতো বললে একটু কমই বলা হয়, বরং

৪.আমাদের সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য রীতিমত উৎসাহীত করা হতো। ওইসব সেমিনারে আমি বিশেষ কিছু বুঝতাম না। তবে প্রফেসরদের চিন্তার প্রসারতা, বুদ্ধির প্রখরতা এবং জ্ঞানের গভীরতা দেখে দারুণভাবে মুগ্ধ হতাম! আর ভাবতাম, বাংলাদেশে এমন গভীর, নিবিড়, এবং নির্ভেজাল জ্ঞান-চর্চা কবে হবে? নেফ্রোলজিস্টের অফিসে বসেই ওই সব সেমিনারের এক বিশেষ দিনের কথা মনে পড়ল। একদিনের সেমিনারের মূল প্রবন্ধ ও তার ওপর আলোচনাসমাে লাচনা শেষে একটা দীর্ঘ জ্ঞানগর্ভ পাশর্-^ আলোচনা (সাইড টক বা সাইড ডিসকাশন) হয়েছিল। এতেও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। পাশর্-^ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার দেখাশোনার দায়িত্ব’। এটা কী সন্তানের, সমাজের, না রাষ্ট্রের, এবং কীভাবে কার্যকরভাবে কম খরচে এ গুরুদায়িত্ব পালন কার যায়, তা নিয়ে প্রফেসরদের মধ্যে চলছিল তুমূল বিতর্ক। ওই সময় কানাডার অর্থনীতির সবচেয়ে রমরমা খাত ছিল সিনিয়র সিটিজেনস হোম্স। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ লোকজনদের দেখাশোনার জন্য তখন সারা দেশে নির্মিত হচ্ছিল সিনিয়র সিটিজেনস রেসিডেন্স। এতে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের ভর্তুকিও ছিল বেশ। ফলে সরকারের উভয় স্তরে দেখা যাচ্ছিল রাজস্ব ঘাটতি। কীভাবে সরকারের এ খরচ কমানো যায়, তা নিয়ে চলছিল আলোচনা ও যুক্তি-তর্ক। অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় এ
সমস্যা একটু বড় এবং জটিল ছিল। কারণ ওই দেশের মানুষের গড় আয়ু পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি ছিল। সেদেশের মানুষ অনেক দিন বাঁচে। তাই অবসর নেওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে বিশেষ করে অসুস্থ পিতামাতার দেখাশোনা কানাডার জন্য এক বিরাট সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই বিতর্কের খুঁটিনাটি সব কথা সেদিন বুঝিনি, তবে অবশেষে সবাই যে উপসংহারে একমত হয়ে বিতর্কের অবসান টেনেছিলেন তা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। কথাটা ছিল, “ইন ওল্ড এজ, নাথিং

৫.লাইক ওবিডিয়েন্ট চিল্ড্রেন”। অর্থাত, ‘বৃদ্ধ বয়সে, সুসন্তানের তুলনা নেই’। কথাটা আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আমাদের জীবনের সব ব্যাপারে আল্লাহই চূড়ান্ত ভরসা, তথাপি বৃদ্ধ বয়সে সুসন্তানের বড়ই প্রয়োজন। এ কথা শুধু ইউরোপ, আমেরিকা, এবং কানাডাই নয়, সারা পৃথিবীর বেলাই প্রযোজ্য। পরিশেষে এ প্রসঙ্গে প্রতিটা পিতামাতাকে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে দু’টো
বিষয় খেয়াল রাখতে বলব। প্রমত: তাদেরকে সুশিক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতাশীল বৈষয়িক দুনিয়ার জন্য সুযোগ্য নাগরিক করে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত: সন্তানদেরকে আদব-কায়দা এবং নৈতিক শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যাতে তারা জজ ব্যারিস্টার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাথে পিতামাতার প্রতি সহানুভূতিশীল আদর্শ সুসন্তান হয়ে বড় হয়। আর এ ক্ষেত্রে ধর্ম (সে যে ধর্মই হোক না কেন) নিঃসন্দেহে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বলা যত সহজ, সঠিকভাবে কাজটা করা ততই কঠিন। এ দুনিয়ায় দিনের শেষে আমরা কে কতখানি সফল তা নির্ভর করে ছেলেমেয়েদের আমরা কীভাবে মানুষ করতে পেরেছি তার ওপর।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “A tree is known by the fruit it bears”। অর্থাৎ, ‘‘ফলেই বৃক্ষের পরিচয়’’। সুসন্তান মানুষ হয়ে শুধু মাবাবার মুখই উজ্জ্বল করে না বরং বিপদে-আপদে তাঁদের সাহায্যও করে থাকে। ( লেখাটা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছে আমার এক ছোট ভাই- মো: মুজিবুর রহমান। তার কাছে আমার অনেক ঋণ রইল)।
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বুড়ো বয়সে সুসন্তানের বড়ই দরকার

আপডেট টাইম : ০২:৩৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ মার্চ ২০১৬

১. সেদিন আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম এক নেফ্রোলজিস্টের (কিডনি বিশেষজ্ঞ) কাছে। ঢুকেই ডাক্তারের অফিসের ফ্রন্টডেস্কে রিপোর্ট করে ওয়েটিংরুমে বসে আছি। কিছুই করার নেই তাই হাতের কাছে পেয়ে এক পুরনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছি। এমন সময় দরজায় আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি দু’জন রোগী এসে ঢুকছেন। দেখতে যদিও দু’জনকেই রোগী মনে হচ্ছিল, তথাপি আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, নেফ্রোলজিস্টের কাছে রোগী এসেছেন একজনই এবং অন্যজন নিছক সঙ্গ দিচ্ছেন। ডাক্তারের অফিসে অহরহই তো কত সুখী-অসুখী মানুষ আসা-যাওয়া করেন, কিন্তু ওই দিন এ দু’জনের প্রতি আমার বিশেষ নজর পড়ল কেন? কারণ অবশ্য একটা আছে, আর এ নিয়েই আজকের এ ছোট্ট কথিকা। যাঁদের কথা বলছি তাঁরা দুজনই বৃদ্ধ। বয়স আনুমানিক আশির বেশি বৈ কম হবে না। একজন পুরুষ আরেকজন মহিলা। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম, তাঁরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। কীভাবে বুঝলাম সেটা একটু পরেই আপনাদের কাছে খোলাসা হয়ে যাবে। ভদ্রমহিলা বয়সের ভারে অথবা অগ্রসরমান জটিল
কিডনি রোগে একেবারে কাবু হয়ে গেছেন, হাঁটতে পারছেন না। অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলছেন তাও আবার চার চাকার ওয়াকারের ওপর ভর করে। ভদ্রলোক একহাতে স্ত্রীকে ধরেছেন এবং আরেক হাতে লাঠির সাহায্যে এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন এবং হাঁফাচ্ছেন। এভাবে অতি কষ্টে তাঁরা দুজন এসে ঢুকলেন ডাক্তারের ঘরে। ক্লান্ত হয়ে এসে দুজনই চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন। তাঁদের দেখে ভীষণ করুণা হল, ভাবলাম, দু’জনই তো রোগী, কে কাকে দেখে!

২. পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে ফ্রন্টডেস্কে কর্তব্যরত ডাক্তারের নার্স মিসেস লিলি বলে ইনসুরেন্সের কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে ডাক দিলেন রোগিনীকে। পেশেন্ট ডাক শুনতে পেলেন কী না বুঝলাম না, ইত্যবসরে ভদ্রলোক পড়িমরি করে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘আই অ্যাম মিস্টার লিলি’। অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর হয়ে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করে দিয়ে দর্শনার্থী রোগীদের হাজিরা খাতায় মিসেস লিলির নাম লিখে আবার গিয়ে চেয়ারে বসলেন তাঁর সহধর্মিনীর
পাশে। যেভাবে তাঁরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে লিফ্টে চড়ে তিনতালায় উঠে ওয়াকার ও লাঠির ওপর ভর করে ডাক্তারের অফিসে এসে ঢুকলেন, তা মারাত্মকরকম ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি। নিরুপায় হয়ে জেনেশুনেই তাঁরা এভাবে আসতে যে বাধ্য হয়েছেন সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ চলার পথে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে গিয়ে তাঁদের একজনের কিংবা দু’জনেরই হাত পা ভেঙে যেতে পারত। এ অবস্থায় নিজেদের ছেলেমেয়ে, অথবা আরো অল্পবয়সী আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কিংবা প্রতিবেশী কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। হাতের কাছে কাউকে পাননি নিশ্চয়ই। জীবনটা বড়ই কঠিন! ‘‘জগতে কে কাহার!’’ বস্তুবাদি পাশ্চাত্য সমাজের এটা একটা ভীষণ খারাপ দিক। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের দেখাশোনা ইউরোপ আমেরিকায় একটা বিশাল পারিবারিক, সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা হয়ে আছে। এটা আজ নতুন নয়, অনেক দিন ধরেই চলছে

এভাবে। আজকাল বাংলাদেশেও এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। মিস্টার ও মিসেস লিলির দুরবস্থা দেখে মনে মনে ভাবলাম, এ দু’জন লিলির জীবনই শুধু এমন বিষাদময় নয়। আরো অনেক লোক, এমন কী আমার জানামতে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও এমন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ
অনেক আছেন যাঁদের নিত্যদিন এভাবে অসহায়ের মতই কাটছে, অর্থাৎ কে কাকে দেখে! দুঃসময়ে প্রিয়জনরা থেকেও কাছে থাকে না বা থাকতে পারে না। অন্যের কথাইবা বলি কী করে, মাত্র ক’বছর হল আমার শ্বশুর মারা গেছেন। তাঁকে শেষ সময়ে দেখার জন্য না পেরেছি আমি যেতে না আমার

৩. স্ত্রী। কিছুটা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে পেরেশানির কারণে, কিছুটা গাফলতির জন্য। এ জন্য আমার আফসোস্ হয় আর আমার স্ত্রীর তো দুঃখের সীমা নেই। ঊনিশ শ’ ছিয়াশি সালে আমার বাবা মারা গেছেন। সে সময় নিজে ছাত্র ছিলাম বাবাকে দেখতে যেতে পারিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে থাকা হয়নি বলে আজও আমার প্রাণ কাঁদে। আমার মা এবং শাশুড়ি যখন মারা যান তখনও আমি দেশে যেতে পারিনি। এ তো গেল এক কথা, কিন্তু তাঁরা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনও কি তাদের প্রতি সঠিক দায়িত্বটা পালন করতে পেরেছি? তাও তো পারিনি! বৈষয়িক দিক থেকে অসুবিধা না হলেও বয়সকালে সকল মা-বাবাই তাঁর
সন্তানদেরকে দেখতে চান, কাছে পেতে চান। তাঁদের এমন আশাও তো আমরা পুরণ করতে পারিনি। এটাই বা কম দুঃখের কী! নিজেরা যখন বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করতে পারিনি, আমরা যখন বুড়ো হব তখন কীভাবে আমাদের সন্তানদের কাছে দাবি করব আমাদের কাছে থাকার জন্য বা তাদের কাছে আমাদেরকে রাখার জন্য। ডাক্তারের অফিসে বসে এলোপাথাড়ি এ-সব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব খারাপ হয়ে আসল। দেহের চোখ মুছে মুছে মনের চোখে পেছন ফিরে তাকালাম। মনে পড়ল অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডির ছাত্র। সে সময় ওই ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে প্রতি শ্রμবার বিকেলে বিভাগীয় সেমিনার হত। সেমিনারে একেক দিন একেকজন প্রফেসর একেকটা বিষয়ের ওপর তাঁদের গবেষণাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকেও সেমিনার উপলক্ষে ভিজিটিং প্রফেসররা আসতেন। সেমিনারে উপস্থাপকরা তাঁদের গবেষণার ফলাফল জানাতেন এবং এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হত, গভীর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হত, উত্তপ্ত তর্ক- বিতর্ক হত। ওইসব সেমিনারে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস হিসেবে আমাদেরও থাকতে দেওয়া হতো। দেওয়া হতো বললে একটু কমই বলা হয়, বরং

৪.আমাদের সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্য রীতিমত উৎসাহীত করা হতো। ওইসব সেমিনারে আমি বিশেষ কিছু বুঝতাম না। তবে প্রফেসরদের চিন্তার প্রসারতা, বুদ্ধির প্রখরতা এবং জ্ঞানের গভীরতা দেখে দারুণভাবে মুগ্ধ হতাম! আর ভাবতাম, বাংলাদেশে এমন গভীর, নিবিড়, এবং নির্ভেজাল জ্ঞান-চর্চা কবে হবে? নেফ্রোলজিস্টের অফিসে বসেই ওই সব সেমিনারের এক বিশেষ দিনের কথা মনে পড়ল। একদিনের সেমিনারের মূল প্রবন্ধ ও তার ওপর আলোচনাসমাে লাচনা শেষে একটা দীর্ঘ জ্ঞানগর্ভ পাশর্-^ আলোচনা (সাইড টক বা সাইড ডিসকাশন) হয়েছিল। এতেও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। পাশর্-^ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার দেখাশোনার দায়িত্ব’। এটা কী সন্তানের, সমাজের, না রাষ্ট্রের, এবং কীভাবে কার্যকরভাবে কম খরচে এ গুরুদায়িত্ব পালন কার যায়, তা নিয়ে প্রফেসরদের মধ্যে চলছিল তুমূল বিতর্ক। ওই সময় কানাডার অর্থনীতির সবচেয়ে রমরমা খাত ছিল সিনিয়র সিটিজেনস হোম্স। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ লোকজনদের দেখাশোনার জন্য তখন সারা দেশে নির্মিত হচ্ছিল সিনিয়র সিটিজেনস রেসিডেন্স। এতে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের ভর্তুকিও ছিল বেশ। ফলে সরকারের উভয় স্তরে দেখা যাচ্ছিল রাজস্ব ঘাটতি। কীভাবে সরকারের এ খরচ কমানো যায়, তা নিয়ে চলছিল আলোচনা ও যুক্তি-তর্ক। অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় এ
সমস্যা একটু বড় এবং জটিল ছিল। কারণ ওই দেশের মানুষের গড় আয়ু পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি ছিল। সেদেশের মানুষ অনেক দিন বাঁচে। তাই অবসর নেওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে বিশেষ করে অসুস্থ পিতামাতার দেখাশোনা কানাডার জন্য এক বিরাট সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই বিতর্কের খুঁটিনাটি সব কথা সেদিন বুঝিনি, তবে অবশেষে সবাই যে উপসংহারে একমত হয়ে বিতর্কের অবসান টেনেছিলেন তা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। কথাটা ছিল, “ইন ওল্ড এজ, নাথিং

৫.লাইক ওবিডিয়েন্ট চিল্ড্রেন”। অর্থাত, ‘বৃদ্ধ বয়সে, সুসন্তানের তুলনা নেই’। কথাটা আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আমাদের জীবনের সব ব্যাপারে আল্লাহই চূড়ান্ত ভরসা, তথাপি বৃদ্ধ বয়সে সুসন্তানের বড়ই প্রয়োজন। এ কথা শুধু ইউরোপ, আমেরিকা, এবং কানাডাই নয়, সারা পৃথিবীর বেলাই প্রযোজ্য। পরিশেষে এ প্রসঙ্গে প্রতিটা পিতামাতাকে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে দু’টো
বিষয় খেয়াল রাখতে বলব। প্রমত: তাদেরকে সুশিক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতাশীল বৈষয়িক দুনিয়ার জন্য সুযোগ্য নাগরিক করে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত: সন্তানদেরকে আদব-কায়দা এবং নৈতিক শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যাতে তারা জজ ব্যারিস্টার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাথে পিতামাতার প্রতি সহানুভূতিশীল আদর্শ সুসন্তান হয়ে বড় হয়। আর এ ক্ষেত্রে ধর্ম (সে যে ধর্মই হোক না কেন) নিঃসন্দেহে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বলা যত সহজ, সঠিকভাবে কাজটা করা ততই কঠিন। এ দুনিয়ায় দিনের শেষে আমরা কে কতখানি সফল তা নির্ভর করে ছেলেমেয়েদের আমরা কীভাবে মানুষ করতে পেরেছি তার ওপর।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “A tree is known by the fruit it bears”। অর্থাৎ, ‘‘ফলেই বৃক্ষের পরিচয়’’। সুসন্তান মানুষ হয়ে শুধু মাবাবার মুখই উজ্জ্বল করে না বরং বিপদে-আপদে তাঁদের সাহায্যও করে থাকে। ( লেখাটা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছে আমার এক ছোট ভাই- মো: মুজিবুর রহমান। তার কাছে আমার অনেক ঋণ রইল)।
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;