হাওর বার্তা ডেস্কঃ বড়ই নীরবে ও নিভৃতে চলে গেলো বিপুলদা’র (প্রয়াত সংগীত শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য) জন্মতিথি ও প্রয়াণ দিবস। কাকতালীয় ভাবে দাদার জন্ম ও মৃত্যু দুটোই জুলাই মাসে। আমাদের কিশোরগঞ্জ তথা দেশ ও জাতির গর্ব/অহংকার ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই গুণী সংগীতশিল্পী কে কৃতজ্ঞতা ভরে আমি স্মরণ করছি। তাঁর প্রাণ প্রিয় জন্মভূমি কিশোরগঞ্জ এর পক্ষ থেকে দেরীতে হলেও প্রয়াত বিপুল’দার পুণ্য স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং তাঁর প্রয়াত আত্মার চির শান্তি কামনা করছি। পরপারে অনেক অনেক ভালো থাকুন বিপুল’দা।
বিপুল ভট্টাচার্য জন্ম ১৯৫২ সনের ২৫ জুলাই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের ভাটোয়াপাড়া গ্রামে আর ২০১৩ সালের ৫ই জুলাই মাত্র ৬১ বছর বয়সে বিপুল দা ফুসফুসের ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করে। সবাইকে কাঁদিয়ে এই পৃথিবীর মায়াময় জগৎ সংসার ছেড়ে চির প্রস্থান করেন। যদিও ঢাকার পোস্তগোলা শ্মশানঘাটেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন সবার প্রিয় সংগীত শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য, আমাদের প্রিয় বিপুল’দা তবুও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কিশোরগঞ্জ এর মানুষ তাঁর আশৈশব স্মৃতির শহরে দাদাকে খুঁজে বেরায় । সম্মান জানাতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না।
বিপুল দা কিশোরগঞ্জ সরকারী স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই গান গাইতেন। শৈশব থেকেই দাদা’র গানের প্রতি বিশেষ করে লোকসঙ্গীতের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেন। এই আগ্রহ এবং ভালোবাসা থেকেই বিপুল দা লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর এই অদম্য চেষ্টা আর অধ্যবসায় দিয়ে ১৯৬৯ সনে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পল্লিগীতিতে তিনি প্রথমস্থান অধিকার করেছিলেন। দাদা স্কুলে স্কাউটদের দলে জড়িত ছিলেন। স্কাউট দের জন্যে জারীগান গেয়ে সবার বিশেষ নজর কেড়েছিলেন। সেই কারনে স্কাউটদের সাথে স্কুলে থেকে জাম্বুরী তে গিয়েছিলেন সুদূর পাকিস্তানের করাচি শহরে। ইতিমধ্যে দাদা গান গেয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে সবার হৃদয়ে বিশেষ স্হান করে নেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অনুষ্ঠানে জাগরনী আর দেশাত্মবোধক গান গেয়ে কিশোরগঞ্জ এর সংগ্রামী জনতাকে উজ্জীবিত করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৭১ সনে উত্তাল স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিঝরা দিন গুলিতে সব সময়ই মিছিল মিটিং এ গান গেয়ে সংগামী জনতাকে উজ্জীবিত করেছেন। এখনো স্মৃতির জানলায় জ্বল জ্বল করে ভাসছে যে ঐ সময়ে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক রথখলা ময়দানে পতাকা উত্তোলনের সময় আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এর উপস্থিতিতে “পাকিস্তানিদের শাসন মানি না মানব না, মিলিটারিদের মানি না মানব না” গানটি গেয়ে সভায় উপস্থিত জেলার অগণিত মুক্তি পাগল মানুষের মন জয় করেছিলেন।
১৯৭১ সনে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আপামর মুক্তিকামী জনগন দেশ মাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর। তাই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপুল’দাও অন্য দশজনের মত তারুণ্যের টানে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। নিজের জীবনের কথা না ভেবে ঐ তরুণ মাত্র দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেন। খোঁজে বের করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং নাম লেখান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠ শিল্পী হিসেবে। সেখানে যোগদান করে বিপুল’দা পাকিস্তানী আর্মির কামান,বন্দুক আর মেশিনগান এর বিরুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক বা কন্ঠ যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করার দৃঢ় সংকল্প ঘোষনা করেন। শুরু হয় দাদা’র মুক্তি সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। মাইলের পর মাইল হেঁটে যিনি গেয়ে ছিলেন দেশ ও প্রিয় মাতৃ ভূমি রক্ষার জয় গান। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যার কন্ঠে প্রচারিত গাওয়া গানগুলো মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। দেশের মুক্তির মন্ত্রী দীক্ষিত হয়ে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্য হয়েছিলেন বিপুল দা। পরে এই শিল্পী সংস্হার অন্যান্য শিল্পীদের সাথে এই মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী একজন কনিষ্ঠ কন্ঠযোদ্ধা হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আর মুক্তাঞ্চলে হারমোনিয়াম নিয়ে গান করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মনোবল আর প্রেরণা যুগিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন। ঐ সময়ে তিনি বাংলা গণসংগীত ও লোকগানেও রেখেছেন বিশেষ অবদান। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ সেলুলয়েডের পর্দায় নিয়ে আসেন “মুক্তির গান” নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম যা মুক্তি যুদ্ধের সংগীত ফ্রন্টের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে দেশে ও বিদেশে। তাই এই প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ কর্তৃক পরিচালিত “মুক্তির গান” ডকুমেন্টারি ফিল্মটি যখন হলের পর্দায় নব্বই এর দশকে দেখছিলাম তখন সেই তরুণ বিপুল’দা কে দেখে আবেগে শুধু আপ্লুতই হইনি মনে হচ্ছিল যেন পুরো কিশোরগঞ্জকেই দেখছিলাম। গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল এবং এখনও স্মৃতি সুধায় ভরে আছে এবং থাকবে সতত। ভাবা যায়! ঐ চলচ্চিত্রের ১১টি গানের মধ্যে ১০টিই তাঁর গাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের এই লড়াকু শব্দ সৈনিকের অসামান্য অবদান কোনোদিন ভুলবার মত নয়। জানিনা এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের অভাব কোনদিন সঙ্গীতের জগতে পূরণ হবে কিনা!
মুক্তিযুদ্ধের পরেও তাঁর ভরাট দরাজ গলায় গাওয়া গানগুলো ইথারে ভেসে বেড়ায়। দেশের বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন এবং অসংখ্য গান গেয়েছেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্মৃতি কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে। স্বাধীনতাত্তোর কালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কিশোরগঞ্জে সফরে এসেছিলেন তখনও প্রিয় বিপুলদা গান গেয়ে শুধু উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতাদের মনই জয় করেননি বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকে গান শুনিয়ে বিমোহিত করেছিলেন। তাই বিপুল’দার গান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধু বিপুল’দার স্বাধীনতার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে এই মহান গুণী শিল্পী কে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। অথচ এই শিল্পীর ভাগ্যে দেশ স্বাধীন এর পর থেকে এখন পর্যন্ত জোটেনি কোন জাতীয় পদক বা রাষ্ট্রীয় সম্মান বা স্বীকৃতি। পাদ প্রদীপ এর আলোতে দাদা আর উঠে আসতে পারেননি। আমৃত্যুই থেকে ছিলেন নীরবে আর নিভৃতে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আমাদের অতি পরিচিত আখড়া বাজারের কুমকুম দিদি কে। জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। দুটি সন্তান কে নিয়ে জীবন সংগ্রাম করেছেন। বাঁচার জন্য বিপুল দা গান গেয়ে ও গান শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু পাননি কোন আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা। তবুও নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে কারও সাথে আপোস করেন নি।
কত বেদনার কথা, যে তরুণ সংগীত শিল্পী, বিপুল ভট্টাচার্য ১৯৭১ সালে পথে প্রান্তরে কালজয়ী সব দেশাত্মবোধক গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সেই শিল্পী ২০১০ সালে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো বা চিকিৎসা সেবাই প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল টাকার অভাবে৷ অবশ্য তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল’দার চিকিৎসার বিশাল খরচ মেটাতে “মানুষ মানুষের জন্য” এই শ্লোগান নিয়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন। কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে আয়োজন করেছিলেন গানের অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। তাছাড়া রেডিও ফুর্তিও দাদার চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা প্রদান করেছিলেন ।
বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী বিপুল ভট্টাচার্যের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা তাঁদের এক শোকবাণীতে বলেছিলেন যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন, বিপুল ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। কিন্তু বিপুল ভট্টাচার্য মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি। “মুক্তির গান” চলচ্চিত্রটি
মুক্তি পাওয়ার পর বিশাল সাফল্য এসেছিল। সবাই আশা করেছিল এই ছবির পরে কিশোরগঞ্জ থেকে বিপুল’দাকে একজন কনিষ্ঠ মুক্তি যুদ্ধের কন্ঠশিল্পী হিসেবে কোন পদকের জন্য বিবেচনা করা হবে। দুঃখজনক ভাবে বাস্তবতা হলো প্রতিযোগিতার দৌড়ে দাদা টিকেই থাকতে পারেন নি। তবুও মিতালি মুখার্জির গানের ভাষায় বুকে আশা রেখে বলি মরণোত্তর পদক দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করার এখনও সুযোগ আছে। আমি সবাইকে অনুরোধ করছি আগামী বছরের একুশে পদক তালিকায় বিপুল’দার নামটি যেন রেখে তাকে সম্মানিত করা হয়। দেশে বিদেশে অবস্থানরত কিশোরগঞ্জ এর সকল জ্ঞানী, গুনী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যক, সাংস্কৃতিক ও সঙ্গীত পিপাসু মানুষ এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিপুল দা, আপনি কিশোরগঞ্জ এর গর্ব। আপনি পদক না পেলেও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কিশোরগঞ্জবাসী তথা দেশবাসীর হৃদয়ে থাকবেন অনন্ত কাল। কারন আপনাদের মত অকুতোভয় বীর সেনানীদের জন্যই বাংলার পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আভায় উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। দেখতে পেয়েছিলাম সুনীল আকাশ। প্রণাম হে মুক্তি সংগ্রামের শব্দ সৈনিক।
সূএঃ কিশোরগঞ্জ বিচিত্রা