সব কাজ গোপনে করতাম, সামনে রাখতাম বঙ্গবন্ধুকে

আ স ম আবদুর রব। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও গেরিলা যোদ্ধা। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রনেতা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এই মুক্তিপাগল নেতার হাতেই প্রথম উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সে পতাকা আগুন ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। বীজ বোনা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। পতাকা উত্তোলনের সেই সব উত্তাল দিন নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে পূর্বপশ্চিম।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিক মাহমুদ। ছবি তুলেছেন নাজমুল হাসান।

৭১’ সালের ২ মার্চ কোন প্রেক্ষাপটে পতাকা উত্তোলণের সিদ্ধান্ত নিলেন?
আ স ম আবদুর রব: ২ মার্চ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। শুধু পতাকা উত্তোলন নয়, এটি একটি দেশ, জাতি। জুলফিকার আলী ভুট্রো ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপ-আলোচনা চলছিলো। কিন্তু জাতির মধ্যে একটা দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব কাজ করছিলো যে, এতকিছুর পরও আবার পাকিস্তান থাকবে দুই অংশ মিলে। সে মুহুর্তে আমরা পতাকা উত্তোলন করলাম। এটি জাতিকে একটা দিক নির্দেশনা দিয়েছে যে, কোনো ধরনের আপস আমরা করবো না। এই দিনেই বাঙালি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের স্বাধীনতার পতাকা উড়তে দেখলো বাংলার আকাশে।

পতাকা উত্তোলনের স্মৃতি বলবেন কি?
আ স ম আবদুর রব: স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসে’র পরিকল্পনায় ১ মার্চ (১৯৭১ সাল) বিকেলে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় । ওই রাতেই ইকবাল হলে আমার রুমে পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠানের। সেই দিনের সমাবেশ ছাত্র জনসভায় পরিণত হয়। ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন, সিরাজুল আলম খান, নিউক্লিয়াসের নেতা রাজ্জাক ভাই, কাজী আরেফ ভাইদের নির্দেশ ছিলো- পতাকাটি আমার হাতে দেবেন, এরপর আমি উত্তোলন করবো।
সভা শুরু হলো। সবাই চিৎকার করে বললো, আমরা শুনতে পাচ্ছি না, দেখতে পাচ্ছি না। এরপর উঠলাম টেবিলের ওপর। তখন বলছে দেখতে পাচ্ছি না। এরপর আমরা কলাভবনের পশ্চিম বারান্দার ওপরে উঠে বক্তব্য শুরু করলাম। নূরে আলম সিদ্দিকী সভায় সভাপতি ছিলেন। আমার বন্ধু আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ ও আমি বক্তৃতা করছিলাম। তখন শেখ জাহিদ বড় একটা বাঁশের মাথায় বেধে একটা পতাকা নিয়ে আসলো। আমার হাতে দেওয়ার পরে স্বাধীনতার চেতনায় তা উত্তোলন করলাম। তখনই সারা মাঠে একটা জোড়ালো আওয়াজ হলো। যা জানান দিলো, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

ছাত্রলীগের কি ধরণের ভূমিকা ছিলো ওই সময়?
আ স ম আবদুর রব: ছাত্রলীগের তখন দুটি ধারা ছিলো- একটা আপোষমুখী, অন্যটা স্বাধীকার আন্দোলনের লক্ষে বিপ্লবী ধারা। আমরা ছিলাম বিপ্লবী ধারায়। আফতাব, রফিক, বদিউর, মধু স্লোগান দিচ্ছিলো, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ‘পাঞ্জাব না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’। লাফিয়ে লাফিয়ে স্লোগান দিতে দিতে অনেকেই সেদিন আহত হয়েছিলেন। সেটি আমার কাছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। যার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

ওইদিন আশেপাশের অবস্থা কেমন ছিলো?
আ স ম আবদুর রব: সেটা বলতে আমার গাঁ শিউরে ওঠে। ওইদিন পুরো দেশে কারফিউ ছিলো। এরমধ্যেই সূর্য্য ওঠার পরে আবালবৃদ্ধবণিতা ৮টার মধ্যে কলা ভবনের চারদিকে শাহবাগ, জগন্নাথ হল, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক এলাকায় এত মানুষ ছিলো যে, গাছ আর কোনো দালান দেখা যায়নি। অপরদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্কসহ চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছিলো। সেই অস্ত্র থেকে যদি একটা গুলিও বের হতো তবে মানুষ তো দূরের কথা কোনো ঘাসও খুঁজে পাওয়া যেত না। সেদিন কোনো ভয় বা আত্মীয়দের মায়া তখন স্মরণ ছিলো না আমাদের। আমরা এতটাই পাগলপাড়া ছিলাম যে, একটা বিষয় কাজ করতো, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জীবন দিয়ে হলেও দেশ স্বাধীন করতে হবে।

পতাকা উত্তোলনের পিছনের কোনো পেক্ষাপট?
আ স ম আবদুর রব: ৭০’ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহরুল হককে কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমরা প্রথম স্লোগান দিচ্ছিলাম, স্বাধীন বাংলার প্রথম শহীদ সার্জেন্ট জহরুল হক। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ৭১’ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তার কবরে ফুল দিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে মেয়েদের সাদা জুতো, সালোয়ার-কামিজ ও কপালে লাল ফিতার মধ্যে লাল রঙের বৃত্তের মধ্যে সোনালী, তার মধ্যখানে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে ‘জয় বাংলা’ লেখা ছিলো। তা নিয়ে মার্চ করে পল্টন ময়দানের দিকে অগ্রসর করলাম। সেটা ছিলো সার্জেন্ট জহরুল পতাকা। সেটি ৭ জুন যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে দেই, তা ছিলো জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা। লক্ষ্য ছিলো, এটি একদিন স্বাধীন দেশের পতাকা হবে। এই কাজগুলো আমরা গোপনে করতাম। সামনে রাখতাম বঙ্গবন্ধুকে।

জাতীয় পতাকার যত্রতত্র ব্যবহারকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আ স ম আবদুর রব: এটা একেক দেশের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো একটা খেলায় জিতলে, মাছ ধরতে গেলে, পাহাড়ে উঠলে, কোনো কিছু অর্জন করলে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিশেষ দিন ছাড়া সাধারণত পতাকা উত্তোলন হয় না। এটাকে যথাযথভাবে সম্মাণ প্রদর্শন করা জাতীয় দায়িত্ব। রাষ্ট্র থেকেই পতাকা কিভাবে ব্যবহার ও উত্তোলন হবে তার দিক নির্দেশনা ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে মানুষের চেনতা ও আবেগের জায়গাটি ভিন্ন। কেউ হয়তো পতাকা দিয়ে বেঁধে ঢোল বাজাচ্ছে। সে মনে করছে, জাতীয় পতাকার উপরে ঢোল বাজিয়ে সম্মান প্রদর্শন করছে। তাই জাতীয়ভাবে কি করা হবে সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত থাকা দরকার।

রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন পতাকার কতটুকু মর্যাদা আমরা রাখতে পেরেছি?
আ স ম আবদুর রব: যে চিন্তা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, আমরা পতাকা পেলাম, মানুষ জীবন দিলো তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের আকাঙ্খা ছিলো, দেশের মানুষ এই রাষ্ট্রের মালিক হবে। সবাই তাদের যথাযথ অধিকার পাবে। কিন্তু এখন সব দলীয়করণ আর ব্যক্তির হাতে কুক্ষীগত করার মানসিকতা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ বাঙালী জাতিয়তাবাদী আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি।

এর পিছনে মূলত কারা দায়ি?
আ স ম আবদুর রব: স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেই পুরনো ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আইন-কানুন দ্বারা দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাই মৌখিক ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু দেশকে সত্যিকার অর্থে পুন:গঠন করতে পারিনি। দলীয় সরকার কায়েম থাকায় স্বাধীনতার সব স্বপ্ন ভেস্তে যাচ্ছে।

উত্তরণের কোনো পথ দেখছেন?
আ স ম আবদুর রব: দুই দলের কর্তৃত্ত্বমূলক রাজনীতি দিয়ে দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়। এখন সময়ের দাবি একটি শক্তিশালী তৃতীয় শক্তি গঠন ও তাদের হাতে ক্ষমতা যাওয়া। জনগণ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। কোনো এক সময় সেটি বিস্ফোরিত হবেই। তখন আবারো একটি মুক্তিযুদ্ধ করে জনগণ দেশের ক্ষমতা তাদের হাতে নিয়ে মহান স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। পূর্বপশ্চিম

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর