ঢাকা ১০:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উড়ল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত প্রথম পতাকা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪৫:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ মার্চ ২০১৬
  • ৫১৩ বার

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তখন বিক্ষুব্ধ জনপদ। স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব বাঙালির আর তর সইছিল না। প্রতিদিনই বাড়ছিল আন্দোলনের গতি। লম্বা হচ্ছিল মিছিল। যোগ হচ্ছিল নতুন কর্মসূচি। গন্তব্য তখন একটাই- স্বাধীনতা।

এলো ২ মার্চ। উড়ল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।

আগের দিন ১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ এক ফরমানে স্থগিত করলেন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন। বাঙালি বুঝে গেল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও ক্ষমতায় যাওয়া আর হচ্ছে না। স্বাধীনতার আন্দোলন ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোনো পথ নেই।

পাকিস্তানি শাসকদের সে মনোভাবের বিস্ফোরণ ঘটল পরদিন, ২ মার্চ। হাজার হাজার ছাত্র জমায়েত হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। বটতলার সে ঐতিহাসিক ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। সঙ্গে ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনের দিনটি ‘পতাকা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আজ সেই ঐতিহাসিক ২ মার্চ।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর বিশাল এই সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার ও শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করল ছাত্রসমাজ। সভার শুরুতেই তারা শপথ নিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন।

সভার শুরুতেই তারা শপথ নিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার।

সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন।

সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয়েছে বাঙালির জাতীয় পতাকা হিসেবে।

দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বোনা হয়েছিলো।

তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব বলেন, `২ মার্চ যখন পতাকাটা উঁচিয়ে ধরলাম তখন গোটা মাঠ জুড়ে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হলো। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।`

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বইতে শুরু করেছিলো মুক্তির সুবাতাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, `১৯৭১ সালে এই পতাকাটি আমাদের ভূখণ্ড ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আমাদের পরিচিতি তুলে ধরেছে।`

একাত্তরের সে রাতে হঠাৎ বেতারের মাধ্যমে ঢাকা শহরে জারি করা হয় কারফিউ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সে রাতেই বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে শহরের পথে পথে নেমে আসে জনতার স্রোত। কারফিউ ভেঙে নামে মিছিল। চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে স্লোগানে-‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

কারফিউ ভেঙে পুরো শহরে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। মুখোমুখি দাঁড়ায় পাকিস্তানি সেনারা। ডিআইটি অ্যাভিনিউ মোড় ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে ৯টায় জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে সামরিক বাহিনী। বিরাট এক জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউসের দিকে এগিয়ে গেলে গুলি চলে সেখানেও। একইভাবে গুলি চলে শহরের বিভিন্ন স্থানে কারফিউ ভঙ্গ করে পথে নামা জনতার ওপর।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা ডেকেছেন বঙ্গবন্ধু। সে জনসভা সর্বাত্মক সফল করতে আগে থেকেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি। জনসভাকে কেন্দ্র করে মুক্তিপাগল বাঙালির মধ্যে দেখা দেয় এক অভূত গণজাগরণ। সে জনসভা নিয়ে উদ্বেগে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও।

জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু কী স্বাধীনতার ডাক দেবেন? দিলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে-এমনতর ভাবনায় তোলপাড় শুরু হয় পুরো পাকিস্তানে।

একদিকে জনসভার প্রস্তুতি, অন্যদিকে বিক্ষোভ আন্দোলনে উত্তাল জনতা- গোটা দেশ রূপ নেয় অগ্নিগর্ভে। প্রতিটি বাঙালির চোখ-মুখে তখন পাকিস্তানি দখলদার হটিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনার প্রত্যাশা। সে লক্ষ্য পূরণে পূরণে উত্তাল মার্চের এদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হল বাঙালির দামাল ছেলেদের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

উড়ল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত প্রথম পতাকা

আপডেট টাইম : ০৯:৪৫:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ মার্চ ২০১৬

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তখন বিক্ষুব্ধ জনপদ। স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব বাঙালির আর তর সইছিল না। প্রতিদিনই বাড়ছিল আন্দোলনের গতি। লম্বা হচ্ছিল মিছিল। যোগ হচ্ছিল নতুন কর্মসূচি। গন্তব্য তখন একটাই- স্বাধীনতা।

এলো ২ মার্চ। উড়ল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।

আগের দিন ১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ এক ফরমানে স্থগিত করলেন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন। বাঙালি বুঝে গেল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও ক্ষমতায় যাওয়া আর হচ্ছে না। স্বাধীনতার আন্দোলন ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোনো পথ নেই।

পাকিস্তানি শাসকদের সে মনোভাবের বিস্ফোরণ ঘটল পরদিন, ২ মার্চ। হাজার হাজার ছাত্র জমায়েত হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। বটতলার সে ঐতিহাসিক ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। সঙ্গে ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনের দিনটি ‘পতাকা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আজ সেই ঐতিহাসিক ২ মার্চ।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর বিশাল এই সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার ও শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করল ছাত্রসমাজ। সভার শুরুতেই তারা শপথ নিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন।

সভার শুরুতেই তারা শপথ নিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার।

সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন।

সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয়েছে বাঙালির জাতীয় পতাকা হিসেবে।

দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বোনা হয়েছিলো।

তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব বলেন, `২ মার্চ যখন পতাকাটা উঁচিয়ে ধরলাম তখন গোটা মাঠ জুড়ে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হলো। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।`

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বইতে শুরু করেছিলো মুক্তির সুবাতাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, `১৯৭১ সালে এই পতাকাটি আমাদের ভূখণ্ড ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আমাদের পরিচিতি তুলে ধরেছে।`

একাত্তরের সে রাতে হঠাৎ বেতারের মাধ্যমে ঢাকা শহরে জারি করা হয় কারফিউ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সে রাতেই বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে শহরের পথে পথে নেমে আসে জনতার স্রোত। কারফিউ ভেঙে নামে মিছিল। চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে স্লোগানে-‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

কারফিউ ভেঙে পুরো শহরে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। মুখোমুখি দাঁড়ায় পাকিস্তানি সেনারা। ডিআইটি অ্যাভিনিউ মোড় ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে ৯টায় জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে সামরিক বাহিনী। বিরাট এক জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউসের দিকে এগিয়ে গেলে গুলি চলে সেখানেও। একইভাবে গুলি চলে শহরের বিভিন্ন স্থানে কারফিউ ভঙ্গ করে পথে নামা জনতার ওপর।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা ডেকেছেন বঙ্গবন্ধু। সে জনসভা সর্বাত্মক সফল করতে আগে থেকেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি। জনসভাকে কেন্দ্র করে মুক্তিপাগল বাঙালির মধ্যে দেখা দেয় এক অভূত গণজাগরণ। সে জনসভা নিয়ে উদ্বেগে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও।

জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু কী স্বাধীনতার ডাক দেবেন? দিলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে-এমনতর ভাবনায় তোলপাড় শুরু হয় পুরো পাকিস্তানে।

একদিকে জনসভার প্রস্তুতি, অন্যদিকে বিক্ষোভ আন্দোলনে উত্তাল জনতা- গোটা দেশ রূপ নেয় অগ্নিগর্ভে। প্রতিটি বাঙালির চোখ-মুখে তখন পাকিস্তানি দখলদার হটিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনার প্রত্যাশা। সে লক্ষ্য পূরণে পূরণে উত্তাল মার্চের এদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হল বাঙালির দামাল ছেলেদের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি।