শিব ও পটুয়ার নকশায় আজকের জাতীয় পতাকা

শিবনারায়ণ দাশই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রকৃত নকশাকার। তার হাত দিয়েই প্রথশ নকশা হয় পতাকাটির। পরে সে নকশাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান লাল সবুজ বৃত্ত খচিত পতাকার রুপ দেন পটুয়া কামরুল হাসান।

যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরণের বিতর্ক উঠেছে। আলোচনা চলছে এখনো। একপক্ষের দাবি, শিবনারায়ন দাশই পতাকার নকশাকার। অন্যপক্ষ বলছেন, পটুয়া কামরুল হাসানের নাম।

তবে শুধু এ দু’জনই নন, জাতীয় পতাকার জন্মবৃত্তান্ত ও নকশার সঙ্গে মিশে রয়েছে আরও রাজনীতিকের নাম, শ্রম ও মেধা।

অবশ্য পতাকার নকশাকার হিসেবে শিবনারায়ন দাশ ও পটুয়া কামরুল হাসানের নামই উল্লেখযোগ্য। তাদের আঁকা নকশা সংযোজন ও পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে রুপ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকার।

এ বিষয়ে জাতীয় পতাকার প্রথম নকশাকার শিবনারায়ণ দাশ বলেন, জাতীয় পতাকা আমাদের সম্মান, সংগ্রাম ও আবেগের কেন্দ্রস্থল। এ পতাকা এবং দেশের মর্যাদা রক্ষায় ঐকবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে বিতর্ক করতে চাই না।

আর ইতিহাস বলছে, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ন দাশের নকশা করা পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ, ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল।

জয়ধ্বনি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নাজমুল হোসেন বলেন, জাতীয় পতাকার মুল ডিজাইনার কামরুল হাসান নয়, শিবনারায়ণ দাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) লাল সবুজের মূল পতাকার ডিজাইন করেন শিবনারায়ণ দাশ। ওই পতাকায় লাল অংশের মাঝে একটি মানচিত্র ছিল। পরবর্তীতে কামরুল হাসান মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলে লাল বৃত্ত সংযোজন করেন।

পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার কারণ ব্যাখ্যা করে শিব নারায়ণ দাশ বলেন, পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেয়া হয় এবং স্বাধীনতার পরে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে সেটি সরিয়ে বর্তমান রুপ দেওয়া হয়।

মানচিত্র সরানোর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পতাকা সঠিকভাবে তুলে ধরা জাতির কর্তব্য। কিন্তু মানচিত্র থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে পতাকা আঁকার জন্য মানচিত্রটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।’

তবে ১৯৬২ এর নিউক্লিয়াসের সদস্য ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ তার ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বইয়ের পৃষ্ঠা-৭৭ এ লিখেছেন-

‘১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেয়ার কর্মসূচি নেয়া হয়। ওইদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে একটা বাহিনী গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদাণ করা হবে। এবারও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় আ স ম আবদুর রবকে। নিউক্লিয়াস থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটালিয়ান ফ্ল্যাগ’ হিসেবে প্রদান করা হবে।’

‘৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আসম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরীর কথা জানাই। এই ফ্ল্যাগ পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন যে এই পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন যে লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি। বটলগ্রিন জমিনের উপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এই নকশা ‘নিউক্লিয়াস’ হাইকমান্ডের অনুমোদন নেয়া হয়।’

‘তখন আমি প্রস্তাব করি যে, এই পতাকাকে পাকিস্তানী প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত। কারণ হিসেবে দেখালাম যে, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ‘ভারতের হাত আছে’ বা ‘ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে’ অথবা ‘ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ বলে প্রচারণা চালায়। তাছাড়া এই সময় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’ নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এই কল্পিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্র তা বিলি করত। এই ধরণের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালী আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার আমার এই প্রস্তাবে সবাই একমত হন।’

ওই বইয়ে আরও বলা হয়-

‘পতাকার কাপড় কিনে তৈরী করতে পাঠান হয় কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, মনিরুল হক, হাসানুল হক ইনু ও শহীদ নজরুল ইসলামকে। এরা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো নামক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের পাক ফ্যাশন থেকে তৈরি করায়। যে দর্জি এই পতাকা তৈরি করেন তিনি ছিলেন অবাঙালি এবং ইতিবৃত্ত না জেনেই এই পতাকা তৈরী করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ওই দর্জি পাকিস্তানে চলে যান।’

‘সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালী মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এই সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাস (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নং কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হল বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালী রং কিনে আনা হল। শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হল।’

জাতীয় পতাকার প্রথম উত্তোলক ও জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব তার লেখা একটি প্রবন্ধেও একই কথা বলেছেন-

‘ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইকবাল হল। ১১৬ নং কক্ষে থাকতাম। এ কক্ষে বসে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠা বাঙ্গালির আর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে আমি, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পতাকা তৈরির পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ আঁকতে জানে না। সবাই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন সম্ভবত শাজাহান সিরাজ জানান, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাস ঢাকায় আছে। সে ভালো পোস্টার লেখে।’

‘সবাই আলোচনা করে পতাকার কাঠামো তৈরি করেন। মানচিত্র অংকন করেন শিবনারায়ণ দাস। নীলক্ষেতের নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স (বিহারি মালিক) পতাকা তৈরি করে দেন।’

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাজাহান সিরাজ চ্যানেল আইয়ের এক টকশোতেও (তৃতীয় মাত্রা, চ্যানেল আই : ২৭.০৩.২০১১) পতাকার নকশা নিয়ে কথা বলেছেন-

‘পতাকা নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। তখন ১১৬ বা ১১৮, হয়তো এখন ১১৬ হয়েছে, (বর্তমান জহুরুল হক হল, তখনকার ইকবাল হল) আমি আর রব ভাই ভাই থাকতাম ওখানে। এটা হয়তো সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমেই এসেছে, কিন্তু এমনভাবে এসেছে যে আমি যে প্রস্তাব দিয়েছি সেটা সিরাজ ভাই আমাকে বলে দেয়নি, রব ভাইকে বলে দেয়নি। কাজী আরেফ হয়তো জানে কিন্তু উনি বলে দেননি যে এইটা করতে হবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমি প্রস্তাব দিয়েছি লাল সূর্য। রব ভাই প্রস্তাব দিয়েছে জমিন। এর আবার মধ্যস্থতা করে দিল আমাদের মার্শাল মনি। তারপর এক্সেপ্ট হয়ে গেল। আরেফ ভাই তখন আমার কাছে উদ্ভট মনে হওয়া একটা প্রস্তাব দিল। বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের একটা ম্যাপ দিতে হবে। আমি বললাম যে এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। সে বললো যে কারণ আছে। যে কোনো আন্দোলনকে ভারতের সঙ্গে ট্যাগ করা হয়। আমরা অন্য কোনো অংশের স্বাধীনতা চাই না। আমরা এই অংশের স্বাধীনতা চাই। বিশ্বাস করেন, সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম।’

‘এটা ১০, ১২জন যে জানতো না, তা না। তারা বাইরে ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলেরা জানতো। ইনু হয়তো কিছু জানতো। কিন্তু সিদ্ধান্তটা আমরা চার পাঁচজনই নিয়েছি। আজকে বলা হচ্ছে শিবনারায়ন দাশ না কী এটার সবকিছু। আমরা তো উনাকে ডেকে আনলাম এটা রেডি করার পরে। কাপড় এনে, খসরু ভাইকে দিয়ে দোকান থেকে কাপড় সেলাই করিয়ে যখন আমাদের কাছে আসলো তখন প্রশ্ন উঠলো যে আর্টিস্ট পাবো কোথায়। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। স্বপন চৌধুরীকে দিয়ে তখন হল থেকে তাকে ঘুম থেকে টেনে নিয়ে আসা হল। সে এটা এঁকে দিল। হ্যাঁ, সেও আমাদের পার্ট, যেহেতু সে এঁকেছে। কিন্তু এটা নিয়েও অনেক খেলা খেলার চেষ্টা করা হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর