সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি আজও

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো বাংলা ভাষা ব্যবহার হচ্ছে না। মানছে না এ সংক্রান্ত আইনের বাধ্যবাধকতাও।

রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের উদাসীনতার জন্যই, সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা সম্ভব হয়নি বলে অভিমত ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টদের।

অথচ বেতার ও দূরদর্শনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। একটি ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের পৃথকদুটিবেঞ্চ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে উপসম্পাদকীয়তে ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব রকিব উদ্দিন আহমেদ নিবন্ধটি পরদিন আদালতের নজরে আনেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই দিন আদালত স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। আদেশে বেতার ও দূরদর্শনে বিকৃত উচ্চারণ, ভাষা ব্যঙ্গ ও দূষণ করে অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

রুলে বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে কেন পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়াসহ কয়েকটি বিষয়ে রুল দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ ও বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নির্ধারণ করতে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়।

বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করতে বলা হয়। ওই রুল নিষ্পত্তি হয়নি।পরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়। কমিটি ওই বছরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়। কমিটির সুপারিশে বলা হয়, হিন্দি চ্যানেলের ছড়াছড়ি বাংলা ভাষার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

দুই বছর পর সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। রিটে বলা হয়, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ৩ ধারা অনুসারে সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে (বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত) চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সাওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ আইনটি পাস হয়। কিন্তু ২৬ বছরেও আইনটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। শুনানি নিয়ে আদালত ১৭ ফেব্রুয়ারি রুল জারির পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন।

আদেশে বলা হয়, এক মাসের মধ্যে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও তৎসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হলো। রুলে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ, আইন, স্বরাষ্ট্র, সংস্কৃতি, তথ্য ও শিক্ষাসচিবকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্ত আদালত আদেশ দিলেও এর বাস্তবায়ন এগোয়নি।

16980এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি বাংলা ভাষা চালু করা প্রয়োজন। সাধারন মানুষ বাংলাভাষার কদর বোঝেন। কিন্ত আমাদের সমাজে একশ্রেনীর মানুষ আছেন যারা ছেলে মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চান। বিয়ের কার্ড ইংরেজিতে চাপানো পছন্দ করেন। এ রকম মনমানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকটে আব্দুল বাসতে মজুমদার বলেন, সকল ক্ষেত্রে বাংলাভাষার প্রচলন হোক সেটা আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি। তবে তা এক দিনে প্রতিষ্ঠিত হবেনা, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী জানান, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এ ছাড়া ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণয়ন করা হয়। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ এর ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, দেশের সকল অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন করা হবে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন করা হয়নি।

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, মাতৃভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পার হওয়ার পর আজও রক্তভেজা একুশের চেতনা কিংবা বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র হয়নি। বাংলা ভাষার ব্যবহার যারা টিকিয়ে রাখতে চান তাহলে বায়ান্নর রক্তঝরা দিনকে স্মরণ করে, ভাষার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মাতৃভাষা প্রীতির মাধ্যমে দেশপ্রেম গড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধি পায়।

আহমদ রফিক বলেন, ‘সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তার মানে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে বিদেশি ভাষা ছেয়ে গেছে। চেতনায় রাখছেন, মুখে বলছেন বাংলা ভাষার কথা; আর বাস্তবে তার উল্টো- এটাতো স্ববিরোধিতা।’

শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলা ভাষা ব্যবহারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শ্রেণী বৈষম্যও বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ানোর পথে অন্তরায় বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর