বাংলাকে `রাষ্ট্রভাষা’ করুন

অধ্যক্ষ আসাদুল হক, স্বাধীন বাংলাদেশ যেটি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জন্ম নিয়েছে এবং যে দেশের সংবিধানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা সেই দেশে ২০১৬ সালে এসে এমন দাবি করা চমকে দেবার মতো। তবুও আমি দাবিটা তুলছি এবং দৃঢ়ভাবে এই দাবির সপক্ষে আজীবন লড়াই করার অঙ্গীকার করছি।

বস্তুত বাংলাদেশে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বাংলা হরফ নিয়ে প্রচুর মাতামাতি থাকলেও আসলে বাংলাদেশে বাংলার সেই মর্যাদা নেই। ২০১৬ সালে এসে জানলাম যে এটি কাগজে কলমে রাষ্ট্রভাষা হলেও তাতে নাকি ত্রুটি আছে এবং এজন্য বহু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া যায় না। আদালত তেমন একটি জায়গা। এর বাইরেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এর প্রয়োগে আছে চরম অবহেলা। এজন্য বাংলাদেশে বাংলাকে বাঁচাতে হলে একে সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

বাংলা ভাষা যে কেমন দুরাবস্থায় আছে তার খবরটি পেলাম সেদিন। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট তার এক রায়ে অফিস আদালতে, সাইনবোর্ডে, ব্যানারে বাংলা লেখার নির্দেশ দেয়ায় বাংলাদেশি বাঙালি দুই আইনজীবী (ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ ও ব্যারিস্টার তানজীব) সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। খবরটি শোনার পর আমি বিস্মিত হয়েছি। কোনো বাঙালি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যেতে পারে সেটি ভাবতেও পারিনি। তাদের মতে বাংলা লেখা হলে সংবিধান লঙ্ঘন হবে। তাদের কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, তাহলে বাংলা কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়? সংবিধানে কি এর অন্যথা আছে? যদি সেটি হয়ে থাকে তবে সবার আগেতো সংবিধানের সংশোধন করা দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুজন আইনজীবীকেই চিনি এবং তারা মেধাসম্পদ রক্ষার লড়াই করেন। তারা বাংলাভাষাবিদ্বেষী (!) সেটি ভাবতে আমার গা শিউরে ওঠে।

অন্যদিকে আমাদের ভাষার অবস্থাটি কি তার একটি সাধারণ বিবৃতি পেলাম ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ঢাকার শেরে বাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক সেমিনারে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভিার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ড. হাসান সারোয়ার একটি চমৎকার মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমরা ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজি শেখানোর জন্য অস্থির থাকি-কিন্তু ওরাতো বাংলাই জানে না। বাংলাদেশের শিক্ষার যখন এই অবস্থা তখন আমাদের উচ্চ স্তরের লেখাপড়ার জগৎটা বাংলাবিহীন হয়ে পড়েছে।

আমরা ভুলে গেছি যে, বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলনের সূচনা হয় তার অন্যতম দুটি কারণ ছিলো; বাঙালির ভাষাপ্রীতি ও ন্যায্য অধিকার আদায়। পাকিস্তানিরা যখন কেবল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে তখন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলার পক্ষে একটি যুক্তিসঙ্গত বিষয় ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার। যদিও ১৯৫২ সালে বাঙালিরা সেই লড়াইতে জয়ী হয় তবুও ভাষার আন্দোলন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রশাসনিক ও কারিগরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তৎকালে অপটিমা মুনির টাইপরাইটার প্রস্তুত করা ও সরকারি অফিসে বাংলা প্রচলন করার সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা একটি ঐতিহাসিক কাজ ছিলো। কিন্তু এতো বছর পরও বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে বাংলা তার ন্যায্য মর্যাদা পায় না। এখনতো আমরা ভাষা আন্দোলনের উল্টো পথে হাঁটছি। আমাদের জীবনের সকল স্তরে বাংলা প্রচলনের বদলে এখন লড়াই হচ্ছে কতো দ্রুত আমরা জীবন থেকে বাংলা ভাষাকে বিদায় করতে পারি। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিজীবন-সর্বত্র বাংলা ভাষার বিদায়ের ঘণ্টা। সেজন্যই বলতেই হচ্ছে, বাংলা ভাষার বেঁচে থাকার পথটা মোটেই আর মসৃণ নয়।

এখানে দেশের অতি সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষ, স্বল্পশিক্ষিত বা গ্রামের মানুষ বাংলা চর্চা ব্যাপকভাবে করে। কিন্তু বাংলা ভাষা শহুরে বাংলাদেশির জীবন-জীবিকা, উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ আদালতে ‘বেঙ্গলি’ হয়েই আছে। একুশের প্রভাত ফেরিতে আসা বিত্তবানদের অনেকেই শহীদ মিনারে ফুল দিলেও মাতৃভাষার প্রতি কোনো দরদ পোষণ করেন না। দিনে দিনে সেই অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। শতভাগ আমন্ত্রিত বাংলাদেশি বাঙালি হলেও এমনকি বিয়ের দাওয়াতেও এখন আর বাংলা হরফ ও ভাষা বিরাজ করে না। এমনকি ডিজিটাল করার নামে বাংলা ভাষা বিদায় হচ্ছে। সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতে সবার আগে ইংরেজি ঠাঁই পায়। সরকারি অফিসেও কাজে কর্মে সুযোগ পেলেই ইংরেজিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক সময়ে আমাদের সরকারি ব্যাংকগুলো বাংলায় কাজ করতো। ডিজিটাল করার নামে এখন সেগুলো ইংরেজি হয়েছে।

বাংলা ভাষার সফটওয়্যার উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সরকারি তহবিলে টাকা রেখেও বাংলা ভাষার জন্য সেই টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। ভাষার উন্নয়নে যেসব কাজ করা উচিত সেইসব কাজের দিকে নজর না দিয়ে সরকার এমনসব কাজ করছে যা না করলেও কোনো ক্ষতি নেই। সরকারের নানা অঙ্গ বিড়ম্বনা সৃষ্টি করা ছাড়া ভালো কিছু করছে না। যেখানে আমাদের এখন ওসিআর, টেক্সট টু স্পীচ, স্পীচ টু টেক্সট, স্পেল ও গ্রামার চেকার ইত্যাদি সফটওয়্যারের প্রয়োজন সেখানে তারা বাংলা হরফ বানিয়েছে। ওরা জানে যে, বাংলা হরফ বানানোর কাজটি বেসরকারি খাত অনেক আগেই করে ফেলেছে। বিজয়-এর ফন্টের সংখ্যা শয়ের বেশি। তবুও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর জন্য হরফ বানানোর একটি তামাশা তৈরি করা হয়েছিলো। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলো এটুআই।

অন্যদিকে বাংলা ভাষার নামে প্রতিষ্ঠিত দেশে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। উচ্চশিক্ষা বা বিজ্ঞান শিক্ষায় বাংলা ভাষা প্রবেশ করতে পারে না। বাংলা একাডেমি এক সময়ে এসব বিষয়ে পাঠ্য বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু এখন সেই ধারাটিও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।

কোন একটি সরকারি অনুষ্ঠানেও যদি একজন বিদেশি নাও থাকে তবে সেই অনুষ্ঠানের ভাষা হয়ে যায় ইংরেজি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতো বাংলা ব্যবহার করলে তাদের অপমান হয় তেমন একটি ভাব দেখায়। যতো বড় বড় কথাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশে অফিস আদালতে বাংলার ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ার বদলে কমছে। উচ্চশিক্ষায়ও বাংলা নিষিদ্ধ। ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলা ছাড়া আর কোথাও বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতিও নেই। বরং এই কথাটি বলা ভাল যে ডিজিটাল করার প্রথম ও প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাকে বিদায় করা।

বাংলা ভাষার চরম বিকৃতি এফএম রেডিওগুলোতে করা হয়। টিভির অনুষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি বাংলার মিশ্রণে এমনসব নামকরণ করা হয় যা শুনলে কষ্ট লাগে। মোবাইলের এসএমএসতো ইংরেজিতেই হয়। কম্পিউটারেও রোমান হরফে বাংলা লেখা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে সরকারের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান রোমান হরফে বাংলা লেখাকে উৎসাহিত করে।

আমরা দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট গড়ে তুলেছি। কিন্তু সেই ইন্সটিটিউটটি বাংলা ভাষা বা বিশ্বের কোনো ভাষার কোনো কাজে লেগেছে বলে এখনও প্রতীয়মান হচ্ছে না। দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার ভাষাগুলোর প্রতিও এই প্রতিষ্ঠানের কোনো দৃষ্টি নেই।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কতোটা তার একটি নমুনা আমি এখানে উল্লেখ করতে পারি। একটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রতি বিয়ের কার্ড বিক্রির ওপর একটি জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের বিয়ের কার্ডে বাংলা হরফের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। বাংলা ভাষা ও হরফ ব্যবহার করে স্বল্পশিক্ষিত, গ্রামের মানুষ বা গরীব মানুষ। এতে প্রতীয়মাণ হয় যে বাংলা ভাষার প্রতি এই দেশের বাংলা ভাষাভাষীদের একটি শ্রেণির দরদ নেই।

যে দেশ ভাষার নামে সৃষ্টি হয়েছে, যে দেশ ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে সেই দেশে বাংলা ভাষা চরমতম অবহেলার বিষয় হয়ে থাকবে সেটি মেনে নেয়া কেমন যেন ভীষণ কষ্টের মনে হয়। মনে হয় আবারও বরকত, সালাম, রফিক জব্বারের রক্তের আহ্বান জানাচ্ছে এই মাতৃভাষা।
আমি আশা করবো বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হবে। অতি সংক্ষেপে তার কয়েকটির কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই।

ক. সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে দেশীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। সংবিধানে যদি সেটি স্পষ্ট না থাকে তবে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

খ. যেখানে বিদেশি ভাষা ব্যবহার অত্যাবশ্যক সেখানেও সেই ভাষার সাথে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে।

গ. দেশের কোথাও কোনো সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার বা প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হয় এমন সকল কিছুতে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। এমনকি অন্য ভাষা ব্যবহার করা হলেও তাতে বাংলা ভাষা বাংলা হরফেই প্রকাশ করতে হবে।

ঘ. বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কোথাও বাংলা হরফ ছাড়া অন্য কোনো হরফে বাংলা লেখা যাবে না।

ঙ. উচ্চশিক্ষাসহ শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। বিদেশি ভাষায় বিশেষ বিষয় পড়ানো হলেও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা শেখাতেই হবে।

জ. বাংলাদেশের সকল দূতাবাসে বিদেশিদের বাংলা শেখার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঝ. ডিজিটাল যন্ত্রে ও ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বাংলার বদলে অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করতে হবে।

ঞ. রাষ্ট্র বাংলা ভাষার উন্নয়নে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করবে। হাওরবার্তা প্রধান সম্পাদক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর