ঢাকা ০২:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধারাপাত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:২৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
  • ৪১৭ বার

তাসলিমা আক্তার বাসের আধা আধি পেট অংশের দিকে জানালার পাশের একটা সীটে বসে আছে দীপা। প্লেনে পাশাপাশি এই সীট গুলোর নাম আইল আর উইনডো। একটা ম্যাগাজিনে পড়েছিলো সে। দীপার এটা খুব প্রিয় সীট। সবসময় জোটেনা। ভাগ্য ভালো থাকলে কেবল পাওয়া যায়-এই যেমন আজ। রোজদিনের মতো আজো অফিস যাবার জন্যই বেড়িয়েছিল সে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতেই মন ঘুরে গেলো। গলায় অসুখ অসুখ ভাব এনে জলিল ভাইকে ফোন করলো,
-স্লামালেকুম জলিল ভাই। কাল রাত থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। মাথা ব্যথা, গাটাও একটু গরম গরম।
-ওকে, আমার মনে হয় তাহলে আজকে তুমি অফিসে এসোনা। বাসায় রেস্ট করো। ফোন খোলা রেখো। প্রয়োজন হলে ফোন দিবো। আর শুনো, শরীরের একটু যত্ন টত্ন নিও। শেষের কথাটায় কান্না পেয়ে যায়। দরদ দিয়ে কেউ কিছু বললে দীপার কান্না পায়। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।

জানালা সীটে বসে থাকতে দীপার খুব ভালো লাগছে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করা হয়নি। কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চায়। একটু ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলে:
-আফা কই যাইবেন, ভাড়া দেন
-বাসটা কোথায় যাবে?
-আপনে কই যাবেন, ছেলেটি হাসে। হাসিতে সহজ সারল্য। চোখদুটোও মায়া মায়া। ঠিক যুবক না, কৈশরের চেয়ে একটু বেশি।
-বাস যেখানে গিয়ে শেষ হবে আমাকে সেখানেই নামিয়ে দিও।
-গাড়ি যাইব বুড বাজার। ঠিক আছে আপনে বসেন, আমি নামায় দিব।

তার মানে দীপা উঠেছে গাজীপুরের বাসে। শেষ গন্তব্যস্থান বোর্ডবাজার। যেখানেই যাক দীপার কোনো অসুবিধা নাই। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারলেই হলো। দীপারা পাঁচ বোন। এতো সন্তান আজকাল কোনো ফ্যামিলিতে দেখা যায় না। প্রথম কন্যার পর পুত্র লাভের আশায় আরো চার কন্যা। দীপা পাঁচের মধ্যে চতুর্থ। বাড়িতে প্রথম এবং শেষ সন্তানের গুরুত্ব বেশি থাকে। মেঝো সেজো পেজোরা বৈশিষ্ট্যহীন। দীপা সবসময়ই তাই। কখনো তাকে কেউ নিন্দা মন্দ করে না। কারণ সে বৈশিষ্ট্যহীন। উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েদেরকে মানুষ সমালোচনা করে। মেয়ে প্রতিবাদী হলে তার সাতকাহন। গালে চড় খেয়েও মুখে রা নেই টাইপ মেয়েদেরকে সবাই পছন্দ করে। দীপাকেও তাই। ওর সব গুলো শাড়ী প্রায় একই রকম। প্রতিদিনের সাজেও ব্যতিক্রম নেই কোনো। সাদা পাউডার, চোখে কাজল, হালকা কোটের মেরুন লিপস্টিক। ভিজে চুল ক্লিপে আটকানো হাতখোপা। ব্যস, এটুকুনই।

মামুনের সাথে যেদিন প্রথম দেখা করতে ঘরের বাইরে গিয়েছিল সেদিন তার পরনে ছিলো নীলের মধ্যে কালোর ডুরে দেয়া একটা তাঁতের শাড়ি। হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি ঝন ঝন করে বাজছিলো। কালো ছিপছিপে গড়নের লম্বা যুবক মামুন। একমাথা কদম ফুলের মত ঝাঁকড়া চুল। ঠোঁটদুটো তস্য কালো। ক্লাস সেভেন থেকে আগুনে পোড়া ঠোঁট। রিক্সা থেকে নেমেই স্টার সিগারেট ধরিয়েছিল সে। একটু মুচড়িয়ে দীপা বললো,
-এতো সিগারেট খান কেন। তাও আবার সস্তার?
-স্টারের মাহাত্ম্য তুই কি বুজবিরে দীপু। দুনিয়াতে এই হলো একমাত্র সিগারেট। ফুল ফ্লেভার্ড। আহ নিকোটিন!!

বাস থেকে নেমে দীপা একটা হোটেলের দিকে এগোয়। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ভাতের হোটেল। জ্যামে বসে থেকেই দুপুর হয়েছে। আজকাল ঢাকা শহরে জ্যামের যা’চ্ছে তাই অবস্থা। কোনার দিকের একটা টেবিলে বসে সে তার টিফিন বক্সটা বের করে। তিনটা রুটি আর সবজি ভাজি। মামুন একদিন তাকে শীতলক্ষ্যায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে পানি আর পানি। ওরা দুজন ছইয়ের নৌকায়। পানিওযে এতো সুন্দর হয়!! পানিতে পরে আকাশ ভিজে যাচ্ছে। নদীর পারের কৃষ্ণচূড়ার লাল ছায়া পানির কোলে চুপচাপ দুলছে।
-বুজলি দীপু, ভালোবাসা জিনিসটা নিয়তির মতো। একবার কেউ কাউকে ভালোবাসলো, তো তার আর নিস্তার নাই। সারাজীবন বুকের মধ্যে অনেক যত্নে বয়ে বেড়াতে হয়। এই যেমন আমি। চোখ খোলা থাকলেও তুই, ঘুমালেও তুই। আমি রোদের দুপুরে বাজার করে ঘেমে বাড়ি ফিরলে একগ্লাস ঠাণ্ডা লেবু শরবত হাতে তুই। তোর থেকে এ জন্মে আমার আর মুক্তি নেইরে দীপু।
-আপনি বুঝি মুক্তি চান?
মামুন দীপার ফুপাত ভাই। বয়সের ব্যবধানটাও বেশি। ছোট বেলা থেকে আপনি করে বলা অভ্যাস। দিপা কখনো মামুনকে তুমি করে বলতে পারেনি। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা সে কখনোই বলতে পারে না। মামুন পারে। দীপা জাদু গ্রস্থার মত শোনে শুধু। মেয়েরা আজকাল কতকিছু পারে! নাচ গান কিংবা দু’ছত্র কবিতা লেখা। দীপার এসব কোনো গুণ নেই। সে খুব সাধারণ। তার সব কিছুই সাধারণ। একেবারেই সাদামাটা। ছইয়ের নৌকার ভেতর হঠাৎ দশদিশ ছাপিয়ে বাশের বাঁশিতে সুর তোলে মামুন। আরো অনেক কিছুর মত বাঁশির সুরটাও মামুনের আয়ত্বে। সুরের মায়ায় দুলতে থাকে দীপা। যেন আজ ওঝার বীণে সাপের মরণ।

মেধাবী ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গিয়েছিলো ক্যালিফোর্নিয়া। যাবার আগে ছায়াচ্ছন্ন ঘরে দীপার শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ মুছে মামুন বলেছিল:
-অপেক্ষা করিস দীপু। আমি একদিন তোর কাছেই ফিরে আসবো, নিকোটিনের গন্ধ হয়ে।
চিঠিটা পরশু দিপার হাতে এসেছে। অফিসের ঠিকানায়। আজকাল ইলেকট্রনিক্সের এই মহাযজ্ঞের দিনেও ওরা চিঠি লিখত পরস্পরকে। শেষ চিঠিটা মামুনের মতই স্মার্ট। “তোকেতো হীরের কথা বলেছিলাম দীপু। পাকিস্তানি মেয়ে। আমরা একসঙ্গে কাজ করি। গত রবিবার বিয়ের দিন ছিল। আমাদের জন্য দোয়া করিস। আর তুই অনেক ভালো থাকিস দীপু”।

ভাজিটা খেতে খুব মজা হয়েছে। মা যে কি করে এতো ভালো রাঁধে!! মার কাছ থেকে একসময় কৌশলটা শিখে নিতে হবে। আরেকটা রান্না শিখতে হবে, সেটা হলো শিং মাছের ঝোল। বাবা দরিদ্র নয় অন্তত মাসান্তে কারো কাছে হাত পাততে হয় না। আবার উদ্বৃত্বও কিছু থাকে না। কিন্ত তার এক বাতিক। ভালো মন্দ বাজার করা। খুঁজে খুঁজে খাটি দেশি জিনিসটা বের করেন কি করে যেন। দাম অনেক বেশি হলেও প্রায়ই শিং মাছ কিনে আনেন। মা টমেটো আর ছোট ছোট আলু দিয়ে একটু ঝোল মতন রান্না করেন সেই মাছ। দীপা জানে স্বর্গেও এতো মজার কোনো খাবার নাই।

সন্ধ্যার লগনে লগনে ঘরে ফিরে দীপা। নিত্য দিনের মত গেট খুলে দেয় মা। মাটির উঠোন পেরিয়ে সে তার ঘরে যায়। ভাদ্র মাস। দিনের কোনো ঠিক নেই। ক্ষণে রোদ ক্ষণে মেঘ। আজ বৃষ্টি হয়নি কিন্ত আকাশটা গুমরে আছে। মাঝে মাঝে হাহাকার করে জানান দিচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল শেষ করে ঘরে পরার একটা শাড়ি পরে। টেবিলে চায়ের কাপ ঢাকা দেয়া। তার পাশে একটা পিরিচে কয়েকটা সবজি পাকোরা। ধোঁয়া উঠা পাকোরার দিকে চেয়ে চিৎকার করে দীপা,
-অ মা, তেঁতুলের টক নাই?
-না রে, শেষ হয়েছে আর বানানো হয়নি। দেখি, শুক্রবারে বানাবো। তুই কাল অফিস থেকে ফেরার পথে আনাসের দোকান থেকে আধা কেজি লাল তেঁতুল আনিসতো।

পাকোরা শেষ করে দীপা চায়ে চুমুক দেয়। কোনো একদিন সুযোগ বুঝে মার ডান হাতটা কেটে ফেলতে হবে। কবে না কবে মরে যায়, তখন দীপাকে কে বানিয়ে দেবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা। দীপা একদিন এই কাজটা ঠিক করে ফেলবে। মা দীপার ঘরে কখন আসে সে টের পায় না। এই স্বভাব ছিল মামুনেরও। বিড়ালের মত চুপিচুপি ঘরে ঢুকতো। পেছন থেকে দুহাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করতো, “বলতো কে”? বোকা আর বলে কাকে? সে কি জিজ্ঞেস করার মত কিছু! আগে পিছে ডানে বামে এক মাইলের মধ্যে দিয়ে হেটে গেলে দীপা তার গায়ের গন্ধ পায়। ঈষৎ ঘামের সাথে মিশে থাকা নিকোটিনের তীব্র গন্ধ। একবার মামুনের সাথে বোটানিকেল গার্ডেনে গিয়েছিলো দীপা। ঢুকার মুখে অনেকটা জায়গা জুড়ে গোলাপের বাগান। কত বাহারী গোলাপ, লালেরও যে কত হাজার রকমের সেড! আর সে কি সুবাস! ফ্যাকাসেটে গোলাপি হাজারি গোলাপের ঝোপের সামনে গিয়ে গায়ের সাথে ঘেষেছিল সে মামুনের। শ্যাওলা রং সার্টের দু তিনটা বোতাম খোলা। হাজারি গোলাপের চেয়ে মামুনের বুকের গন্ধটাই বেশি ভালো লেগেছিল দীপার।

দীপা মুখ তুলে তাকায় মার দিকে,
-কিছু বলবে মা
-নাহ। তোর শরীর খারাপ নাকিরে দীপা। কেমন রোগাটে লাগছে
-আমি ঠিক আছি। মা তুমি বসো, আমি তোমার কোলে একটু শুই।
কিছু বুজতে না পেরেই মা বসেন। কোলের উপর মাথা রেখে শিশুর মত শুয়ে পরে দীপা-মানুষের সবচে নিরাপদ আর বিশ্বাসের জায়গা।
-মা, তোমার মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম আমার অনেক প্লাস্টিকের পুতুল ছিল। বৌ পুতুল জামাই পুতুল ছোট ছোট বাচ্চা পুতুল। মাঝে মাঝেই ওদেরকে হারিয়ে ফেলতাম। পুতুল হারানোর একটা বাতিক ছিল আমার। হারিয়ে ফেলে তারপর আমি খুব কাঁদতাম। তুমি তখন আমাকে কোলের ওপর শুইয়ে একটা গান গাইতে। মা, তুমি কি আজ আমার কপালে হাত রেখে সেই গানটা একবার গাইবে?
মা তার সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়ের কপালে হাত রাখে। দরদ ভরা গলায় গুন গুন করে-
-সো যা মেরি রাজকুমারী, সো যা…

ভাদ্র মাসের আসলেই কোনো বিশ্বাস নেই। এই ভর সন্ধ্যায় হঠাত ঝুপ ঝুপিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকালে গোসলের পর রাতের বাসি শাড়িটা পানিতে কেচে উঠানের দড়িতে মেলে দিয়েছিল দীপা। বিকেলে মা বোধহয় ঘরে তুলতে ভুলে গেছে। ভাদর সন্ধ্যার ঝুম বৃষ্টিতে উঠানের দড়িতে দীপার নীল পাড় কলাপাতা রং শাড়িটা একলা ভিজছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ধারাপাত

আপডেট টাইম : ০১:২৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

তাসলিমা আক্তার বাসের আধা আধি পেট অংশের দিকে জানালার পাশের একটা সীটে বসে আছে দীপা। প্লেনে পাশাপাশি এই সীট গুলোর নাম আইল আর উইনডো। একটা ম্যাগাজিনে পড়েছিলো সে। দীপার এটা খুব প্রিয় সীট। সবসময় জোটেনা। ভাগ্য ভালো থাকলে কেবল পাওয়া যায়-এই যেমন আজ। রোজদিনের মতো আজো অফিস যাবার জন্যই বেড়িয়েছিল সে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতেই মন ঘুরে গেলো। গলায় অসুখ অসুখ ভাব এনে জলিল ভাইকে ফোন করলো,
-স্লামালেকুম জলিল ভাই। কাল রাত থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। মাথা ব্যথা, গাটাও একটু গরম গরম।
-ওকে, আমার মনে হয় তাহলে আজকে তুমি অফিসে এসোনা। বাসায় রেস্ট করো। ফোন খোলা রেখো। প্রয়োজন হলে ফোন দিবো। আর শুনো, শরীরের একটু যত্ন টত্ন নিও। শেষের কথাটায় কান্না পেয়ে যায়। দরদ দিয়ে কেউ কিছু বললে দীপার কান্না পায়। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।

জানালা সীটে বসে থাকতে দীপার খুব ভালো লাগছে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করা হয়নি। কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চায়। একটু ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলে:
-আফা কই যাইবেন, ভাড়া দেন
-বাসটা কোথায় যাবে?
-আপনে কই যাবেন, ছেলেটি হাসে। হাসিতে সহজ সারল্য। চোখদুটোও মায়া মায়া। ঠিক যুবক না, কৈশরের চেয়ে একটু বেশি।
-বাস যেখানে গিয়ে শেষ হবে আমাকে সেখানেই নামিয়ে দিও।
-গাড়ি যাইব বুড বাজার। ঠিক আছে আপনে বসেন, আমি নামায় দিব।

তার মানে দীপা উঠেছে গাজীপুরের বাসে। শেষ গন্তব্যস্থান বোর্ডবাজার। যেখানেই যাক দীপার কোনো অসুবিধা নাই। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারলেই হলো। দীপারা পাঁচ বোন। এতো সন্তান আজকাল কোনো ফ্যামিলিতে দেখা যায় না। প্রথম কন্যার পর পুত্র লাভের আশায় আরো চার কন্যা। দীপা পাঁচের মধ্যে চতুর্থ। বাড়িতে প্রথম এবং শেষ সন্তানের গুরুত্ব বেশি থাকে। মেঝো সেজো পেজোরা বৈশিষ্ট্যহীন। দীপা সবসময়ই তাই। কখনো তাকে কেউ নিন্দা মন্দ করে না। কারণ সে বৈশিষ্ট্যহীন। উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েদেরকে মানুষ সমালোচনা করে। মেয়ে প্রতিবাদী হলে তার সাতকাহন। গালে চড় খেয়েও মুখে রা নেই টাইপ মেয়েদেরকে সবাই পছন্দ করে। দীপাকেও তাই। ওর সব গুলো শাড়ী প্রায় একই রকম। প্রতিদিনের সাজেও ব্যতিক্রম নেই কোনো। সাদা পাউডার, চোখে কাজল, হালকা কোটের মেরুন লিপস্টিক। ভিজে চুল ক্লিপে আটকানো হাতখোপা। ব্যস, এটুকুনই।

মামুনের সাথে যেদিন প্রথম দেখা করতে ঘরের বাইরে গিয়েছিল সেদিন তার পরনে ছিলো নীলের মধ্যে কালোর ডুরে দেয়া একটা তাঁতের শাড়ি। হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি ঝন ঝন করে বাজছিলো। কালো ছিপছিপে গড়নের লম্বা যুবক মামুন। একমাথা কদম ফুলের মত ঝাঁকড়া চুল। ঠোঁটদুটো তস্য কালো। ক্লাস সেভেন থেকে আগুনে পোড়া ঠোঁট। রিক্সা থেকে নেমেই স্টার সিগারেট ধরিয়েছিল সে। একটু মুচড়িয়ে দীপা বললো,
-এতো সিগারেট খান কেন। তাও আবার সস্তার?
-স্টারের মাহাত্ম্য তুই কি বুজবিরে দীপু। দুনিয়াতে এই হলো একমাত্র সিগারেট। ফুল ফ্লেভার্ড। আহ নিকোটিন!!

বাস থেকে নেমে দীপা একটা হোটেলের দিকে এগোয়। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ভাতের হোটেল। জ্যামে বসে থেকেই দুপুর হয়েছে। আজকাল ঢাকা শহরে জ্যামের যা’চ্ছে তাই অবস্থা। কোনার দিকের একটা টেবিলে বসে সে তার টিফিন বক্সটা বের করে। তিনটা রুটি আর সবজি ভাজি। মামুন একদিন তাকে শীতলক্ষ্যায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে পানি আর পানি। ওরা দুজন ছইয়ের নৌকায়। পানিওযে এতো সুন্দর হয়!! পানিতে পরে আকাশ ভিজে যাচ্ছে। নদীর পারের কৃষ্ণচূড়ার লাল ছায়া পানির কোলে চুপচাপ দুলছে।
-বুজলি দীপু, ভালোবাসা জিনিসটা নিয়তির মতো। একবার কেউ কাউকে ভালোবাসলো, তো তার আর নিস্তার নাই। সারাজীবন বুকের মধ্যে অনেক যত্নে বয়ে বেড়াতে হয়। এই যেমন আমি। চোখ খোলা থাকলেও তুই, ঘুমালেও তুই। আমি রোদের দুপুরে বাজার করে ঘেমে বাড়ি ফিরলে একগ্লাস ঠাণ্ডা লেবু শরবত হাতে তুই। তোর থেকে এ জন্মে আমার আর মুক্তি নেইরে দীপু।
-আপনি বুঝি মুক্তি চান?
মামুন দীপার ফুপাত ভাই। বয়সের ব্যবধানটাও বেশি। ছোট বেলা থেকে আপনি করে বলা অভ্যাস। দিপা কখনো মামুনকে তুমি করে বলতে পারেনি। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা সে কখনোই বলতে পারে না। মামুন পারে। দীপা জাদু গ্রস্থার মত শোনে শুধু। মেয়েরা আজকাল কতকিছু পারে! নাচ গান কিংবা দু’ছত্র কবিতা লেখা। দীপার এসব কোনো গুণ নেই। সে খুব সাধারণ। তার সব কিছুই সাধারণ। একেবারেই সাদামাটা। ছইয়ের নৌকার ভেতর হঠাৎ দশদিশ ছাপিয়ে বাশের বাঁশিতে সুর তোলে মামুন। আরো অনেক কিছুর মত বাঁশির সুরটাও মামুনের আয়ত্বে। সুরের মায়ায় দুলতে থাকে দীপা। যেন আজ ওঝার বীণে সাপের মরণ।

মেধাবী ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গিয়েছিলো ক্যালিফোর্নিয়া। যাবার আগে ছায়াচ্ছন্ন ঘরে দীপার শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ মুছে মামুন বলেছিল:
-অপেক্ষা করিস দীপু। আমি একদিন তোর কাছেই ফিরে আসবো, নিকোটিনের গন্ধ হয়ে।
চিঠিটা পরশু দিপার হাতে এসেছে। অফিসের ঠিকানায়। আজকাল ইলেকট্রনিক্সের এই মহাযজ্ঞের দিনেও ওরা চিঠি লিখত পরস্পরকে। শেষ চিঠিটা মামুনের মতই স্মার্ট। “তোকেতো হীরের কথা বলেছিলাম দীপু। পাকিস্তানি মেয়ে। আমরা একসঙ্গে কাজ করি। গত রবিবার বিয়ের দিন ছিল। আমাদের জন্য দোয়া করিস। আর তুই অনেক ভালো থাকিস দীপু”।

ভাজিটা খেতে খুব মজা হয়েছে। মা যে কি করে এতো ভালো রাঁধে!! মার কাছ থেকে একসময় কৌশলটা শিখে নিতে হবে। আরেকটা রান্না শিখতে হবে, সেটা হলো শিং মাছের ঝোল। বাবা দরিদ্র নয় অন্তত মাসান্তে কারো কাছে হাত পাততে হয় না। আবার উদ্বৃত্বও কিছু থাকে না। কিন্ত তার এক বাতিক। ভালো মন্দ বাজার করা। খুঁজে খুঁজে খাটি দেশি জিনিসটা বের করেন কি করে যেন। দাম অনেক বেশি হলেও প্রায়ই শিং মাছ কিনে আনেন। মা টমেটো আর ছোট ছোট আলু দিয়ে একটু ঝোল মতন রান্না করেন সেই মাছ। দীপা জানে স্বর্গেও এতো মজার কোনো খাবার নাই।

সন্ধ্যার লগনে লগনে ঘরে ফিরে দীপা। নিত্য দিনের মত গেট খুলে দেয় মা। মাটির উঠোন পেরিয়ে সে তার ঘরে যায়। ভাদ্র মাস। দিনের কোনো ঠিক নেই। ক্ষণে রোদ ক্ষণে মেঘ। আজ বৃষ্টি হয়নি কিন্ত আকাশটা গুমরে আছে। মাঝে মাঝে হাহাকার করে জানান দিচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল শেষ করে ঘরে পরার একটা শাড়ি পরে। টেবিলে চায়ের কাপ ঢাকা দেয়া। তার পাশে একটা পিরিচে কয়েকটা সবজি পাকোরা। ধোঁয়া উঠা পাকোরার দিকে চেয়ে চিৎকার করে দীপা,
-অ মা, তেঁতুলের টক নাই?
-না রে, শেষ হয়েছে আর বানানো হয়নি। দেখি, শুক্রবারে বানাবো। তুই কাল অফিস থেকে ফেরার পথে আনাসের দোকান থেকে আধা কেজি লাল তেঁতুল আনিসতো।

পাকোরা শেষ করে দীপা চায়ে চুমুক দেয়। কোনো একদিন সুযোগ বুঝে মার ডান হাতটা কেটে ফেলতে হবে। কবে না কবে মরে যায়, তখন দীপাকে কে বানিয়ে দেবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা। দীপা একদিন এই কাজটা ঠিক করে ফেলবে। মা দীপার ঘরে কখন আসে সে টের পায় না। এই স্বভাব ছিল মামুনেরও। বিড়ালের মত চুপিচুপি ঘরে ঢুকতো। পেছন থেকে দুহাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করতো, “বলতো কে”? বোকা আর বলে কাকে? সে কি জিজ্ঞেস করার মত কিছু! আগে পিছে ডানে বামে এক মাইলের মধ্যে দিয়ে হেটে গেলে দীপা তার গায়ের গন্ধ পায়। ঈষৎ ঘামের সাথে মিশে থাকা নিকোটিনের তীব্র গন্ধ। একবার মামুনের সাথে বোটানিকেল গার্ডেনে গিয়েছিলো দীপা। ঢুকার মুখে অনেকটা জায়গা জুড়ে গোলাপের বাগান। কত বাহারী গোলাপ, লালেরও যে কত হাজার রকমের সেড! আর সে কি সুবাস! ফ্যাকাসেটে গোলাপি হাজারি গোলাপের ঝোপের সামনে গিয়ে গায়ের সাথে ঘেষেছিল সে মামুনের। শ্যাওলা রং সার্টের দু তিনটা বোতাম খোলা। হাজারি গোলাপের চেয়ে মামুনের বুকের গন্ধটাই বেশি ভালো লেগেছিল দীপার।

দীপা মুখ তুলে তাকায় মার দিকে,
-কিছু বলবে মা
-নাহ। তোর শরীর খারাপ নাকিরে দীপা। কেমন রোগাটে লাগছে
-আমি ঠিক আছি। মা তুমি বসো, আমি তোমার কোলে একটু শুই।
কিছু বুজতে না পেরেই মা বসেন। কোলের উপর মাথা রেখে শিশুর মত শুয়ে পরে দীপা-মানুষের সবচে নিরাপদ আর বিশ্বাসের জায়গা।
-মা, তোমার মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম আমার অনেক প্লাস্টিকের পুতুল ছিল। বৌ পুতুল জামাই পুতুল ছোট ছোট বাচ্চা পুতুল। মাঝে মাঝেই ওদেরকে হারিয়ে ফেলতাম। পুতুল হারানোর একটা বাতিক ছিল আমার। হারিয়ে ফেলে তারপর আমি খুব কাঁদতাম। তুমি তখন আমাকে কোলের ওপর শুইয়ে একটা গান গাইতে। মা, তুমি কি আজ আমার কপালে হাত রেখে সেই গানটা একবার গাইবে?
মা তার সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়ের কপালে হাত রাখে। দরদ ভরা গলায় গুন গুন করে-
-সো যা মেরি রাজকুমারী, সো যা…

ভাদ্র মাসের আসলেই কোনো বিশ্বাস নেই। এই ভর সন্ধ্যায় হঠাত ঝুপ ঝুপিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকালে গোসলের পর রাতের বাসি শাড়িটা পানিতে কেচে উঠানের দড়িতে মেলে দিয়েছিল দীপা। বিকেলে মা বোধহয় ঘরে তুলতে ভুলে গেছে। ভাদর সন্ধ্যার ঝুম বৃষ্টিতে উঠানের দড়িতে দীপার নীল পাড় কলাপাতা রং শাড়িটা একলা ভিজছে।