যে কারণে আমি অগ্রাধিকারের টিকা নেব না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে সাংবাদিকদের ফোন। আপা নাকি টিকা নিয়েছেন? প্রথমে আকাশ থেকে পড়লেও নিজেকে সামলে নিলাম দ্রুত। কারণ রাজনীতি করতে এসে এ ধরণের নোংরা অভিজ্ঞতা নতুন না। ব্যক্তিগত আক্রমণ (এড হোমিনাম), এক বিষয়ে কথা বলার মধ্যে অপরপক্ষ অন্য বিষয়ে চলে যাওয়া (স্ট্র ম্যান ফ্যালাসি) এর সাথে পথ চলতে হয় প্রতিদিন।

ফটোশপ, গলাকাটা, সুপার এডিটিং নানা ধরনের কুৎসিত কর্মকাণ্ডের পর এইবার ভিন্ন এক ব্যক্তিকে আমি বলে চালিয়ে দেয়ার বিষয়ে সত্যি বলতে প্রথমে খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে মজাই লাগছিল।  ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ মানুষকে কতোটা অসহায় করে তোলে! বিষয়টা আমি এড়িয়েই যেতাম, যেভাবে অতীতে এ ধরনের বিষয় কখনোই নূন্যতম গুরুত্ব দেইনি। একা নারী যখন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি তখন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই দাঁড়িয়েছি। কিন্তু যখন দেখলাম প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকগুলো থেকে ফোন পাচ্ছি তখন মনে হলো ফেসবুকে একটি বাক্য লিখে বিষয়টা শেষ করাই ভাল হবে। জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি টিকা নেইনি।

 

এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি টিকা নেব? নিলে কবে নেব? এখন নয় কেন? কারো কারো মনে পড়তে পারে আমার করোনা আক্রান্ত হবার কথা, ভাবতে পারেন আমার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে, তাই হয়ত আমি টিকা নিতে চাই না।

এটা একেবারেই ঠিক নয়। আমরা এর মধ্যেই জানি, করোনা আক্রান্ত হলেই আবার করোনা হওয়া রোধ করার মতো পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় কিনা, হলে সেটা কতদিন থাকে সেটা নিয়ে নানা সংশয় আছে বিজ্ঞানের লেভেলেই। তবে এটা অনেকটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে আবার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুব কম, এর পর আবার আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। আমার ক্ষেত্রে এই সময়ের প্রায় দ্বিগুন পেড়িয়ে গেছে, তাই আমার টিকা নিয়ে নেয়াই উচিৎ।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকা এসেছে সরকারি ভাবে ৭০ লাখ। এর মধ্যে কারা পাবেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। বাংলাদেশে টিকার অগ্রাধিকার তালিকা সম্পর্কে জানার আগে জেনে নেয়া যাক এই ব্যাপারে বৃটেনের অগ্রাধিকারের কথা।

 

সেখানে সবার প্রথম টিকা পাবে বৃদ্ধাশ্রমে বাস করা মানুষজন এবং তাদেরকে যারা সেবা দিচ্ছেন তারা। তারপর পাবেন ৮০ বছরের বেশি যে কোনো মানুষ এবং যারা ফ্রন্টলাইন হেলথ কেয়ার সার্ভিস দিচ্ছেন (ডাক্তার, নার্স, হেলথ টেকনিশিয়ান)। এরপর পাবেন ক্রমান্বয়ে যাদের বয়স ৭৫ এর বেশি এবং ৭০ এর বেশি তারা। তারপরের প্রাধিকার হচ্ছে ১৬ বছরের বেশি যে কোনো মানুষ যারা ভয়ঙ্কর কোনো অসুস্থতায় আক্রান্ত (যেমন ক্যান্সার, ফুসফুসের মারাত্মক কোনো রোগ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন)। এরপর ৬৫ বছরের বেশি মানুষ এবং ১৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সের যে কোন মানুষ যাদের কোনো কঠিন রোগ আছে। এরপর ক্রমান্বয়ে ৬০, ৫৫ এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ।

 

বাংলাদেশে অগ্রাধিকারের তালিকায় আছেন কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ স্বাস্থ্যকর্মী, অনুমোদিত ছয় লাখ বেসরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মী, দুই লাখ ১০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬২০ সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ সদস্য আগে টিকা পাবেন।

 

অগ্রাধিকারের তালিকায় আরও আছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৫০ হাজার গণমাধ্যমকর্মী, এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জনপ্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার দেড় লাখ কর্মচারী, পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ধর্মীয় প্রতিনিধি, মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ৭৫ হাজার ব্যক্তি, জরুরি সেবার (পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, পরিবহনকর্মী) চার লাখ কর্মী, স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের দেড় লাখ কর্মী, এক লাখ ২০ হাজার প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক। জেলা উপজেলায় কর্মরত চার লাখ জরুরি সেবার সরকারি কর্মচারী, এক লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার (যক্ষ্মা, এইডস, ক্যান্সার) ছয় লাখ ২৫ হাজার জনগোষ্ঠী, ৬৪ থেকে ৭৯ বছর বয়সী এক কোটি তিন লাখ ২৬ হাজার ৬৫৮ ব্যক্তি, ৮০ বছর ও তদূর্ধ্ব ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জনগোষ্ঠী, জাতীয় দলের খেলোয়াড় ২১ হাজার ৮৬৩ জন আগে টিকা পাবেন।

 

টিকার প্রায়োরিটির তালিকায় আছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী, বিভিন্ন ধাপের তথাকথিত জনপ্রতিনিধি, যারা আসলে সরকারের অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। টিকা দেয়া জায়েজ করার জন্য এদের সবাইকে ‘সন্মুখসারির যোদ্ধা’ নাম দেয়া হয়েছে। অথচ বৃটেনে শুধুমাত্র হাসপাতালে সেবা দেয় এমন মানুষদেরই ‘সন্মুখসারির যোদ্ধা’ তকমা দেয়া হয়েছে। সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানে যারা বয়স কিংবা অন্য রোগের কারণে ঝুঁকির মধ্যে আছেন তারা টিকা পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতেই পারেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য মানুষ আছেন যাদের বয়স অনেক কম, সাথে ঝুঁকি তৈরির মতো অসুস্থতা নেই, তাদের করোনা হলেও সেটা মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করবে না। কিন্তু এদের সকলকে টিকা দিতে গিয়ে আমরা টিকা থেকে বঞ্চিত রাখছি এমন মানুষদের যাদের করোনা হলে অনেকেরই মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হবে।

 

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টিকা দেবার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়েছে। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বৃটেন কি সেটা জানে না? তারা কেন গণহারে সব সরকারি লোকজনকে টিকা দেয়নি? বৃটেনের মতো অগ্রাধিকার তালিকা করলে কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা লাঠি হাতে তেড়ে আসতো?

 

ক্যান্সার, যক্ষ্মার মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত মানুষ করোনা আক্রান্ত হলে সেটা জটিল হবার ঝুঁকি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লক্ষ আর যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ লক্ষ। সরকারের করা অগ্রাধিকার তালিকায় যক্ষ্মা, ক্যান্সার, এইডস আক্রান্ত সোয়া ৬ লক্ষ মানুষকে রাখা হয়েছে,যা মোট সংখ্যার মাত্র দশ শতাংশ। একই কথা প্রযোজ্য বয়স্ক মানুষকে টিকা দেবার ক্ষেত্রেও।

 

টিকা দেয়ার উদ্দেশ্য দু’টো। ৭০ শতাংশ বা তার বেশি মানুষকে টিকা দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা যাতে কমিউনিটিতেই আর এই রোগ না হয়। আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালনারেবল মানুষকে টিকা দেয়া যাতে তাদের রক্ষা করা যায়; বাকিরা সেই রোগে আক্রান্ত হলেও স্বল্প বা মাঝারি উপসর্গে ভুগে সেরে উঠবে। সারা বিশ্ব এখন করোনা ভ্যাক্সিনের পেছনে দৌড়াচ্ছে তাই হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য দ্রুত ২৫ কোটির মতো টিকা পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আমি বুঝি। কোভ্যাক্স প্রোগ্রামের অধীনে আমরা বড় সংখ্যার টিকা পাব, কিন্তু সেটা আসতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। তাহলে আমাদের হাতে যে ৩ কোটি ২০ লক্ষ টিকা আগামী ৬ মাসের মধ্যে থাকবে (যা দিয়ে ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষকে ভ্যাক্সিনেট করা যাবে) সেটা অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবহার করার কথা ছিল।

 

কিন্তু আমরা এই সামান্য সংখ্যার টিকা থেকে অপচয় করছি লক্ষ লক্ষ টিকা। হ্যাঁ, করোনা হলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি, এমন মানুষকে বাদ দিয়ে সুস্থ, কম বয়স্ক মানুষকে এই মুহূর্তে টিকা দেয়াটাকে আমি স্রেফ অপচয় বলেই মনে করি। তাদের টিকা লাগবে না, তা নয়, তাদের ঝুঁকি অনেক কম বলে যখন কোভ্যাক্স এর ভ্যাক্সিন আসবে তখন সেটা নিতে পারতেন।

 

আমার বাসায় বয়স্ক মা। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে কখনোই বাইরে যান না তিনি। কিন্তু আমাকে বেরোতে হয়, নানা প্রয়োজনে বাইরের মানুষকে বাসায় আসতে দিতে হয়। টিকা প্রয়োজন তার মতো আরও অসংখ্য বাবা-মায়ের। এই রাষ্ট্রের কম বয়স্ক সুস্থ সন্তানরা টিকা নিতে গিয়ে বাবা-মা দের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছেন। রাষ্ট্র টিকার ব্যাপারে ইনসাফ করেনি।  কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে আমি আমার অগ্রাধিকারের টিকা না নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টিকার সত্যিকার প্রয়োজন যাদের, তাদের টিকা দেয়া হয়ে যাবার পরে আমি টিকা নিতে চাই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর