ড. গোলসান আরা বেগমঃ শিশির মাখা ভোরে কুয়াশা মাথায় হাঁটবো– মন্দ নয় অভিব্যক্তিটি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে খুব ভোরে, ছোট বেলায় আমপাড়া বুকে নিয়ে দল বেঁধে মক্তবে পড়তে যেতাম। আলেফ,বে তা ছার হাতে কড়ি মক্তবেই ঘটে। আম পাড়া শেষ করে – নামাজ পড়ার দোয়া ও বিধিবিধান শিখে নেই। মক্তবের হুজুর তালে লয়ে সুরে সুরে বহু সুরা সবা শিক্ষার্থীকে মুখস্ত করাতেন। আজো সেই সমস্ত সুরা ব্যবহার করে নামাজ আদায় করি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করতো না। কিন্তু মা বাবা তা বুঝতো কি? আজো সেই প্রথা গ্রামের মসজিদ বা মক্তবে চালু রয়েছে।
হাত দুটো ঠান্ডায় শিরশির করতো। কথা বললেই মুখ দিয়ে ধূয়া উড়তো। মা গলায় বেঁধে দিতো শীত বস্র হিসেবে বাবার ছেঁড়া লুঙ্গি। আমাদের দলভুক্ত সবারই ছিলো গরীবি হালচাল। লেপ কম্বল অনেকেরই ছিলো না। কিন্তু গেঁয়ো জীবন ছিলো সুখের। গোয়ালে গরু,ঘোলায় ধান, পুকুরে মাছ, গাছে গাছে ঝুলত ফল ফলাদি, ক্ষেতে সোনার ফসল, নদীর বুকে চলতো পালের নাও। কুয়াশায় ভিজে পুথিঁ পাঠ, পালা গানের আসর বসতো গভীর রাত অবধি। ওয়াজ মাহফিল হতো উৎসব মুখর পরিবেশে।
মানুষ ছিলো কুসংস্কার, অশিক্ষা, নানা ভ্রান্ত ধারনায় বিশ্বাসী। অসুখ বিসুখে পানি পড়া,ঝাড় ফু,তাবিজ কবজে ছিলো নির্ভরশীল। হুজুরের দোয়াযুক্ত কলম দিয়ে পরীক্ষা দিলে ভালো ফলাফল করা যাবে- তা বিশ্বাস করতো। আমার মাও তা মনে করতেন। মুরগীর প্রথম ডিম বা বাচ্ছাটা,গাছের প্রথম ফলটা দিয়ে আসতো মসজিদে,মাজারে বা দড়গায়। শুভ কামনার নিয়ত করে সূঁতা বেঁধে আসতো মাজারের কোন গাছের ডালে, আজো তা প্রচলিত রয়েছে।
গোল্লাছুট,ডাংগুলি, দাড়িয়া বান্দা, চার ঘড়িয়া, ফুটবল, হাডুডু,এক্কা দোক্কা,ওপেনটি বাইচস্কোপ,পুতুল খেলা, ব্যাঙাব্যাঙির বিয়ে, নৌকা বাইচ, বৌছি,ইত্যাদি খেলাধূলা ছিলো প্রচলিত। নবান্ন উৎসব, পূজা পার্বন, মোড়গের লড়াই,ঘোড় দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই,ঘুড়ি উৎসব,কোরবানী ঈদ, বৈশাখী মেলা, রোজার ঈদ, সাপের খেলা,বানরের নাচ ইত্যাদি ছিলো আমোদ প্রমোদের মাধ্যম। রাখাল বাজাতো বাঁশী রাত দুপুরে গভীর রাত অবধি। হিন্দু বাড়ীতে সারারাত চলতো ঢাক ঢোলের বাজনা। কেরোসিন তেলের কুপির বাতিতে দুর করতো রাতের অাঁধার।
সন্তান জন্ম নিলে তৃতীয় রজনীতে আতুঁর ঘরে কলম খাতা রেখে দিতো যত্ন করে। সেই রাতকে বলা হতো হাট্টিয়ারার রাত।মানুষ বিশ্বাস করতো ঐ রাতে শিশুটির ভাগ্যের ভালো মন্দ আল্লাহর তরফ থেকে কেউ লিখে যাবে। কিন্তু কাগজে তা দেখা যাবে না। এটাই হবে তার ভাগ্য লিপি। শিশুটির উপর জিন পরীর নজর না লাগে, সে জন্য চোখ গোডা(শক্ত পাথর জাতীয়) সুতায় বেঁধে গলায় বেঁধে দিতো।
শিশুর বয়স সাত দিন হলে আত্মীয় স্বজন দাওয়াত দিয়ে ভালো খাওয়া দাওয়া ও ফূর্তি করতো। শিশু ষখন বসা অবস্থা পেরিয়ে হাঁটতে শিখতো, তখল গুলগুলিয়া খেলা উৎসব হতো। সে খেলার ধরন ছিলো – চালের গুড়া দিয়ে মেড়া পিঠা বানিয়ে ঘরের ছাদে বা ছালের উপরে ছুঁড়ে মারতো। ঐ পিঠাগুলি গড়গড়িয়ে মাটিতে পড়তো। তখন ঐ শিশুসহ প্রতিবেশী অন্য শিশুরা খুড়িয়ে নিতো খাওয়ার জন্য। মুরুব্বীরা খুশী হয়ে হাত তালি দিতো।বাচ্চারা প্রচুর মজা পেতো।
আজকাল গেঁয়ো মানুষের জীবন মান অনেক উন্নত হয়েছে।রাস্তা, ঘাট,খাল বিল, সামাজিক পরিবেশ, জনগণের চিন্তা চেতনা, ভৌত অবকাঠামো,চাষাবাদ পদ্দতি, পড়াশোনার ধরণ, আগের মত নেই। পাকা রাস্তা পৌঁছে গেছে প্রত্যেকের ওঠানের কোণায়। বিদুতের ঝলকানিতে গাঁয়ের বাড়ী ঘর রাস্তা ঘাট করে ঝিকমিক। প্রায় প্রতিটি মানুষের হাতে ওঠে এসেছে মোবাইল ফোন। ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে গেছে প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে। অনলাইনে অতি দ্রুত পেতে পারে বিদেশ বাসি স্বজনের প্রেরিত অর্থ, মনের অনুভুতি,করতে পারে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের যে কোন খবরা খবর মহূর্তেই জানতে পারে। পৃথিবীর গ্লোবাল ভিলেজের ছোঁয়া গ্রামের আলো বাতাসে পৌঁছে গেছে। বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট – ১ এর বদৌলতে সহজেই তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লবের স্বাদ ভোগ করছে গাঁয়ের সাধারন মানুষও। ভিডিও কলের মাধ্যমে হচ্ছে বিয়ে, জানাজা, জন্মদিন উৎসব, মধুর মধুর প্রেমালাপ। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম ঘরের কোণে বসে করছে। কেউ কেউ আউট সোর্সিং ব্যবসা করছে। ঝুম ক্লাউড ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় কৃষি তত্ত্বের নির্দেশনা, প্রশিক্ষণ, মতবিনিময় করতে পারছে।স্বাস্থ্য সেবা, ঝড় বৃষ্টির খবর, সুনামি, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস জানতে পাচ্ছে।
গ্রাম আর সেই ভয় ভয় ভৌতিকতায়, জুজু বুড়ির গল্প কথার গ্রাম নেই।শিক্ষায়,দীক্ষায়,চাল চলন, ভৌতঅবকাঠামো সুবিধায় পৌঁছে গেছে শহরের কাছাকাছি পর্যায়ে। ছোট ছোট শিল্পকর্ম ঘরে ঘরে করে,স্বচ্ছলতা বাড়ছে পারিবারিক জীবনে। আধুনিক যন্তপাতি,প্রযুক্তি, উন্নত পদ্ধতি, সার বীজ, কীট নাশক ইত্যাদি যুক্ত করে কৃষি ব্যবস্থাকে করেছে সুলভ ও সহজ লভ্য। পেটের ভাতের অভাব নেই। চাঁদের ঝলকানিতে শীতের চাদর গায়ে দিয়ে দল বেঁধে বসে দিনশেষে ক্লান্তি মুছে সুখ দুখের গল্প করে।
সেকালে একে অপরের সুখে দুখে হাত বাড়িয়ে রাখতো। মানুষ ছিলো অনেক সহজ সরল। মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ ছিলো না। সকালে বা সন্ধ্যায় নাড়ার আগুনের চাশ পাশে ঘিরে বসে শরীর গরম করার পাশাপাশি করতো হাসি খুশী ভাগাভাগি। নাড়ার আগুনে পুড়ে খেতো সেদ্ধ মটর বা খেসারির ডালের ছড়া। ধানের ভাঁজে সেদ্ধ করা কলাপাতায় পেছানো মোটা পিঠা। শীতের তীব্রতা মনে থাকতো না। কোথায় হারিয়ে গেলো চায়ের কাপে ধোয়া উড়ানো সেই জীবন।
হাইরাইজ ভবনে বদ্ধ ঘরে বসে স্মৃতির আলপনা কাটতে ভালো লাগে না আর। বাড়ীতে গাড়ীতে এসি বিলাসিতার বহরে দম আটকে আসে। পিছু ডাকে সেই মায়ের গাঁয়ের শ্যামল আলো ছায়া। কেনি আঙ্গুলে ধরে টেনে নিয়ে যায় শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসের আলপথে। জোনাক জ্বলা সন্ধ্যায় বাঁশ জঙ্গলের পাখীর কলগুজ্ঞনে। না না আর ভালো লাগছে বদ্ধ ঘরে একাকিত্বের জীবন প্রণালী। ইচ্ছে করেই চলে যাবো গাঁয়ে– শিশির ভেজা ভোরে কুয়াশা মাথায় হাঁটবো গাঁয়ের আলপথে।বুক ভরে খোলা বাতাস টেনে করবো শিশু বেলার ভালোবাসা নবায়ন।
লেখকঃ কবি,কলামিস্ট,উপদেষ্ঠা সদস্য, বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
লেখকঃ ড. গোলসান আরা বেগম কবি,কলামিষ্ট, সিনেট সদস্য