স্মৃতিময় স্মৃতির কাঁথা সেলাই করি, অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম

ড. গোলসান আরা বেগমঃ কতো স্মৃতিই-তো ফানুসের মত চোখের চারদিকে ঘুরে। কোনটাকে ধরবো,ছাড়বো ও লিপিবদ্ধ করবো। স্মৃতিময় স্মৃতির তালিকা রক্তাক্ত করে মনের সবুজ সতেজ কলাপাতার পৃষ্টা। মাকে টেনে আনে সুখের বুনণে।তখন মায়ের হাতের মাখা দুধ ভাত খেতে ইচ্ছে করে।টেনে নিয়ে যায় ধূয়া উড়ানো রান্না ঘরে, যেখানে চূলা পাড়ে বসে নবান্নের পিঠা পায়েস খেতাম, মায়ের স্নেহ আদরের আচল ছোঁয়ে। সন্ধায় ভাই বোনেরা ধূলিবালি মেখে ফিরে আসতাম ঘরে।তখন মায়ের বকুনি বাবার শাসন কতইনা মধুর মনে হতো।হায় সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো।
মায়ের মুখে শুনেছি-অমবষ্যা রাতে ঘুট ঘুটে অন্ধকারে আমার পৃথিবীতে আগমন হয়েছিলো। আমার গায়ের বর্ণ। যেন আগুনের ফুলকির মতো উজ্জল হয়ে জ্বলছিলো আকাশ থেকে ছুটে আসা একটি নক্ষত্র। দাদী তো পাগল হয়ে  গিয়েছিলো, আমার রুপের ঝলকানি দেখে। তাড়াতাড়ি নাম রেখেছিলো চাঁদের আলো জ্যোৎস্না। সেই  মেয়েটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে গেলাম। আধারে ঢেকে গেলো সকল রোদের ঝলকানি।
একদিন আমার এক শিক্ষক ডেকে নিয়ে জিঞ্জেস করেছিলো–তোর নাম কে রেখেছে জোছনা। কালো মেয়ের নাম কি জোছনা হতে পারে? সে কথার মর্ম বেদনা বোঝার বয়স হয়নি তখন,তাই কষ্ট ছিলো না মনে। স্মৃতির পৃস্ঠা খুলে আজো মনে  হলে কুকড়ে উঠি কেঁদে। কারো কারো শুকনো মুখের করুণা দেখে মন ভেঙ্গে যেতো। হায় সে কথা কি ভুলা যায়, স্কুলে যাওয়ার পথে, কিছু দুষ্ট ছেলের দল, মা কালি বলে ডাকতো যখন আমায়।
বাবা বরশি দিয়ে মাছ ধরতেন।মাছ শিকারে যাওয়ার পুর্বে আমাকে বলতেন বর্শিটা ছোঁয়ে দেয়ার জন্য। বাবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো – আমি ছুঁয়ে দিলে প্রচুর মাছ ধরতে পারবে। জানি না তার সত্যতা কতটুকু সত্যি। তারপবও বাবা তাই করতেন। স্মৃতিতে গাঁথা  স্মৃতিকথা স্মৃতি হয়েই বাঁচে, বার বার আচল ধরে পেছনে টানে।পেছনে টেনে নিয়ে যায় বহু দুরে।তক তকে ঝক ঝকে স্মৃতির মাঠে, যেখানে সুখ দুখ গড়াগড়ি খায়। রাঙিয়ে তুলে চোখ নাক কান।
আমি বড় ভাগ্যবান,একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিকে
গাঁথতে পেরেছিলাম। কি বিভিষিকাময় ছিলো সেই রক্তাক্ত যুদ্ধের দিনগুলি। এক দিকে বাড়ী ঘর পুড়ে ছাই হচ্ছে, অন্য দিকে মানুষকে মেরে রক্ত বন্যায় তলিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানী দকলদাররা। দলে দলে মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে জাীবনটা হাতে নিয়ে ভারতে।কেউ কেউ পথে ঘাটে মরে পড়ে আছে। সেই নয় মাসের মুক্তিযোদ্ধের নির্মমতা মনে হলে  আজো শিহরিত হই।
রাতের আধারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের  চরমপত্র অনুষ্ঠানটি শুনতাম ঘোয়াল ঘরে বসে খুব নীচু ভলিয়মে রেডিওতে ।টগবগে রক্ত গরম হয়ে  ওঠতো যুদ্ধ জয়ের খবর শুনে।আমাদের গরুর রাখাল ছেলেটি পাগল হয়ে ওঠলো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। কারো বাঁধা নিষেধ মানলো না। যুদ্ধে গেলো তো গেলোই,  চিরতরে গেলো। স্বাধীনতার হাত ধরে১৯৭১ সালে  ১৬ ডিসেম্বরে  বিজয় ঘরে এলো,বহু জন বিজয় পতাকা হাতে এলো ফিরে। কিন্তু আমদের রাখাল ছেলেটি ফিরে এলো না। সে কোথায়, কি ভাবে নিহত হলো আজো তা জানা হলো না। এ ভাবেই ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে ভেজা স্বাধীনতা পেলাম।
এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রিলাক্স মোডে গ্রামের বাড়ীতেই ছিলাম। নরম ঘাসের ছোঁয়া, হলুদ সর্ষে ফুলের দোল, রাতের আধারের ভয় ভয় ভৌতিকতায় মিলে মিশে আগা গোড়া ভালোই ছিলাম।  হঠাৎ কানের কাছে একটা দুঃসংবাদ  গর্জে ইঠে বললো – বঙ্গবন্ধু নেই। দৌড়ে গিয়ে বসলাম পাশের বাড়ীর রেডিওর সামনে। আমাদের ঘরে রেডিও ছিলো না।নির্মম ভাবে হত্যার খবর শুনে আশে পাশের সবার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিলো। সেই গেঁয়ো পরিবেশে বসে রাজনীতির কঠিন প্যাচ বুঝতে না পারলেও, কতোটুকু কস্ট পেয়েছিলাম,তা কাউকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে  পারবো না। দুঃখে গাঁথা সব কথা স্মৃতির খাতায় সাজিয়ে রেখেছিলাম।
১৯৭৭এ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখি পা। শিক্ষার বিশাল জগতে পদচারণা করে সমৃদ্ধ করেছি নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক মেধাকে। সঙ্গে নিয়ে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে সেদ্ধ করা স্মৃতিময় বহু স্মৃতি কথা। স্যারদের ভালোবাসা,বন্ধুদের আনন্দ উচ্ছ্বাস, লম্বা আড্ড দেয়ার গালগপ্প, চায়ের কাপে ধুয়া উড়ানো চাপাবাজি, বাঁধনহারা জীবনের রুপালি স্বপ্নের চাদর আরো কতো কী, আজো মন ছোঁয়ে ভিজে কাঁদায়।১৯৮২ সালে সকল খেলার ছন্দ পতন গঠিয়ে ছেড়ে আসি আমার প্রাণ প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজনীতির মাঠে বরাবরই ছিলাম সরব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করেছি সারা জীবন। তাকে হারানোর কষ্ট,ব্যথা সবর্ক্ষণ ঘিরে রাখে আমায়। সে কষ্টগুলো তুলে ধরেছি “বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রাণ” হায় বঙ্গবন্ধু এ কী করলাম  এই দু’টি প্রবন্ধ গ্রন্থে। আরো জড়ো করেছি অনুভুতির আলপনা অমর কাব্যের মহা নায়ক বঙ্গবন্ধু কাব্য গ্রন্থে। প্রকি বছরই ১৫ আগস্ট এলে ছুটে যাই -বনানি গোরস্থানে, টুঙ্গিপাড়ায়, ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। খুড়ে খুড়ে উদ্ধার করি ব্যথা বেদনা।নত শিরে চোখ ভিজিয়ে করি কৃতঞ্জতা স্বীকার।
অপারেশানের টেবিলে জীবন যুদ্ধে নেমেছি কয়েক বার। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও অপারেশনের টেবিলে উঠেছিলাম। জঠর ব্যথায় নীল হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার আমার মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিল,এই মেয়ে কান্না থামাও।তোমার একটা টুকটুকে লাল ছেলে সন্তান হয়েছে।
আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম-সত্যি  কি তাই? মহিলা ডাকার শিশুটির ঠ্যাং দুটো ফাঁক করিয়ে বললো-এই দেখ তোমার মানিক রতন। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য হাসে।আমিও বিশ্ব জয়ি হাসি হেসেছিলাম।সন্তানের বাবা আমার কপালে ঠোঁট লাগিয়ে বলেছিল – সত্যি তুমি আমার ষোল আনা। আহা কি শান্তিই না পেয়েছিলাম।
মা ১৯৯৫ এ মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন –এই দালান কোঠা সব থাকবে, থাকবো না শুধু আমি।২০২০ এ দাঁড়িয়ে আমিও বলছি-সবার মতো আমাকেও যেতে হবে না ফেরার ঘরে। থাকবে পরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ,আমার এই স্মৃতিময় স্মৃতির তালিকা।আজকে ৩০/১২/২০২০ জানাই বিদায় আমার ব্যর্থতায় ভরা বিগত বছরকে।হাসি মুখে ফুলে ফুলে  নববর্ষকে করি বরণ ।
লেখকঃ কবি,কলামিষ্ট,উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর