যেভাবে সূচনা হলো হিজরি নববর্ষের

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আরবি নববর্ষ ১৪৪২ এ কালের আবর্তে আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি। মহররম মাস আরবি নববর্ষের প্রথম মাস এবং মুসলমানদের জন্য আল্লাহর কাছে এটি অত্যন্ত সম্মানিত মাস।

বাংলাদেশে ইংরেজি, বাংলা ও হিজরি এই তিনটি সালের প্রচলন রয়েছে (আমরা যে ইংরেজি সাল বলি সেটা ইংরেজি সাল নয় সেটা মূলত খৃস্টধর্মীয়)। আমরা যে বাংলা এবং ইংরেজি সাল গণনা করি এটা একটি সৌর সন এবং হিজরি সন হচ্ছে চন্দ্রসন। চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমে সন-তারিখ নির্দিষ্ট করা যায়।

চাঁদের গতি-প্রকৃতি হিসেবে যে সন গণনা করা হয়, সেটাকে বলা হয় চন্দ্রসন, আর সূর্যের গতি-প্রকৃতি হিসেবে যে সন গণনা করা হয়, তাকে বলা হয় সৌরসন। আর তা নির্ভর করে সূর্য ও চন্দ্রের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাতে উভয়ের পরিভ্রমণের ওপর। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র একটি হিসেবের মধ্যে আবদ্ধ আছে’ (সূরা : আর রহমান, আয়াত : ৫)।

আবার দিন ও মাসের সূচনা হয় চাঁদ দেখার মাধ্যমে, এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, আপনি তাদের বলে দিন এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজকর্মের) এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য’। (সূরা: বাকারা, আয়াত : ১৮৯)।

পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম বর্ষ গণনা করা শিখছে , সেদিন চাঁদের হিসাবেই শুরু করা হয় বর্ষ গণনা। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করা হতো। সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। বলা যায় পৃথিবীর সূচনা থেকেই আল্লাহর নির্দিষ্ট মাস সমূহ রয়েছে আরবি তথা হিজরি সনে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাস সমূহের সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সু-প্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আরবদের নিজস্ব কোনো ক্যালেন্ডার বা বর্ষপুঞ্জি ছিল না। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে সামনে রেখে তারা দিন তারিখ উল্লেখ করতো। ফলে দেখা যেতো সন উল্লেখ না থাকায় সরকারি কাজসহ বিভিন্ন কাজে নানা ঝামেলার সৃষ্টি হতো। তাই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ বৎসরে হজরত আবু মুসা আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহু খলিফাকে পত্র লিখে বলেন, ‘বিশ্বাসীদের নেতা আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোনো সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সঙ্গে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে, আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

তখন খলিফা ওমর রাযিয়াল্লাহু সাহাবিদেরকে নিয়ে পরামর্শে বসেন। তখন কেউ কেউ রোম বা পারস্যের পঞ্জিকা ব্যবহারের কথা বলেন। কিন্তু অন্যরা তা অপছন্দ করে মুসলমানদের জন্য আলাদা নিজস্ব পঞ্জিকা করার প্রস্তাব দেন। তখন পরামর্শে একেকজন একেক প্রস্তাব পেশ করেন। কেউ বললেন নবীজীর (সা.) জন্ম সাল থেকে মুসলমানদের বর্ষ গণনা করার, কেউ নবীজীর (সা.) ওফাত থেকে, কেউ হিজরত থেকে, কেউ নবুওয়াত থেকে মুসলমানদের নিজস্ব সাল গণনার প্রস্তাব দেন। তখন হজরত আলী রাযিয়াল্লাহু হিজরত থেকে সাল গণনার পক্ষে জোরালো প্রস্তাব পেশ করেন। কেননা, হিজরত থেকেই সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যের সূচনা হয়। অবশেষে সবার সম্মতিতে খলিফা ওমর রাযিয়াল্লাহু হিজরি সাল থেকেই মুসলমানদের সাল গণনার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর কোন মাস প্রথমে আসবে এ নিয়েও সাহাবিরা নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। কেউ রমজান মাস, কেউ রবিউল আওয়াল মাসকে প্রথম মাস করার প্রস্তাব দেন। পরিশেষে, মহররম মাসকে প্রথম মাস করা হয়। কেননা, মহররম মাস হলো সম্মানিত চার মাসের একটি এবং মহররম মাসে মুসলমানরা ইসলামের সর্বশেষ রুকন হজ পালন করে দেশে ফিরে আসেন। হজ সর্বশেষ রুকন ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সমাপ্তির মাধ্যমে বৎসর শেষ হয়ে মহররম মাস থেকে নতুন বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের ছয় বৎসর পরে নবীজীর (সা.) হিজরতের তারিখ ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দে হিজরি ১৬/১৭ সাল থেকে সাহাবিদের ঐকমত্যে আরবি বা মুসলমানদের নিজস্ব হিজরি সন শুরু হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য ইসলামি সংস্কৃতির ব্যাপক পরিধি থাকলেও বিজাতীয় সংস্কৃতির করাল গ্রাসে মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন, হিজরি সনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। অথচ আমাদের অধিকাংশ ইবাদত হিজরি সন কেন্দ্রিক। আমরা অনেকেই জানি না যে, হিজরি নববর্ষ কোন মাসে হয়? জানে না হিজরিবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস। অনেকেই হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না। এজন্য হিজরি সন তথা চন্দ্র মাস গণনাকে ওলামায়ে কেরাম ফরজে কেফায়া হিসেবে গণ্য করেছেন। হিজরি সন চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। আর এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গো (বুখারি : ১৯০৯)।

বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষে সাধারণত আমাদের সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতিতে সবাই লিপ্ত হয়ে যায়। অথচ একটি বৎসরের বিদায় মানে আমাদের জীবন আকাশে একটি বৎসর কমে যাওয়া। তাই নববর্ষের প্রথম করণীয় হলো আত্মসমালোচনা করা। একটি বৎসরের বিদায় আর নতুন আরেকটি বৎসরের আগমনের মধ্যে রয়েছে চিন্তা ভাবনার খোরাক। আত্মসমালোচনা করে দেখতে হবে, কেমন ছিল গত বৎসরে আমার আমলনামা? কী পরিমাণ বরকতময় আমলসমূহ করেছি তা হিসাব করতে হবে। কম হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। নতুন বৎসরে আমল, আখলাখ, চরিত্র আরো ভালো কিভাবে করা যায় সেই প্রত্যাশায় থাকতে হবে। নতুন বৎসরে নতুন উদ্দ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হোক আমাদের পথচলা। তবেই শুভ হবে হিজরি শুভ নববর্ষ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর