হাওর বার্তা ডেস্কঃ সংগীতাঙ্গনের সংকট দীর্ঘদিনের। ঠিকমতো রয়্যালিটি না পাওয়া, স্টেজ শো থেকে উপযুক্ত সম্মানী না পাওয়াসহ নানা ধরনের অসংগতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এসবের মধ্যে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। করোনার সময় অনলাইন লাইভ শোগুলোতে শিল্পীরা অংশ নিলেও বেশিরভাগ শিল্পীই সম্মানী পাচ্ছেন না। এবার শিল্পীরা নিজেদের প্রাপ্য সম্মানী আদায়ের লক্ষ্যে যৌথভাবে দিয়েছেন বিবৃতি। তারা জানিয়েছেন, পারিশ্রমিক ছাড়াও আর কোথাও গান করবেন না।
এ বিষয়ে গুণী কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিল্পীদের সংকট দীর্ঘদিনের। এখন করোনা এসে সেই সংকটকে আরও ভয়াবহ করে দিল। প্রায় সব শিল্পীর উপার্জনই বন্ধ। আর কোনো সংকটে সবার আগে শিল্পীরাই আঘাতপ্রাপ্ত হন। এখনো তাই হয়েছে। কিন্তু আমরা খেয়াল করে দেখেছি যে, শিল্পীরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে সবাই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আমিও সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছি। তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছি।’
কণ্ঠশিল্পী এসআই টুটুল বলেন, ‘নিজেকে আমি একজন সংগীত শ্রমিক হিসেবে দাবি করি। আমি সংগীত অঙ্গনে শ্রম দিয়ে খাই। এটা আমার প্রফেশন। কিন্তু আমরা খেয়াল করেছি যে, অনেক সময় অনেক জায়গা থেকে আমাদের ফ্রি কাজ করার জন্য বলা হয়। অনেক সময় অনেকের অনুরোধে আমরা কাজও করি। কিন্তু এখন থেকে আমরা সেই ফ্রি কাজটি আর করতে চাই না। কারণ আমরা যদি ফ্রি কাজ করি তাহলে আমরা কী করে খাব। আবার কোম্পানিগুলোর রয়্যালিটিও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এর মধ্যে অনলাইন প্রোগ্রামগুলো করে আমরা টাকা পাই না। কিন্তু আমাদেরও তো বাড়িভাড়া দিতে হয়। খাবারদাবার কিনতে হয়। এখন আমাদের সব শিল্পী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেউ আর সম্মানী ছাড়া গান করবেন না। সবাই আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে ফ্রি গান না করি, আমিও সম্মতি দিয়েছি। কিন্তু এটা শেষ পর্যন্ত আমরা টিকিয়ে রাখতে পারব কি না জানি না। কারণ অনেক সময় বন্ধু বা পরিচিতজনদের অনুষ্ঠানে হয়তো দুয়েকটি গান গাইতে হবে। সেটা তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু ফেইসবুক লাইভ বা অনলাইন শোগুলোতে আমরা অবশ্যই টাকা নেব। যদিও আমরা জানি না শেষ পর্যন্ত পারব কি না, কারণ আমরা শিল্পীরা তো উদার প্রকৃতির।’
তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী জাকিয়া সুলতানা কর্নিয়া বলেন, ‘এখন তো শিল্পীদের কোনো কাজ নেই। অন্যান্য সবকিছু চালু হলেও আমরা শিল্পীরা যারা আছি তাদের কাজ কিন্তু সহসাই শুরু হবে না। কারণ মানুষ গান কখন শোনেন? মানুষ যখন আনন্দে থাকেন তখন গান শোনেন। ফলে এই পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রীসহ জড়িত সবাই কিন্তু বেশ সংকটে আছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে ফেইসবুক বা জুমে ফ্রি গান করা হচ্ছে। এর আগে দেখা গেছে, চ্যানেলগুলো ডাকলে একটা সম্মানী দিতো, কিন্তু এখন লাইভে অংশ নেওয়ার ফলে আমরা কিন্তু সেই সম্মানীটাও পাচ্ছি না। অনলাইন শোগুলোর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু হতাশ হয়ে আমরা লক্ষ করছি অনলাইন শোগুলো থেকে আমরা কোনো লাভবান হচ্ছি না। সেজন্যই সবাই মিলে সিদ্ধান্তে এসেছি, পারিশ্রমিক ছাড়া কোনো কাজ করব না।’
শিল্পীরা তাদের বিবৃতিতে বলেছেন, ‘করোনার ছোবলে এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা। আর তাই এখন সব কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং সংগীত সংশ্লিষ্টগণ একত্র হওয়ার সময়। পরিচ্ছন্ন গান প্রাণে আশার আলো সঞ্চার করে। গানের ভূমিকা এবং শক্তি অপরিসীম। সেই গানকে আমরা যারা ভালোলাগা/ভালোবাসা/আর পেশা হিসেবে নিয়ে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তারা বর্তমানে এক কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে আছি। দর্শক-শ্রোতাই শিল্পের শক্তি কিন্তু করোনার ছোবলে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার্থে তা আজ অসম্ভব। লোকসমাগম এবং সংগীতের পরিবেশ ফিরে পাওয়া আজ অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আটকে গেছে।
উন্নত দেশের সংগীত সংশ্লিষ্টরা যখন ঘরে বসেই প্রযুক্তির মাধ্যমে উপার্জন করছেন, তখন নানা জটিলতায় আমরা এই উপার্জন থেকেও অনেক দূরে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে টেলিভিশন বা অন্যান্য মাধ্যমে স্পন্সর নিয়ে যারা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করছেন তাদের ধন্যবাদ। তবে ইদানীং আমরা দেখছি সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্নভাবে যেমন ফেইসবুক, জুম, স্ট্রিমইয়ার্ড বা নানা মাধ্যমে লাইভ টকশো কিংবা মিউজিক্যাল অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে যা প্রশংসনীয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে আয়োজনের সম্মানী থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সব সংগীতযোদ্ধা। অনেকের অপেশাদার কর্মকাণ্ডে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ শিল্প ও শিল্পীর পেশাগত জায়গা। তাই বর্তমান এই সংকটময় অবস্থায় শিল্পীর সম্মান এবং এই শিল্প বাঁচানোর প্রেক্ষিতে আমরা এক হয়েছি। ভবিষ্যতে যাতে এ শিল্প বেঁচে থাকে সেই স্বার্থে আমরা সম্মানী ছাড়া কোনো অনলাইন আয়োজনের লাইভে অংশগ্রহণ করব না বলে অঙ্গীকারবদ্ধ।