হাওর বার্তা ডেস্কঃ নভেল করোনা ভাইরাস-১৯ সংক্রমন মোকাবিলায় কার কী করণীয়?
এই পর্বের লেখাটি লিখতে গিয়ে বারবার বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটি মনে পড়ছে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মাত্র তিনজন মানুষের শরীরে নভেল করোনা-১৯ ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করা গেছে।
পরিসংখ্যানটি আশাব্যঞ্জক হলেও এটি আসলেই বাস্তবতার কতটুকু প্রতিফলন, সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। যে দেশে মানুষের শরীরে নভেল করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করার সুযোগ খুবই সীমিত, সেখানে ঠিক কতজনের শরীরে এই মুহূর্তে ভাইরাসটি আছে তা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব।
পরিসংখ্যানের হিসেবে না গিয়েও তাই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাংলাদেশও নভেল করোনা-১৯ ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর মহামারীর ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই সম্ভাব্য ঝুঁকির চিন্তা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের কার কী করণীয় তা নির্ধারণ করতে হবে।
নভেল করোনা ভাইরাস-১৯ সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব কার জিজ্ঞেস করলেই সবাই আঙ্গুল উচিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাবার আগে আমরা নভেল করোনাভাইরাস-১৯ সংক্রমন নিয়ন্ত্রণের কিছু মৌলিক বিষয় জেনে নিই-
নভেল করোনাভাইরাস-১৯ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমকে আমরা প্রধানত দুইভাগে ভাগ করে নিতে পারি: তা হলো ভাইরাস সংক্রান্ত করণীয়, এবং এটি নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম।
প্রথমত, মানুষকে নভেল করোনাভাইরাস-১৯ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানাতে হবে। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে যেখানে অসংখ্য ভুল তথ্য সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে কাজটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই তথ্য জানানোর কাজটি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগেই হতে হবে। এখানে মূলধারার মিডিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে, কীভাবে এই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে, একজনের কাছ থেকে কীভাবে আরেকজনের কাছে যেতে পারে? সেই সঙ্গে কীভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমন প্রতিহত করা যেতে পারে সেটাও সবাইকে জানাতে হবে, যাতে স্ব স্ব অবস্থান থেকে মানুষ তার করণীয় সম্পর্কে জানতে পারে।
এমনিতে আমাদের দেশের গণমানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনুশীলনের বিষয়টা খুব উন্নতমানের নয়। রাস্তাঘাটে থুথু ফেলা, নাক ঝাড়া, জনসন্মুখে নাক খোঁটা, পর্যাপ্ত সংখ্যক বার হাত না ধোওয়ার মতো ব্যাপারগুলো অনেকটা আমাদের জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ নভেল করোনাভাইরাস-১৯ সংক্রমন প্রতিরোধে এই ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো বদলাতে হবে। আর গণমানুষের অভ্যাসে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
মাঠ পর্যায়ের অপারেশনাল কার্যক্রম নির্ধারণে আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে, মানুষ থেকে মানুষে নভেল করোনাভাইরাস-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকি কমানো। এ লক্ষ্যে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো, নিয়মিত হাত ধোয়াসহ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের ‘সামাজিক দূরত্ব’ (সোশাল ডিসট্যান্সিং) নিশ্চিত করতে হবে। শুরুর দুমাসের মধ্যেই চীন কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ইটালির মতো উন্নত দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে আমাদের নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবার সুযোগ নেই। এখনই বাংলাদেশে সব ধরনের গণজমায়েত আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তাদের সমাবেশ আপাতত বন্ধ রেখেছে, যা শুভ লক্ষণ।
১৭ মার্চের মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন অনুষ্ঠানের জনসমাবেশ আপাতত স্থগিত করে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছেন। পাশাপাশি বিয়ে, জন্মদিন, আলোচনা সভার মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে সরকারীভাবে ঘোষণা দিয়ে সাময়িকভাবে এসব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা উচিত।
অফিসে সম্ভব, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসা থেকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের ভীড়ে ঠাসা বাস-রেলে যাত্রীর সংখ্যা যাতে কমে, সে কারণেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আপাতত ঘরের বাইরে যাবার দরকার নাই। ঘনঘন বাজারে যাবারও দরকার নাই। আগামী তিন-চার সপ্তাহের জন্যে সারা দেশব্যাপী আমাদের চলাচলসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সীমিত করতে হবে যাতে অনেক মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যায়। অন্যথায়, করোনা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
একটি বৃহত্তর সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে তিন-চার সপ্তাহ থেমে থাকা এমন কঠিন কোনো কাজ নয়। বিশেষ করে সেই জাতির জন্য, যারা ন্যূনতম প্রস্তুতি ও সামর্থ্য নিয়ে একাত্তরের মতো একটি অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। করোনার বিরূদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আমাদের প্রধান প্রয়োজন একটি সঠিক নেতৃত্ব ও কতিপয় সময়োপযোগী নির্দেশনা। কথা প্রসঙ্গে সেদিন জেনেভায় কর্মরত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আমাকে ফোনে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রধানমন্ত্রীই সেই মানুষ, যার ওপরে অনায়াসে আস্থা রাখা যায়’। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমিও জানি, ‘শেখ হাসিনা এখনো পারে, শেখ হাসিনাই পারে’।
কেবল ঢাকা শহরে নয়, সারাদেশব্যাপী আমাদের হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। সেখানে ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্তকরণের সুবিধা, প্রয়োজনে রোগীকে অন্যদের থেকে আলাদা (আইসোলেশন) করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোগীর ফুসফুস আক্রান্তসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এই চিকিৎসার বিষয়ে এবং প্রদানকালে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত লিখবো।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন, কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসহ সরকারের প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রাখতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষা, তথ্য, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়, বানিজ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে।
বিমানবন্দরসহ আমাদের সব সীমান্ত এলাকায় সম্ভাব্য রোগী সনাক্তকরণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যে মহামারী রোগ নিয়ন্ত্রণে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা প্রয়োগসংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছেন। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অযাচিতভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে জনজীবনকে যেন বিপন্ন করে তুলতে না পারে, সেদিকে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নজরদারি করতে হবে। জাতির এই সম্ভাব্য দুঃসময়ে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো যেতে পারে। এই দুঃসময়ে দেশব্যাপী হতদরিদ্র মানুষদের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা জরুরি।
সরকারের একার পক্ষেও এই সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা এড়ানো দুঃসাধ্য, এ ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতসহ পুরো দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে, কেতাবি ভাষায় যাকে বলে ‘হোল কম্যুনিটি অ্যাপ্রোচ’। নাগরিক হিসেবেও সমষ্টিগত এবং আত্মরক্ষার স্বার্থে আমাদের সবাইকে নাগরিক দায়িত্বসমূহ পালন করতে হবে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অনুশীলন যার মধ্যে অন্যতম। কারো শরীরে নভেল করোনা-১৯ ভাইরাস সংক্রমনের ঝুঁকি থাকলে প্রয়োজনে কিছু মানুষের চৌদ্দদিন নিজ দায়িত্বে স্বগৃহে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকতে হবে।
যদি মানুষজন স্বগৃহে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ না থাকতে চায়, তাহলে তাদের হাজি ক্যাম্প, স্কুল-কলেজে বা সাইক্লোন শেল্টারের মতো জায়গায় কোয়ারেন্টাইন করে রাখতে হবে। দেশব্যাপী গণসচেতনতা বাড়াতে একটি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন, এনজিওগুলো যেখানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় আরো অনেক পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
এমনিতেই বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ, তার ওপরে আমাদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের সক্ষমতা এখনো বেশ পিছিয়ে। পর্যাপ্ত আইসিইউ সেবা প্রদানের সুযোগ আমাদের নাই। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প কিংবা দেশের বিভিন্ন বস্তির কথা ভাবলে আমি খুব আতঙ্কিত বোধ করি। ঢাকা শহরেও মানুষের বিশাল ভীড়। এই পরিস্থিতিতে অসুখ হবার পরে চিকিৎসার চেয়ে অসুখ হবার আগেই প্রতিরোধ করাটা আমাদের জন্য উত্তম। আমাদের জন্য অধিক প্রযোজ্য হলো ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’।