রোদের খরতাপ ম্লাান হয়ে আসছে দিনে দিনে। মাঠে মাঠে পেকে উঠেছে আমন ধান। ইতিমধ্যেই কাটা-মাড়াই চলছে। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষাণ-কৃষাণীর মন ভরে উঠেছে।
ধান কাটা নিয়ে কৃষাণ-কৃষাণীরা ব্যস্ত সময় পার করছে। সেই ধানে নতুন চাল দিয়ে গ্রাম বাংলায় চলছে নবান্নের উৎসব। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতির রূপ। কুষ্টিয়ায় আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক।
আমন ধানে ভরে গেছে মাঠ। যতদূর চোখ যায় ততদূর মাঠে মাঠে হাওয়ায় দোলা খাচ্ছে সোনালী ধানের শীষ। চারিদিকে মৌ মৌ গন্ধ আর ফসলি জমিতে আমন ধান দেখে কৃষকের মন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠছে।
চলতি মৌসুমে কুষ্টিয়ায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশী জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। এবছর জেলার ছয় উপজেলায় ৮২ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে এ ধানের চাষ হয়। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ফলনও হচ্ছে বাম্পার। এখন চলছে ধান কাটার কাজ। তাই কৃষক ও কৃষাণীদের যেন এখন দম ফেলার সময় নেই।
ধান কাটা ও মাড়াইয়ে চরম ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। তবে ধানের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। চাষিরা ব্যস্ত ধান কাটা নিয়ে গৃহিনীরা ব্যস্ত নবান্ন উৎসব নিয়ে। ঘরে ঘরে চলছে এখন পিঠা পায়েস খাওয়ার আয়োজন। তবে কুষ্টিয়ায় দেরীতে আমন রোপা লাগানোর কারণে অন্যান্য জেলার থেকে ১০-১৫ দিন পর ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। তবে বসে নেই কৃষকরা।
চিরায়ত বাঙ্গালীর নবান্ন উৎসব পালনে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণীরা। নতুন ধান ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নবান্ন উৎসবে মেতে উঠছে গ্রাম বাংলার কৃষকদের ঘর। গত বছর বোরোর ফলন ভালো হলেও কৃষকরা দাম না পাওয়ায় হতাশ। এবার ফলন ভালো হলেও দাম না পেলে কৃষকদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
বাজারে নুতন ধান প্রতি মণ সাড়ে ৫শ টাকা থেকে সাড়ে ৬শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবার এই মওসুমে পপ্রতি মণ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে কি উঠবে না এই নিয়ে কৃষকরা হতাশায় ভুগছে। তারপরেও নবান্ন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে তারা গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চায়।
দৌলতপুর উপজেলার বেজপুর এলাকার চাষী নিয়ামত আলী জানান, এবছর আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ১৬ থেকে ১৮ মন হারে ধান হচ্ছে তার। কারও কারও ২০ মন হারেও ধান হচ্ছে। ধানের ফলন নিয়ে খুশি হলেও দাম নিয়ে সে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তার দাবি সরকার যেন ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে। আবারও অনেকে জমির ধান কেটে ইতোমধ্যে অর্থকরী ফসল হিসেবে ক্ষতিকর তামাক গাছও রোপন করেছেন।
কৃষকদের দাবি কম সময়ে তামাক চাষ করে নগদ অর্থ হাতে পাওয়া যায়। যা অন্যান্য ফসল থেকে পাওয়া সম্ভব হয় না। আড়িয়া এলাকার কৃষক তমিজ উদ্দিন জানান, সে এবছর ৩ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিল। ফলনও হয়েছে বাম্পার।
তিনি আরও বলেন, বাড়তি আয় ও আর্থিক সুবিধার জন্য অনেকে ধান কেটে সে ওই সকল জমিতে তামাক গাছ রোপণ করেছে। মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামের কৃষক মোঃ জামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে ব্রি-৪৯ ধানের ৫কেজির এক প্যাকেট ধানের বীজ নিয়ে বপণ ও রোপণের পর তা কাটাসম্পন্ন করেছে। এক বিঘা জমিতে সাড়ে আঠারো মন ধানের উৎপানন হয়েছে। এতে করে খুশী তিনি।
amon_dhanএদিকে, কৃষি বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ২০১৪ সাল থেকে মাঠ পর্যায়ে জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান-৬২’র আবাদ শুরু হয়। ভেড়ামারা উপজেলার বারোমাইল গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমন মৌসুমে স্বল্প সময়ের মধ্যে ধান উৎপাদন সম্ভব কৃষি াধিদপ্তরের এমন কথা শুনে তিনি এক বিঘা জমিতে ব্রি-৬২ আবাদ করেন। তিনি ৯৯ দিনে ধান কর্তন করে ফলন পেয়েছেন প্রায় ১৮ মন ধান। তিনি এই ফলনে বেশ খুশী।
স্বল্পমেয়াদি এই ধান কর্তনের পর আগাম সরিষা বা মসুর বোনা যায়। এ সময় সরিষা আবাদ করলে ফলনও ভালো পাওয়া যায় এবং স্বল্প সময়ে দামও ভাল পাওয়া যায়বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিউিট কুষ্টিয়া অঞ্চলের প্রধান এবং উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান দেওয়ান জানান, খাদ্য হিসাবে গ্রহণকৃত ভাতে জিংক এর ঘাটতির বিষয়টি উপলদ্ধি করে বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর গবেষকগণ নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জেলায় ৭৭৭ হেক্টর এর মধ্যে ৩২ হেক্টর প্রদর্শণীর জন্য চাষ করার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এগ্রিকালচারাল এডভাইজরি সোসাইটি (আস) এর নির্বাহী পরিচালক হারুন-আর-রশীদ বলেন, চলতি রোপা আমন মৌসুমে ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ১৯টি উপজেলার ১০৮টি গ্রামের ১১২৫ জন প্রশিক্ষিত কৃষকদের মাঝে জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২ জাতের প্রদর্শণী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান ৬২ এর আশানুরূপ ফলন পাওয়াই চলতি রোপা আমন মৌসুমে প্রদর্শনী প্লটের কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে বলেও জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিংকর চন্দ্র দাস জানান, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমন চাষীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে বলে ধানের বাস্পার ফলন হয়েছে। আর ধানের ন্যায্য মূল্যের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। ধানের মূল্য নিয়ে কৃষকদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাই তাদের মাঝে বইছে আনন্দ বন্যা। আর এ আনন্দ কৃষাণ-কৃষাণীদের নিত্য সঙ্গী হবে যখন তাদের পরিশ্রমের ফসল ক্রয়ে সরকার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে।