ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির জন্য শোক

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  গত ২৫ ডিসেম্বর আমার চিকিৎসক বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে যাচ্ছি। পথিমধ্যে বাপ্পির ফোন এলো, শ্বাসকষ্টে ও কথাই বলতে পারছিল   না। হাঁপানি, গায়ে ব্যথায় অনেকদিন ধরে ভুগছিল। পরদিন হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আতিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওখানে ভর্তি হয়ে গেল বাপ্পি। প্রতিদিন খোঁজখবর রাখছিলাম।

চিকিৎসা চলছিল, একপর্যায়ে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হল। এর আগের দিন বেশ রাতে বাপ্পির ফোন পেলাম। শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একটা গরিব শিশুর জন্য আরও ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করল। নিজে গুরুতর অসুস্থ, অথচ ওই শিশুর জন্য তার কণ্ঠভরা ছিল আকুলতায়। শিশুটা এখন সুস্থ আছে, কিন্তু বাপ্পি নেই। বাপ্পি আর নেই। অফিস করছিলাম, ডা. মামুন খান, সাংবাদিক গনি আদম জানাল বাপ্পি চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আকস্মিক শোকে বিমূঢ় হয়ে গেলাম।

নড়াইলে জন্ম, বাবা-মা বঙ্গবন্ধুর মহীয়সী পত্নীর নামে নাম রেখেছিলেন ফজিলাতুন নেসা। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। ছাত্র রাজনীতির উত্তাল সময়ের সারথি ছিল সে। তুখোড় বিতার্কিক ছিল, বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দাপটের সঙ্গে বিতর্ক করেছে; পরবর্তী সময়ে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মাঝে মাঝেই বিতর্ক মঞ্চে দেখা হতো।

সেই সদা হাস্যময় প্রাণবন্ত বাপ্পি ছাত্রজীবন শেষে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হল। দ্রুতই নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতির প্রমাণ রাখল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নজরবন্দি হল। ওয়ান-ইলেভেনের ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনা যখন কারাবন্দি তখন তার সঙ্গে দলীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে চিরকুট বা পত্র বিনিময়ের মাধ্যম ছিল সে।

কর্মজীবনে আইন পেশাকে বেছে নিয়েছিল। অমন দুর্যোগময় সময়ে জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে আইনজীবীর কালো পোশাকের আড়ালে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দলীয় দুই শীর্ষনেতার মাঝে অসাধ্য সমন্বয় সাধন করেছে সে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কৌঁসুলি ছিল; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতকরণে দক্ষতা আর সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে সে। পরবর্তীকালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আন্তরিকতার সঙ্গে নিজ পেশার মর্যাদা রক্ষার্থে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি সে ছিল গণমানুষের রাজনীতিক; হাট-মাঠ-ঘাট চষে বেড়াত।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ২০১১ সালে সংরক্ষিত নারী আসন-৪৭-এর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হল। ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসন-৩০ থেকে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হল। সংসদে অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিল। টেলিভিশনের টকশোয় তার বক্তব্য ছিল অকাট্য যুক্তিনির্ভর। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সে। তার সঙ্গে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এ সংক্রান্ত কত সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেছি। সৎ রাজনীতিক হিসেবে জীবনযাপন করত। মৃত্যুর সময়ও মিরপুরে ভাড়া বাসায় থাকত।

জাতীয় সংসদ ভবনের জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করলেন। প্রটোকলের কর্মকর্তারা কফিনের ওপর পুষ্পস্তবকটা একটু বাঁকা করে রেখেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরম মমতায় নিজ হাতে সেটাকে নিখুঁতভাবে রাখলেন।

বাপ্পি, আমরা জানি মরণের ওপারে যে অজানা ভুবনে তুমি চলে গেলে, সেখানেও তোমার জন্য সংরক্ষিত আছে মমতাময় স্থান, তোমার কর্মের জন্য, তোমার মর্মের জন্য। তোমার গুণগ্রাহী অসংখ্য মানুষের মতো আমিও তোমার পারলৌকিক শান্তি কামনা করছি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর