প্যারিসে গত শুক্রবার রাতের ভয়াবহ সন্ত্রাসে যুক্ত যে আটজন হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত হয়েছে তাদের একজনই কেবল সিরিয়া থেকে আসা অভিবাসী। তবে সে নিশ্চয় অভিবাসী হিসেবে আসেনি, আইএসের সদস্য হিসেবে সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্য নিয়েই প্যারিসে এসেছিল। বাকি সাতজনই ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী ফরাসি নাগরিক। তবে হ্যাঁ তারা কেউই শ্বেতাঙ্গ কিংবা খ্রিস্টান নয়, মুসলমান এবং আরব ও মাগরেব অঞ্চলের বংশোদ্ভূত।
গত জানুয়ারিতে যে তরুণরা প্যারিসে ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকা চার্লি অ্যাবদো দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল তারাও একই ধরনের ফরাসি নাগরিক। এর মাঝে যারা বাজারে সন্ত্রাস চালিয়েছিল তাদের পরিচয়ও একই রকম। আর কয়েক বছর আগে লন্ডনে বোমা হামলায় জড়িত তরুণরাও ব্রিটেনের নাগরিক। তবে তাদেরও বংশ পরিচয় একই রকম।
ফ্রান্স এবং ইউরোপ কোনোভাবে কী দায়ী নয় তাদের মুসলিম অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের মূলধারায় গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে? সংবাদপত্রের ভাষ্য থেকে জানা যায় এদের জীবন রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার। বসবাসের এলাকায় সব ধরনের নাগরিক সেবা ঠিকঠাক থাকে না। এদের জন্যে স্কুল-কলেজে উচ্চতর পড়াশুনার সুবিধাও কম। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হল এদের মধ্যে বেকারত্বের অস্বাভাবিক উচ্চ হার- প্রায় ৪০ ভাগ। আয় কম বা অনিশ্চিত হলে উন্নত শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নাগরিক সেবার আনুকূল্য পাওয়া মুশকিল হয়।
ফ্রান্সে মূলত আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকেই অভিবাসীরা এসেছে, তাদেরই সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে। এর মধ্যে আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া, সেনেগাল উল্লেখযোগ্য। উপনিবেশগুলো সর্বতোভাবেই শোষিত হয়েছে। বিনিময়ে এসব দেশের অধিবাসীদের মধ্যে একটা শ্রেণি ভাষা-সংস্কৃতিসহ তৈরি হয়েছে ফরাসি কেতায়, যেমন আমাদের উপমহাদেশে তৈরি হয়েছে ইংরেজি কেতায়, আবার ঠিক আমাদেরই মত সমাজের আরও বৃহৎ একটি অংশের জন্যে, যারা বিত্তবান বা সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখে, ঔপনিবেশিক উন্নত দেশটি হয়ে যায় সাফল্য লাভের স্বপ্নের দেশ। নিজ দেশের দারিদ্র কিংবা অগণতান্ত্রিক পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্যও অনেকেই সুযোগ পেলেই পাড়ি দিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির মূল ভূখণ্ডে। একে বলা যায় কর্মফল- পরাধীনতার উপজাত বিড়ম্বনা।
সমালোচনা আছে, এই মানুষগুলোকে ফ্রান্স কখনো মূলধারায় মিশিয়ে ফেলতে পারেনি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত এরা সকলেই উপেক্ষা, বঞ্চনা, বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে এবং সেই সাথে তাদের সাথী হয়েছে দারিদ্র ও বেকারত্ব। যে প্রায় পাঁচ হাজার তরুণ ইউরোপ থেকে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের সাথে যোগ দিয়েছে তার মধ্যে চার হাজারই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণকারী এবং সে সব দেশের নাগরিক। তারা সেই সব দেশেই শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু তাদের ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ যে দিনে দিনে পুঞ্জিভূত হয়েছে সে খবর কেউ রাখেনি।
এর সাথে যোগ হয়েছে ২০০১ থেকে ওয়ান ইলেভেনের পরে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভূমিকা। তারা ইরাক আক্রমণের ছুতা খুঁজছিল, এবং শেষ পর্যন্ত ছলনার আশ্রয় নিয়ে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। সেখানে অস্থিতিশীলতার চূড়ান্ত ঘটিয়ে, নিরীহ মানুষকে হানাহানিতে ঠেলে দিয়ে তারা গাদ্দাফিকে উৎখাতের লক্ষ্যে লিবিয়ায় ঢুকেছে। সাদ্দাম, গাদ্দাফি ও বাশার সকলেই একনায়ক। ভিন্নমতকে তারা হত্যা, নির্যাতন ও নির্বাসনের মাধ্যমে দমন করেছে। প্রত্যেকটি দেশেই দেশত্যাগী ভিন্ন মতাবলম্বী রয়েছে অনেক। দেশের ভিতরেই ভিন্ন মতের উপস্থিতি কম নয়। কিন্তু পশ্চিম যে কায়দায় শাসন পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে তাতে এসব দেশে চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমের আগ্রাসনের পরে কত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিতে? আফগানিস্তান থেকে ইয়েমেন, লিবিয়া থেকে সিরিয়া মানবিক বিপর্যয়ের দায় কার ঘাড়ে বেশি পড়বে? ইউরোপে আইএস সদস্য সৃষ্টিতে যেমন এক্ষেত্রেও তেমনি পশ্চিম কি তাদের দায় অস্বীকার করতে পারবে?
একইভাবে দায় অস্বীকার করতে পারে না মুসলিম জনগোষ্ঠী, বিশেষভাবে সৌদি আরবসহ আরবের মুসলিম সম্প্রদায়। তারা কি নিজেদের দেশে দেশে যুগ যুগ ধরে এমন সব রাজতন্ত্র ও একনায়কদের ক্ষমতায় বসিয়ে রাখেনি যারা নিজেরা যুগপৎ দোর্দণ্ড ক্ষমতাধর স্বৈরাশাসক ও ধনবাদী বিশ্বের শিখণ্ডির ভূমিকা পালন করে? এর ফলে এসব কোনো দেশেই যুক্তির চর্চা হয় নি, আলোকিত আধুনিক সমাজ গড়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিসিয়া বা মিশরে শাসক পরিবর্তনের হাওয়া তুলেছিল ঠিকই কিন্তু তার ফায়দা তো আর বসন্তের উদগাতা প্রগতিশীল চেতনার শক্তি নিতে পারেনি। ঠিক তিন যুগ আগে ইরাকের শাহ-বিরোধী বিপ্লবের সময়ও আমরা দেখেছি সূচনায় যে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের লাগাম ছিল বামপন্থী খালক্ ও পারচাম দলের হাতে তা হাত-ফস্কে চলে গেল চরমপন্থী ইসলামীদের হাতে। স্বৈরাচারী শাহীশাসনের বিরুদ্ধে সূচিত বিপ্লব শেষ পর্যন্ত পরিচিতি লাভ করল ইসলামি বিপ্লব নামে এবং প্রথম ধাক্কাতেই প্রাণ হারাল বামপন্থী নেতারা। হাজার হাজার প্রগতিশীল চেতনার মানুষ হয় প্রাণ হারান, জেলে পচে মরেন অথবা দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। তিন যুগ পরেও পরিস্থিতি পাল্টায় নি।
কি করে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে মুসলিম জ্ঞানসাধকরা বিশ্ববিজ্ঞানের অগ্রদূতে পরিণত হয়েছিল সেটা আজ শিক্ষণীয় বিষয় বটে, কিন্তু সে শিক্ষা কে নিচ্ছে? বর্তমান বিশ্বে যেভাবে ভোগবাদিতা এবং বাজার অর্থনীতির রমরমা চলছে তাতে বাস করে কে চিন্তাভাবনা এবং স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটার ঝুঁকি নেবে? শুধু মনে প্রশ্ন জাগে যে আরব তরুণদের অধিকাংশই ভোগবিলাসে অভ্যস্ত ছিল তারা হঠাৎ জেগে উঠে জঙ্গিবাদে জানবাজি রাখতে ছুটছে কেন? পশ্চিমের শোষণ-বঞ্চনা এবং ভ্রান্ত নীতি তো আছেই, তার সাথে রয়েছে তাদের চতুর কূটচাল। পর্যবেক্ষকদের ধারণা মুসলিম তরুণদের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তি ও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধে লিপ্ত শিয়াপন্থী হিজবুল্লাহকে শায়েস্তা করার কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই উগ্রপন্থী সুন্নি জঙ্গিদল আইএস তৈরি করা হয়েছিল। কারণ সৌদি আরবসহ এশিয়া আফ্রিকার অশ্বেতাঙ্গ জাতিসমূহের দেশে দেশে রাজনৈতিক সামাজিক সংকট ঘনীভূত হলে পশ্চিমের শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু যায় আসে না।
যেভাবে ওরা বসনিয়ায় মুসলিম নিধনের সময় হস্তক্ষেপে বিলম্ব ঘটালো, আবার বিপরীতে ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানে যেভাবে তাড়াহুড়া করে হস্তক্ষেপ করল তাতে তাদের বিবেচনাবোধের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা মুশকিল। হ্যাঁ, যদি ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটে, বা স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটে যা তাদেরসহ মানবজাতিকে এবং তাদের দেশসহ সারাবিশ্বকে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে তাহলে তারা দ্রুত সক্রিয় হবে, কার্যকর ব্যবস্থাও নেবে। জলবায়ু পরিবর্তনকেও মাথায় নেবে, কারণ তার মাত্রা ও পরিধি পরিবেশ বিপর্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। পরিবেশের প্রভাব প্রায় স্থানীয়, কিন্তু মহামারীসহ স্বাস্থ্যসমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের আওতা কোনো দেশের সীমানা মানবে না, তা বৈশ্বিক। তারা যেমন বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তেমনি ক্রমেই বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকছে। এর কারণ বোঝা সহজ। শক্তিমান দেশ হিসেবে বর্তমান বিশ্বের মানবসৃষ্ট সম্পদের আশি শতাংশ আজ যেমন তাদের হাতে তেমনি ভবিষ্যতেও যেন থাকে তা নিশ্চিত রাখতে হলে তাদের আরও সব কৌশল খাটাতে হবে। যার অন্যতম হল মুক্তবাজার অর্থনীতি। যারা অর্থনীতির খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন যে এরা যখন আমাদের ওপর কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি তুলে নেয়ার জন্যে চাপ দেয় তখন কিন্তু নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য স্থিতিশীল এবং অর্থনীতির গতি ঠিক রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এর জন্যে নিজেদের স্বার্থে আরও নানান কৌশল তারা অবলম্বন করে থাকে।
আরব বিশ্বের সাথে আচরণে পশ্চিম বরাবর দ্বৈতনীতি কিংবা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলেছে। সৌদি আরবের জন্যে গণতন্ত্র ফরজ নয়, কিন্তু ইরাকের ক্ষেত্রে তা ছিল অত্যাবশ্যক! সাদ্দাম-গাদ্দাফিরা স্বৈরাশাসক কিন্তু হোসনি মোবারক নন! এরকম আশ্চর্য নীতির বাস্তবতায় মাথা গরম করে সংঘাতে জড়িয়ে ফায়দা পাওয়া মুশকিল। তৃতীয় বিশ্বে এখনও সমাজবাদী রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা ফুরায় নি। সেটা বাংলাদেশের জন্যে যেমন খাটে তেমনি খাটে আরব বিশ্বের সকল দেশের জন্যে। তাদের, বস্তুত উন্নয়নশীল সব দেশের, আরও প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের নানান কৌশল সম্পর্ক ভালোভাবে অবহিত থাকা। নিজের ধর্ম রক্ষা করেও মেনেই এভাবে চলা সম্ভব। বরং এভাবেই ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা অধিকতর নিরাপদ থাকবে।