হাওর বার্তা ডেস্কঃ পেঁয়াজের দাম লাগামহীন। বাজারে আগুন। দামের নৈরাজ্যে মধ্যবিত্তের অধরা পেঁয়াজ। অনেকে বলছে, এটি আকাশে উঠে যাচ্ছে। যে নামেই এর ‘দড়ি ছেঁড়া’ ভাব প্রকাশের চেষ্টা করা হোক না কেন; কোনোটাই এখন আর পেঁয়াজের দামের যে উচ্চতা, তা বোঝাতে যথেষ্ট নয়। সাধারণত ভোক্তারা নিত্য এ পণ্যটির দাম ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে দেখে অভ্যস্ত। সেখানে যখন ১০০, ১৫০ অতিক্রম করে ২০০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে গেছে, তখন কোনো ব্যাখ্যা, যুক্তি বা আবেগ-অনুরাগেও মেলাতে পারছে না এর হিসাব। বলা যায়, দেশজুড়েই দোকানে গিয়ে নির্বাক, হতভম্ব সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। অথচ বাজারে পণ্যটির বিপুল সরবরাহ চোখে পড়েছে। কোথাও সংকটের তথ্য পাওয়া যায়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে, ক্রেতা-বিক্রেতা, বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
আমদানি সংকটের অজুহাতে পেঁয়াজের বাজারে এখন রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। গতকাল রাজধানীর খোলাবাজারে মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। দু-তিন দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা।
এ নৈরাজ্যের পেছনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জড়িত থাকতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে খোদ সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনের এক প্রতিবেদনে। বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে একটি সিন্ডিকেট থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়। গতকাল কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পরও দুই লাখ ৯০ হাজার টন পেঁয়াজ মজুদ ছিল। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ছয় হাজার টন করে খরচ হওয়ার কথা। সেই হিসাবেও যে মজুদ থাকার কথা, তা দিয়ে আরো দেড় মাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাহলে পেঁয়াজের দাম এত বাড়ল কেন? এ বিষয়টি প্রতিযোগিতা কমিশন খতিয়ে দেখছে। আমরা মনে করি, এর পেছনে কোনো অসাধু ব্যবসায়ীচক্র একচেটিয়া মুনাফা করছে।’
অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক লাফে এত টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাজারে কথা প্রচলিত রয়েছে, একই ব্যক্তি আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুদ্রাপাচার হচ্ছে। সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক গোয়েন্দাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।’ তিনি মনে করেন, এটা শুধু বাণিজ্যিক কারণ নয়; এর পেছনে অন্য কোনো ফাঁয়দা নেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে।
গতকাল রাজধানীর এজিবি কলোনির বাজারে কথা হয় একজন বেসরকারি কর্মকর্তা সেলিনা ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘পেঁয়াজের বাজারে এমন নৈরাজ্য এর আগে কখনো দেখিনি। ৩০ টাকার পেঁয়াজ ২০০ টাকা! এটা যেন মগের মুল্লুক। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
ওই বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা নুরুল সরদার কালের কণ্ঠকে জানান, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় খুচরায়ও বেড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি সরবরাহ ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন।
কারওয়ান বাজারের নিউ ভাই ভাই স্টোর দোকানের কর্মী রুহুল মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে এমন অরাজক অবস্থা গত ৪০ বছরেও দেখিনি। এক লাফে ২০০ টাকা কেজি! গেল তিন দিনে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭০ টাকা।’ কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি সরকার আমদানিকারকদের চাপ দিচ্ছে, জরিমানা করছে। তাই তারা আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।’
শান্তিনগর বাজার ঘুরে বিপুল পরিমাণে দেশি পেঁয়াজ দেখা গেছে। তবে বিক্রেতারা দাম চেয়েছেন বেশি। বোর্ডে কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৮৫ টাকা উল্লেখ থাকলেও ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ সময় অনেক ক্রেতা বিরক্ত হয়ে দুই কেজির স্থলে এক কেজি কিনে ফিরে যায়।
একইভাবে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কোনো দোকানে পেঁয়াজ নেই—এমন কথা শোনা যায়নি। এর পরও কেন আকাশছোঁয়া দাম? এমন প্রশ্নে নানা অজুহাত দেখান বিক্রেতারা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মুখপাত্র হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজের বাজারে সংকট কাটাতে টিসিবি নিয়মিত ট্রাক সেল বাড়িয়েছে। পাঁচটি ট্রাকের খোলাবাজার এখন ৩৫টিতে উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা ধরে বিক্রি করা হচ্ছে। এর পরও কেন এভাবে দাম বাড়ছে; তা বোধগম্য নয়।’
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রদেশ পোদ্দার জানান উল্টো কথা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজ নেই। বুলবুলের কারণে গত তিন দিন মিয়ানমারের পেঁয়াজ দেশে আসেনি। এ ছাড়া সরকারি দপ্তরের লোকেরা কোনো কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীদের জরিমানা ও হয়রানি করছেন। ফলে তাঁরাও আতঙ্কিত হয়ে আমদানি করছেন না। সব মিলিয়ে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। বাজারে ভারতের পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত পেঁয়াজের সংকট কাটবে না।’
কনজ্যুমার অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান পেঁয়াজের বাজারের চলমান সংকট দেখে চরম হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী, অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী। সরকারে এমন অনেক বড় বড় মন্ত্রী ব্যবসায়ী হওয়ার পরও ভোগ্যপণ্যের বাজার এতটা নিয়ন্ত্রণহীন হবে, ভাবা যায় না। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী পুুরো পেঁয়াজের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের অনুরোধে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর পেঁয়াজ আমদানি করার কথা থাকলেও সেই পেঁয়াজ এখনো বাজারে আসেনি। এটা এক ধরনের আইওয়াশ।’
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, পেঁয়াজের আমদানি কমছে। গত জুলাই মাস থেকে গত বুধবার পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৮৮ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টন।
সরকারি সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত সাতটি দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাঁচ হাজার টন বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। আরো ৬১ হাজার টন এ মাসের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশে আসবে। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর বিভিন্ন দেশ থেকে এ পর্যন্ত ৪০ দিনে ৩৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সাধারণত উজবেকিস্তান থেকে কখনো পেঁয়াজ আমদানি করেনি। এবার ওই দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন নিয়েছেন একজন আমদানিকারক। কিছুদিনের মধ্যে ওই পেঁয়াজও দেশে আসবে।
পেঁয়াজের এ সংকটের কারণ জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা লতিফ বক্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণের। গতকাল মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বেশ কয়েকটি বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সচিব কথা বলতে বিব্রত বোধ করছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির তথ্য জানা গেছে। কালের কণ্ঠ’র যশোরের অভয়নগর প্রতিনিধি জানান, সেখানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। গেল মঙ্গলবার যা ছিল ১৪০ টাকা। বুধবার তা বেড়ে হয়েছে ১৮০ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার সেই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ২২০ টাকায়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুসেইন খান জানান, উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চরফ্যাশন (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, সেখানেও পেঁয়াজের কেজি এখন ২০০ থেকে ২২০ টাকা। চক রোডে জেরিন স্টোরে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে ২২০ টাকা কেজিতে। একই রোডে বনলতা স্টোরে বিক্রি করা হচ্ছে ২১০ টাকা কেজি। জ্যাকব এভিনিউতে বিক্রি করা হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে।
স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাঈনুল ইসলাম মনির বলেন, ‘চরফ্যাশনের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ আটকে রেখে জোর-জুলুমের ব্যবসা করেন না। বেশি দামে কেনা তাই দাম বেশি।’
ভূঁঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ভূঁঞাপুরে ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগে পাঁচ ব্যবসায়ীকে দুই হাজার করে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোছা. নাসরীন পারভীন গোবিন্দাসী বাজারে অভিযান চালিয়ে এই জরিমানা করেন।
ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলেও সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। অথচ উপজেলা বাজার মনিটরিং কমিটি কিংবা স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, নীলফামারীতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায়। এতে স্থানী ভোক্তা সাধারণের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। দাম বেশির কারণে প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনছেন ক্রেতারা।
নীলফামারীতে পাইকারি বাজারের দ্রব্য মূল্যের তালিকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা উল্লেখ থাকলেও দুপুর ১২টার দিকে ওই তালিকার সঙ্গে বাজার মূল্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মুদ্রাপাচার : বিআইডিএস-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক, ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, এক লাফে পেঁয়াজের দাম এত টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাজারে কথা প্রচলিত রয়েছে, একই ব্যক্তি আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে মুদ্রাপাচার হচ্ছে। সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক গোয়েন্দাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
পেঁয়াজের বাজারে এই অস্থিরতা শুধু বাণিজ্যিক কারণে নয়; এর পেছনে অন্য কোনো ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে। দেশি পেঁয়াজ বাজারে ওঠা শুরু হলে এবং ভারতের পেঁয়াজ আমদানি হলে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার আগে বাজারে নজরদারি বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।