ঢাকা ০৪:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাড়া বাসা থেকে সম্পদের পাহাড়ে বেআইনি কর্মের রেকর্ড

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৫:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৯
  • ২৩৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তখন থেকেই আইন বহির্ভূত কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি। ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের দোকানে চাঁদাবাজি করাই ছিলো তার কাজ। তিনি হচ্ছেন সেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের করপাড়া গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক মোক্তার মোল্লা ও নুরুন্নাহার দম্পতির ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে মোল্লা কাওছার সবার বড়। উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন রাজধানীতে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৭৯-৮০ সেশনে। সরাসরি যুক্ত ছিলেন জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে।
ভর্তির এক বছর পরে ৮১-৮২ সেশনে হল সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ৮৩-৮৪ সেশনে ছাত্রলীগের জহুরুল হক হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৮৯-৯০ সেশনে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে আসা তার। আর ছাত্র রাজনীতিতে আসার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বাড়তে থাকে। অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন সময়ে নীলক্ষেত মোড় থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত পুরোটা নিয়ন্ত্রণে ছিলো এই মোল্লা কাওছারের। সেই সময় ওই এলাকা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন তিনি এমন অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তখনই এলিফ্যান্ট রোডে এজাজ ক্লাব নামে একটি ক্লাবে তার আসা যাওয়া শুরু হয়। সেখানে তিনি নিয়মিত জুয়া খেলতেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাসিনো কর্মাকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এজাজ ক্লাব থেকে তিনি উৎসাহিত হন। তবে রাজনৈতিক ভাবে বেপরোয়া হলেও আর্থিকভাবে তখনো তিনি বেশি সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। জানা যায়, শুধু জুয়া খেলার কারণে এমন দশা হয়েছিলো তার।

এদিকে ঢাকার হাজারীবাগে একটি ছোট ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন তিনি। সংসারের টানাপোড়েন সামলাতে তার স্ত্রী টুকিটাকি বুটিক ব্যবসা করতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বদলাতে থাকে তার অবস্থা। দলের সূত্র থেকে জানা যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের একসময়ের সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন ২০০৯ সালে। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় আবু কাওছারের। তখন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ২০১২ সালের সম্মেলনে হন সভাপতি। এরপরই কাওছারের অবস্থা দ্রুতগতিতে পাল্টাতে থাকে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একাত্তর পরিবহন নামে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে ১০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে একাত্তর পরিবহন। হাজারীবাগে ছোট্ট বাসায় থাকা সেই নেতা, এখন ধানমন্ডিতে থাকেন আলিশান বাড়িতে, চড়েন দামি গাড়িতে। অভিযোগ রয়েছে বিদেশে করেছেন অঢেল সম্পত্তি, পাচার করেছেন টাকা।

সম্প্রতি এই নেতা আলোচনায় আসেন ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরামবাগের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তার আগে থেকেই এ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন মোল্লা কাওছার। এদিকে বনানীর আহমেদ টাওয়ারে অবস্থিত গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ নামের ক্যাসিনোতে তার মালিকানা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জিকে শামীমের সঙ্গেও মোল্লা কাওছারের ঘনিষ্ঠতার খবর পাওয়া যায়। একচেটিয়া গণপূর্ত বিভাগের কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে জিকে শামীমকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে মোল্লা কাওছারের বিরুদ্ধে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিকে শামীমকে টেন্ডার কিং বানানোর পেছনে পুরো ভূমিকা মোল্লা কাওছারের। জিকে শামীম যেখানেই যেতেন, সেখানে আগে ফোন দিতেন মোল্লা কাওছার। তার ফোনের পরই গিয়ে হাজির হতেন জিকে শামীম। এভাবেই জিকে শামীম বড় টেন্ডারবাজ হয়ে ওঠেন। এদিকে অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য গত ২রা অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় আদালতে নেয়া হলে মোল্লা কাওছারের খোঁজ করেন জিকে শামীম। তার আইনজীবীদের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘মোল্লা কাওছার কোথায়? সে আসে নাই?’ ওই সময় একজন উত্তর দেন, ‘উনি তো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কী করে আসবেন?

মোল্লা কাওছারের ভাগ্নে হাসান দাপট দেখান গণপূর্ত বিভাগে। গণপূর্ত ভবনে রয়েছে তার একক আধিপত্য। সেখানে রয়েছে তার ব্যক্তিগত অফিস। তার আরেক ভাগ্নে আলীম নিয়ন্ত্রণ করেন রাজউক ভবন। অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের পূর্বাচল প্রজেক্ট থেকে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক এই নেতা। রাজউক, গণপূর্ত, গৃহায়ন ও শিক্ষা ভবনে বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে তার। তার একটি নামমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও কখনও নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে, আবার কখনও অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি কাজ নিতেন। গ্রেপ্তার হওয়া জিকে শামীম, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও সম্রাট ছাড়াও দুই সিটির স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিয়ে সব কিছু করাতেন এই নেতা। কোনো কাজের প্রকল্প হাতে নেয়া হলেই তা তাকে ফোনে জানানো হতো। এমনকি কারা কারা টেন্ডার ড্রপ করছে তারও খবর পেতেন এই নেতা। সবকিছু করা হতো দপ্ততরগুলোর উচ্চ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। তবে এসব তথ্য দেয়ার জন্য ওই কর্মকর্তারা তার কাছে মোটা অংকের টাকাও পেতেন। এই নেতার রাজউক, গণপূর্ত, শিক্ষা ভবন ও গৃহায়নের টেন্ডারবাজির বিষয়টি ছিলো ওপেন-সিক্রেট।

মোল্লা কাওছার নিজেকে আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তিনি কোর্টে প্র্যাকটিস করেছেন এমনটা জানেন না কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্রদের নিয়ে গঠিত আইন সমিতিতে রয়েছে তার একক আধিপত্য। পুরো আইন সমিতি তার নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান নেতৃত্বে যারা আছেন তারা তার কথা শুনতে অনেকটাই বাধ্য। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ সভাপতি হলেও সংগঠনটিতে সবই চলতো তার নেতৃত্বে। নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে অফিস করতেন। একই সঙ্গে তিনি গোপালগঞ্জ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সমিতির নাম ভাঙিয়ে তিনি চাঁদাবাজি করতেন। সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে পিকনিক বা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা বলে মোটা অংকের চাঁদা নেন তিনি। যদিও এই চাঁদার টাকা যায় তার পকেটে। গোপালগঞ্জ সমিতির এক সদস্য সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই সমিতি থেকে যত টাকাই আসুক তিনি অন্যভাবে তার স্পন্সর ম্যানেজ করে এসব করতেন। আর সদস্যদের ওঠানো টাকা তিনি নিজের মনে করতেন। এই সংগঠনটির সদস্যরা মোটা অংকের চাঁদা দেন বলে জানা যায়।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। সাত বছর ধরে তিনি সভাপতি পদটি আকড়ে রাখেন। সভাপতি হওয়ার পর জেলা, উপজেলা পদগুলোতে তিনি করতেন পদ বাণিজ্য। জেলা পর্যায়ে সভাপতি ও সেক্রেটারি পদগুলোতে তিনি নিতেন বিশ থেকে ত্রিশ লাখ টাকা। আবার যে জেলাগুলো অপরাধপ্রবণ বা অর্থনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত সেসব জেলাতে টাকার পরিমাণ বেশি লাগতো কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য। স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার প্রভাব থাকলেও এখানে তিনি কিছুটা স্বচ্ছতার সাথে কাজ করেছেন। তবে জেলা উপজেলা পর্যায়ে তিনি প্রচুর টাকা পদ বাণিজ্য করেছেন। তবে তার বিদেশ কমিটিতে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ।

অভিযোগ রয়েছে, মাসে দুই থেকে তিনবার যেতেন দেশের বাইরে । বিদেশ ভ্রমণ ছিলো তার শখ। তার মেয়ে সানফ্রানসিসকো থাকার সুবাদে বিদেশ আসা যাওয়া শুরু হয়। এর পর থেকে বিশ্বের শতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। আর এসব তিনি করেন বিদেশ কমিটির নেতাদের অর্থায়নে। যেসব দেশে প্রবাসী বেশি, সেখানেই শাখা খুলেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইতালিসহ ১৫টি দেশে শাখা আছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের। আর এসব দেশের নেতাদের কাছ থেকে তিনি বাড়তি সুবিধা নিতেন। এই দেশগুলোর বাইরে প্রবাসী নেতাদের কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের টাকা নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। অথচ দলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২৫ বছরে সম্মেলন হয়েছে দু’বার।

এরপর আহ্বায়ক কমিটি পার করে দেয় ৯ বছর। পরে তাকে দেয়া হয় সভাপতির দায়িত্ব। এদিকে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী থেকে বাদ পড়েন তিনি। নানা সূত্রে জানা যায়, নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন। তখন তাকে বলা হয়, এখানে নয় তাকে দেশে চলে যেতে বলেন। এরপর তিনি কানাডায় না গিয়ে দেশে চলে আসেন। এই বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য মোল্লা কাওছারকে বার বার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ না করে কেটে দেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ভাড়া বাসা থেকে সম্পদের পাহাড়ে বেআইনি কর্মের রেকর্ড

আপডেট টাইম : ১১:২৫:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তখন থেকেই আইন বহির্ভূত কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি। ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের দোকানে চাঁদাবাজি করাই ছিলো তার কাজ। তিনি হচ্ছেন সেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের করপাড়া গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক মোক্তার মোল্লা ও নুরুন্নাহার দম্পতির ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে মোল্লা কাওছার সবার বড়। উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন রাজধানীতে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৭৯-৮০ সেশনে। সরাসরি যুক্ত ছিলেন জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে।
ভর্তির এক বছর পরে ৮১-৮২ সেশনে হল সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ৮৩-৮৪ সেশনে ছাত্রলীগের জহুরুল হক হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৮৯-৯০ সেশনে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে আসা তার। আর ছাত্র রাজনীতিতে আসার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বাড়তে থাকে। অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন সময়ে নীলক্ষেত মোড় থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত পুরোটা নিয়ন্ত্রণে ছিলো এই মোল্লা কাওছারের। সেই সময় ওই এলাকা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন তিনি এমন অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তখনই এলিফ্যান্ট রোডে এজাজ ক্লাব নামে একটি ক্লাবে তার আসা যাওয়া শুরু হয়। সেখানে তিনি নিয়মিত জুয়া খেলতেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাসিনো কর্মাকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এজাজ ক্লাব থেকে তিনি উৎসাহিত হন। তবে রাজনৈতিক ভাবে বেপরোয়া হলেও আর্থিকভাবে তখনো তিনি বেশি সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। জানা যায়, শুধু জুয়া খেলার কারণে এমন দশা হয়েছিলো তার।

এদিকে ঢাকার হাজারীবাগে একটি ছোট ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন তিনি। সংসারের টানাপোড়েন সামলাতে তার স্ত্রী টুকিটাকি বুটিক ব্যবসা করতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বদলাতে থাকে তার অবস্থা। দলের সূত্র থেকে জানা যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের একসময়ের সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন ২০০৯ সালে। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় আবু কাওছারের। তখন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ২০১২ সালের সম্মেলনে হন সভাপতি। এরপরই কাওছারের অবস্থা দ্রুতগতিতে পাল্টাতে থাকে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একাত্তর পরিবহন নামে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে ১০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে একাত্তর পরিবহন। হাজারীবাগে ছোট্ট বাসায় থাকা সেই নেতা, এখন ধানমন্ডিতে থাকেন আলিশান বাড়িতে, চড়েন দামি গাড়িতে। অভিযোগ রয়েছে বিদেশে করেছেন অঢেল সম্পত্তি, পাচার করেছেন টাকা।

সম্প্রতি এই নেতা আলোচনায় আসেন ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরামবাগের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তার আগে থেকেই এ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন মোল্লা কাওছার। এদিকে বনানীর আহমেদ টাওয়ারে অবস্থিত গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ নামের ক্যাসিনোতে তার মালিকানা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জিকে শামীমের সঙ্গেও মোল্লা কাওছারের ঘনিষ্ঠতার খবর পাওয়া যায়। একচেটিয়া গণপূর্ত বিভাগের কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে জিকে শামীমকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে মোল্লা কাওছারের বিরুদ্ধে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিকে শামীমকে টেন্ডার কিং বানানোর পেছনে পুরো ভূমিকা মোল্লা কাওছারের। জিকে শামীম যেখানেই যেতেন, সেখানে আগে ফোন দিতেন মোল্লা কাওছার। তার ফোনের পরই গিয়ে হাজির হতেন জিকে শামীম। এভাবেই জিকে শামীম বড় টেন্ডারবাজ হয়ে ওঠেন। এদিকে অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য গত ২রা অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় আদালতে নেয়া হলে মোল্লা কাওছারের খোঁজ করেন জিকে শামীম। তার আইনজীবীদের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘মোল্লা কাওছার কোথায়? সে আসে নাই?’ ওই সময় একজন উত্তর দেন, ‘উনি তো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কী করে আসবেন?

মোল্লা কাওছারের ভাগ্নে হাসান দাপট দেখান গণপূর্ত বিভাগে। গণপূর্ত ভবনে রয়েছে তার একক আধিপত্য। সেখানে রয়েছে তার ব্যক্তিগত অফিস। তার আরেক ভাগ্নে আলীম নিয়ন্ত্রণ করেন রাজউক ভবন। অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের পূর্বাচল প্রজেক্ট থেকে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক এই নেতা। রাজউক, গণপূর্ত, গৃহায়ন ও শিক্ষা ভবনে বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে তার। তার একটি নামমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও কখনও নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে, আবার কখনও অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি কাজ নিতেন। গ্রেপ্তার হওয়া জিকে শামীম, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও সম্রাট ছাড়াও দুই সিটির স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিয়ে সব কিছু করাতেন এই নেতা। কোনো কাজের প্রকল্প হাতে নেয়া হলেই তা তাকে ফোনে জানানো হতো। এমনকি কারা কারা টেন্ডার ড্রপ করছে তারও খবর পেতেন এই নেতা। সবকিছু করা হতো দপ্ততরগুলোর উচ্চ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। তবে এসব তথ্য দেয়ার জন্য ওই কর্মকর্তারা তার কাছে মোটা অংকের টাকাও পেতেন। এই নেতার রাজউক, গণপূর্ত, শিক্ষা ভবন ও গৃহায়নের টেন্ডারবাজির বিষয়টি ছিলো ওপেন-সিক্রেট।

মোল্লা কাওছার নিজেকে আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তিনি কোর্টে প্র্যাকটিস করেছেন এমনটা জানেন না কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্রদের নিয়ে গঠিত আইন সমিতিতে রয়েছে তার একক আধিপত্য। পুরো আইন সমিতি তার নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান নেতৃত্বে যারা আছেন তারা তার কথা শুনতে অনেকটাই বাধ্য। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ সভাপতি হলেও সংগঠনটিতে সবই চলতো তার নেতৃত্বে। নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে অফিস করতেন। একই সঙ্গে তিনি গোপালগঞ্জ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সমিতির নাম ভাঙিয়ে তিনি চাঁদাবাজি করতেন। সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে পিকনিক বা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা বলে মোটা অংকের চাঁদা নেন তিনি। যদিও এই চাঁদার টাকা যায় তার পকেটে। গোপালগঞ্জ সমিতির এক সদস্য সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই সমিতি থেকে যত টাকাই আসুক তিনি অন্যভাবে তার স্পন্সর ম্যানেজ করে এসব করতেন। আর সদস্যদের ওঠানো টাকা তিনি নিজের মনে করতেন। এই সংগঠনটির সদস্যরা মোটা অংকের চাঁদা দেন বলে জানা যায়।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। সাত বছর ধরে তিনি সভাপতি পদটি আকড়ে রাখেন। সভাপতি হওয়ার পর জেলা, উপজেলা পদগুলোতে তিনি করতেন পদ বাণিজ্য। জেলা পর্যায়ে সভাপতি ও সেক্রেটারি পদগুলোতে তিনি নিতেন বিশ থেকে ত্রিশ লাখ টাকা। আবার যে জেলাগুলো অপরাধপ্রবণ বা অর্থনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত সেসব জেলাতে টাকার পরিমাণ বেশি লাগতো কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য। স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার প্রভাব থাকলেও এখানে তিনি কিছুটা স্বচ্ছতার সাথে কাজ করেছেন। তবে জেলা উপজেলা পর্যায়ে তিনি প্রচুর টাকা পদ বাণিজ্য করেছেন। তবে তার বিদেশ কমিটিতে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ।

অভিযোগ রয়েছে, মাসে দুই থেকে তিনবার যেতেন দেশের বাইরে । বিদেশ ভ্রমণ ছিলো তার শখ। তার মেয়ে সানফ্রানসিসকো থাকার সুবাদে বিদেশ আসা যাওয়া শুরু হয়। এর পর থেকে বিশ্বের শতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। আর এসব তিনি করেন বিদেশ কমিটির নেতাদের অর্থায়নে। যেসব দেশে প্রবাসী বেশি, সেখানেই শাখা খুলেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইতালিসহ ১৫টি দেশে শাখা আছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের। আর এসব দেশের নেতাদের কাছ থেকে তিনি বাড়তি সুবিধা নিতেন। এই দেশগুলোর বাইরে প্রবাসী নেতাদের কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের টাকা নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। অথচ দলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২৫ বছরে সম্মেলন হয়েছে দু’বার।

এরপর আহ্বায়ক কমিটি পার করে দেয় ৯ বছর। পরে তাকে দেয়া হয় সভাপতির দায়িত্ব। এদিকে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী থেকে বাদ পড়েন তিনি। নানা সূত্রে জানা যায়, নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন। তখন তাকে বলা হয়, এখানে নয় তাকে দেশে চলে যেতে বলেন। এরপর তিনি কানাডায় না গিয়ে দেশে চলে আসেন। এই বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য মোল্লা কাওছারকে বার বার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ না করে কেটে দেন।