কারো মুখে ‘রা’নেই, মাঠে কেবলই আওয়ামী লীগ । প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলভিত্তিক পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। মন্ত্রিপরিষদে এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনীর খসড়া অনুমোদন পাওয়ার পর দলগুলোতে তোড়জোড় শুরু হলেও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির পর চুপসে গেছে সবাই। প্রথমবারের মতো সংসদের বাইরে থাকা অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির পক্ষ থেকে বিনা চ্যালেঞ্জে ক্ষমতাসীন দলকে ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। তৃণমূলে বিরোধী শিবিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হলেও তফসিল ঘোষণার আগেই বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতারের ঘটনায় এখন তারা মাঠছাড়া। জামায়াত তো এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতাই হারিয়েছে। সরকারের সঙ্গী হয়ে প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টিরও তৎপরতা শুরু হয়নি এখনো। আর ছোট ছোট বেশ কয়েকটি দল প্রথমদিকে জোরে আওয়াজ দিলেও ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এসেছে তাদের স্বর। সব মিলিয়ে ভোটের মাঠে এখন কেবলই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। পুরনো ইতিহাস মাড়িয়ে নতুন ইতিহাস গড়ার এ পৌর নির্বাচন দিয়ে গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে নিজেদের হারানো ইমেজ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করায় প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পথচলা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কমিশন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এটিও একতরফা হবে এমন আশঙ্কা ভর করেছে ইসি সংশ্লিষ্টদের মনে। শেষ পর্যন্ত যদি তাই হয়, তবে ইতিহাস গড়ার এ নির্বাচনের মাধ্যমে ইসির কপালে আরো একটি কলঙ্ক তিলক পড়তে যাচ্ছে এমন শঙ্কাই করছেন তারা। নির্বাচন উপযোগী ২৪৫টি পৌরসভার বেশ কয়েকটিতে খবর নিয়ে দেখা যায়, এসব এলাকায় পৌরসভা নির্বাচনের হাওয়া বেশ জোরালোভাবেই বইছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা পুরোদমে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এসব প্রচার-প্রচারণার সবই প্রায় হাট-বাজার বা বন্দরকেন্দ্রিক। বিশেষ করে চায়ের স্টলগুলোতে চলছে নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা, ভোটের হিসাব-নিকাশ। অবশ্য কিছু কিছু প্রার্থী সীমিত পর্যায়ে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জনসংযোগও করছেন। স্থানীয় নেতাকর্মী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ জানান, এসব পৌরসভায় মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গড়ে কমপক্ষে পাঁচজন করে প্রার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ এগিয়ে আছেন জনপ্রিয়তায় কেউ বা আবার শীর্ষনেতাদের আশীর্বাদের জোরে। এছাড়া দল নিরপেক্ষ প্রার্থীরাও মাঠে আছেন। স্থানীয় সরকার পৌরসভা আইনের সংশোধনী অনুযায়ী, দলকে প্রথমে একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দিতে হবে। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম জমা দিতে হবে। বাকি প্রার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন বলে গণ্য হবে। তাই প্রার্থী বেশি থাকলেও আপাত দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই দলের। তবে কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী দলত্যাগ করলে বা স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করলে বিপদ হবে সংশ্লিষ্ট দল সমর্থিত প্রার্থীর। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে কেবল আওয়ামী লীগের প্রার্থীই সীমিত আকারে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিএনপি কিংবা অন্য দলের প্রার্থীরা মাঠে নেই। কোথাও কোথাও দলটির বেশ কয়েক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও তারা মাঠে নেই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মামলা বা গ্রেফতার ভীতির কারণেই বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে থাকতে পারছেন না। প্রথমদিকে বিরোধী জোটের অনেক প্রার্থীর দেখা মিললেও সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা গ্রেফতার হওয়ার তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়টি বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগও তোলেন। তিনি বলেন, বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে সরকার ‘একদলীয়ভাবে’ স্থানীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে। সরকার যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো গায়ের জোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জিততে চায়, তাহলে নির্বাচনের নামে প্রহসনের কী দরকার। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে বিভিন্ন স্থানে বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা ঘরেই থাকতে পারছেন না। এটা কী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ হতে পারে? এদিকে ভোটের মাঠে পরস্পরবিরোধী দুই জোটের অন্য শরিক দলগুলোও প্রার্থিতা নিয়ে কোনো আওয়াজ দিচ্ছে না। জাতীয় পার্টি মাঝেমধ্যে তাদের অবস্থান জানান দিলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ অন্য শরিকরা একেবারেই মাঠে নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকদের অবস্থান একই। বিকল্প ধারা, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জেএসডিসহ অন্যদের মুখে শব্দ করা দূরে থাক, টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আসন্ন পৌর নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমনি উৎসাহ কমে গেছে তেমনি নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের মনেও ভর করেছে শঙ্কা। তাদের মতে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা চালায় তাহলে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতিই শুধু বিনষ্ট হবে না ইসিও সমালোচিত হবে সমানভাবে। তাই তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি বলে মত দেন তারা। এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন ইতিবাচক ফল বয়ে নাও আনতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে হিংসা, দলাদলি, মারামারি বেড়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে এটি সামাল দেয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ইসির উচিত এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ইসির শঙ্কার বিষয়টি খোলামেলা বললেও তফসিল ঘোষণার আগে এ নিয়ে বৈঠক করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ডিসেম্বরের শেষে নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে। বিধি ভেটিং হয়ে আসলেই তফসিল ঘোষণার জন্য আলোচনায় বসবে কমিশন। এক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে যা যা ব্যবস্থা নেয়ার দরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে সব ব্যবস্থাই করা হবে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তফসিল ঘোষণার আগেই তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসা হবে বলে জানান তিনি। আগামী মাসের (ডিসেম্বর) শেষে দেশের ২৪৫টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে সংশোধিত আইনের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী বিধিমালা ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালাও সংশোধন করছে ইসি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিগগিরই এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।
সংবাদ শিরোনাম