বৃষ্টিস্নাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে চায়ের কাপে উঠেছে স্বভাবসিদ্ধ আলোচনার তুফান। হঠাৎ করেই সেই আলোচনায় ঢুকে পড়ল থানকুয়াইন ঝরনা দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব। সুতরাং আর দেরি কিসের? সেখান থেকেই ছুটলাম কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে।রাত দশটায় চট্টগ্রাম মেইল আছে। যদি ট্রেনটা ধরা যায় আরকি! এ যাত্রায় আমাদের হুজুগে সহযাত্রী হলো ভাট্টি ও পিয়াল। স্টেশনে এসে ট্রেন পেলাম। কিন্তু আসন পেলাম না। সেই দুঃখ চলে গেল একদল গায়ক দেখে। তারাও চট্টগ্রাম যাবে। তাদের গান শুনে গল্প-হাসিতে কেটে গেল নির্ঘুম রাত।
চট্টগ্রাম থেকে বাস ধরতে হবে। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম রাস্তার উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম এদিকে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। যাই হোক, আমরা চকোরিয়া বাসস্ট্যান্ডে নামলাম। লোকাল বাসগুলো থেকে হাঁক শোনা যাচ্ছে- আলীহোদোম, আলীহোদোম (আলীকদম); হোকসোবাজার, হোকসোবাজার (কক্সবাজার)! সংক্ষিপ্ত নাস্তা সেরে উঠে পড়লাম আলীকদমের বাসে। বাস প্রবেশ করল পাহাড়ি এলাকায়। মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিকটে, সাথে টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টি ভেজা গাছগুলোর সবুজ ডালপালার আহ্লাদি নৃত্য দেখতে ভালোই লাগল। বৃষ্টির পানিতে পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। আশপাশের ঘর বাড়ির জানালা দিয়ে লোকজন দেখছে উঁচু-নিচু ভেজা রাস্তায় ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ বোঝাই বাস। সামান্য এদিক সেদিক হলেই টুপ করে পড়ে যাবে পাহাড়ের খাদে। আমরা নিরাপদেই আলীকদম চলে এলাম। এবার বাহন হলো ইজিবাইক। গন্তব্য পানবাজার। সেখান থেকে ৪০ মিনিটের পথ- মাতামূহুরি নদীর ঘাট। ঝুম বর্ষণ শুরু হয়েছে। ফলে ঘাটের একমাত্র দোকানে আশ্রয় নিতে হলো। প্রায় দুই ঘণ্টা টানা বর্ষণে নদীর পানি ফুলে উঠল। পাহাড়ি নদীর এই এক রূপ। বানের পানির মতো নেমে আসে ঢল। অথচ স্থানীয়দের মুখে শুনলাম দুদিন আগেও নাকি নৌকা ছাড়াই নদীর ওপাড়ে যাওয়া যেত।
ভাবলাম, পানি নেমে যাক পরদিন ট্রেকিং শুরু করব। আপাতত রাতে থাকার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। পাহাড়ের উপর চার্চে গিয়ে কাউকে পেলাম না। বৃষ্টির কারণে লোকজনও আশপাশে নেই। পাড়ার মানুষ ঘরে ঢুকে গেছে আগেভাগেই। থাকার কোন জায়গাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে ফিরতি পথ ধরতে হলো। ফিরতি বাস একটা পেয়ে উঠে বসলাম। পথের দুপাশে পাহাড়ের শরীর বেয়ে গড়িয়ে পরছে মৌসুমী ঝরনা। হঠাৎ বাস থামতেই হেলপার চিৎকার করে উঠল। অর্থাৎ সবাইকে নামতে হবে। সামনে লোহার সেতু। অল্পক্ষণ আগেও পানি সেতুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সতরাং যাত্রীসহ সেতু পার হওয়া বিপজ্জনক। আমরা নেমে হেঁটে সেতু পার হলাম। তারপর পুনরায় বাসে উঠলাম। বাস চলতে লাগল আপন মনে। এদিকে আমরা তখনও জানি না, কোথায় যাচ্ছি? চকোরিয়া এসে উঠে পড়লাম কক্সবাজারের বাসে। ভাগ্যিস তখনও বেলা ছিল এবং সূর্য ডোবার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে চলছি। সৈকতের পাশ ধরে রাস্তা। সূর্য দ্রুত ডুবে যাচ্ছে কিন্তু আকাশে মেঘ ভাসছে ফলে দেখার সুযোগ হলো না। ইজিবাইক আমাদের তিনজনকে নিয়ে জায়গায় জায়গায় থামছে। আমরা পরখ করে দেখছি তাবু খাটানোর মতো জায়গা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু তেমন জায়গা পেলাম না। ফলে ফিরতে হলো সেই ইজিবাইকেই। তারপর বাইকে ছেড়ে সৈকত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। সকল দ্বিধা ঝেড়ে তাবু খাটালাম লাবনি পয়েন্টে। তাবু খাটানো শেষ, এবার ভেতরে প্রবেশ করে ঘুমিয়ে পড়া। হঠাৎ দেখি সমুদ্রের পেট থেকে কালো কালো মেঘ উঠে এসে ক্রমেই ঢেকে ফেললো পশ্চিম আকাশ। বাতাসের গতিও ক্রমবর্ধমান, তাবু আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে তাবু উঠিয়ে নিতে হলো। এবার তাবু খাটালাম হোটেল সী-গালের সম্মুখে ঝাউ বনের অড়ালে।
অপরিকল্পিত হলেও এটা ছিল আমার প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণ। সুতরাং পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না থাকারই কথা। সকালে ঘুম থেকে জেগে তাবুর বাইরে সবেমাত্র বেরিয়েছি, অমনি স্থানীয় কয়েকটি শিশু হাততালি সহযোগে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, এ…এ…এ…! চোখ কচলে দেখি তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রহরীও রয়েছে। তাদের চোখেমুখে কৌতূহল। বুঝলাম সেখানে তাবু গেড়ে থাকার প্রচলন নেই। রাতে বাতাসের সঙ্গে খানিক বৃষ্টিও হয়েছে। আকাশে ধূসর মেঘ তখনও ভাসছে। সেই মেঘের দিকে তাকিয়ে ঘুঁচে গেল থানকুয়াইন দেখতে না পাওয়ার ব্যর্থতার গ্লানি।
কিন্তু মন অনেক চেষ্টা করেও ভালো রাখা গেল না। কক্সবাজারে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেল। পরিবেশের তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে তথাকথিত তিন থেকে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট হোটেল! তারা অতিথিদের কতটা সমুদ্রের গর্জনের কাছাকাছি নিয়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে বলে মনে হলো। যে কারণে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এমন অব্যবস্থাপনা নজিরবিহীন। এখানে সমুদ্র স্নানের নেই কোন নিয়ন্ত্রণ, নেই কোন গাইডলাইন। মানা হচ্ছে না জোয়ার, ভাটা। যে যেখানে পারছে লাফাচ্ছে, ঝাপাচ্ছে! ফেলছে ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ ইত্যাদি। শীত মৌসুমে নাকি কক্সবাজার সৈকতের সঙ্গে রাজধানীর গুলিস্তানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়- এত ভিড়! যাই হোক, সৈকতের সব থেকে বড় আকর্ষণ সূর্যাস্ত ও উদয়, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে কোনটিই উপভোগ করতে পারলাম না।
সমুদ্র দেখার সাধ মেটার পর চললাম আরেক গন্তব্যে। অটোরিকশা চালকের নিকট শুনেছিলাম, রামু উপজেলাধীন উত্তর মিঠাছরি বৌদ্ধ মন্দিরে নাকি ১০০ ফুট দীর্ঘ বুদ্ধের শায়িত মূর্তি রয়েছে। অটোরিকশা থেকে নেমে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই মন্দিরের প্রধান ফটকে। টিলার মাথা ভেঙে সমতল করা বেশ বড় জায়গা। ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি তবে মূর্তি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। বেছে বেছে দক্ষ ভাস্কর্যশিল্পী আনা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে। একজন ভিক্ষু ঘুরে দেখালেন এবং বুঝিয়ে দিলেন মূল নকশার বিস্তারিত। তার মুখেই জানলাম ইতিমধ্যেই মূর্তি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা।
কোন নতুন জায়গা ভ্রমণের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত হলো, সম্ভাব্য সকল মাধ্যম থেকে সেই জায়গার খোঁজখবর নেয়া এবং পড়াশোনা করা। এতে ভ্রমণ আনন্দপূর্ণ এবং স্বার্থক হয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এবারের ভ্রমণের পূর্বে সঙ্গত কারণেই আমাদের পক্ষে খোঁজখবর নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে চলার পথে স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্যই আমাদের পাথেয়। সেদিন রাত্রিযাপনের কোনরকম একটি ব্যবস্থা রামুতেই হলো। পরের দিন হানা দেয়ার জন্য নতুন একটি জায়গার খোঁজ পেলাম। নাইক্ষংছড়ির ঝুলন্ত সেতু। জানলাম, রামু থেকে অটোরিক্সায় মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ।
আগে জানতাম রাঙামাটি লেকের উপর নির্মিত সেতুটিই দেশের একমাত্র ঝুলন্ত সেতু। নাইক্ষংছড়ি গিয়ে এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হলো। এক পুলিশ সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতায় অটোরিকশা নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের গোড়ায়। সবুজে ঢাকা শ্যাওলা পড়া ইট বিছানো পিচ্ছিল পথে পাহাড়ে উঠতে একটু বেগ পেতে হলো। একটি কংক্রিটের ছাউনি, তার নিচে বসার সামান্য ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু জায়গাটি ভীষণ অপরিস্কার। যদিও আশপাশটা সাজিয়ে গুছিয়েএকটি পার্কে রূপ দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। জনমানবহীন সেই পার্কের পরেই লেক। বর্ষার মৌসুম হওয়ায় আমরা স্বচ্ছ পানি পেলাম না। অন্য সময় পানি ভীষণ পরিস্কার থাকে। লেকের অপেক্ষাকৃত চওড়া জায়গার উপর দেখলাম সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। লেকের পানি সেতুর পাটাতনের কাছাকাছি চলে এসেছে। সেতুর মাঝখানে বসে পা-দুটো ঝুলিয়ে দিলেই পানির শান্ত শীতল স্পর্শ পাওয়া যায়।
ঢকা থেকে সহজেই চমৎকার এই লেকটি পরিদর্শন করে আসা সম্ভব। বিষয়টি আমার অজানা ছিল। আমার বিশ্বাস অনেক পর্যটকও লেকটির কথা জানেন না। হয়তো অজানা থেকে যাবে বছরের পর বছর। পর্যটন মন্ত্রণালয় রয়েছে, রয়েছে পর্যটন বোর্ড, পর্যটন কর্পোরেশন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে লেকটি নিয়ে কোন প্রচার চোখে পড়েনি। অথচ দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে নাইক্ষংছড়ি লেক হতে পারে সম্ভাবনাময় জায়গা। দেশে শত শত ট্যুর অপারেটর রয়েছে, তারাও এর কতটুকু খবর রাখে এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।