কাউন্সিলর। এই পরিচয়ে জনবান্ধব হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই ভয়ঙ্কর। রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। রাস্তায় বের হলেই তাদের সামনে পেছনে থাকে বিশাল বহর। কাউকে তোয়াক্কা করেন না। এক একটি ওয়ার্ডে তারা এক-একজন যেনো রাজা-মহারাজা। জবর-দখল, ফুটপাত, অবৈধ হাট, এমনকি ক্যাসিনো ব্যবসায় সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের।
অল্পদিনেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। রাজধানীর বুকে একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক। দেশে-বিদেশে জমিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই সন্ত্রাস, মাদক ও জবর-দখলের রাজ্য গড়ে তোললেও তারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। সম্প্রতি ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের নাম এখন আলোচনায়। জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। অন্তত এক ডজন কাউন্সিলর গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকা ছাড়া। আবার কেউ এলাকায় থাকলেও প্রকাশ্যে আসছেন না। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের শুরুতেই আলোচনায় আসেন দক্ষিণ সিটির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক এই কাউন্সিলরকে দেখে বুঝার উপায় নেই তিনি কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন। মুখ ভরা দাড়ি। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়তেন তিনি। এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে থানা পুলিশ থেকে সরকারি কর্মকর্তারা সবাই তাকে সমীহ করতেন। এই পরিচয়কে ব্যবহার করতেন ভিন্নভাবে। তার রয়েছে শতাধিক ক্যাডার। মতিঝিল, আরমবাগ, কমলাপুর এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে গেলেই তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের চাঁদা।
কাউন্সিলর সাঈদকে চাঁদা না দিয়ে ভবন নির্মাণ করা দুষ্কর ওই এলাকায়। আরামবাগে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউজ নির্মাণ করতে গেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চাঁদা দাবি করেন সাঈদ। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় কাজ বন্ধ করে দেয় সাঈদের সন্ত্রাসীরা। প্রায় এক বছর কাজ বন্ধ ছিলো। সম্প্রতি ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে আত্মগোপনে যায় সাঈদ। আরামবাগের ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণ শ্রমিকরা কাজে ব্যস্ত। কথা হয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্য ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করে তারা জানান, ঠিকাদারের কাছে চাঁদা চেয়েছিলো সন্ত্রাসীরা। এটা নিয়ে সমস্যা ছিলো। এখন কোনো সমস্যা নেই। ওই এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে গেলেই সাঈদকে দিতে হতো চাঁদা অথবা ফ্ল্যাট। মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে তার লোকজন। টাকা না দিলে তোলে দেয়া হয় দোকান। আবার ফুটপাত উচ্ছেদ করতে গেলেও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের রুখে দিতেন তিনি। ঢাকার অপরাধ জগতের বাদশা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন সাঈদ। সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসা দেখভাল করতেন সাঈদ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সাঈদের টাকা রয়েছে বিদেশের ব্যাংকেও। অস্ট্রেলিয়ার একটি ব্যাংকে টাকা রাখেন তিনি। সিঙ্গাপুরেও তার সম্পত্তি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুটি দেশে বেশি যাতায়াত তার। বর্তমানেও সিঙ্গাপুরে রয়েছে সাঈদ। অল্প দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া সাঈদ তার নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে ২০০২ সালে ঢাকায় আসেন। মতিঝিলের দিলকুশার ফুটপাতে দোকান দেন। ২০০৯ সাল থেকে থেকে সক্রিয় হন যুবলীগের রাজনীতিতে।
তারপর রাতারাতি অপরাধ সাম্রাজ্যে পা দিয়ে উত্থান ঘটেছে তার। ওই এলাকার আরেক ভয়ঙ্কর কাউন্সিলর মোস্তফা জামান পপি। তিনি ঢাকা দক্ষিণের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভূক্ত। পল্টন এলাকায় তার নাম শুনলেই ভয় পায় সাধারণ মানুষ। ফুটপাত, মাদক, জবর-দখল, ক্যাসিনো সবকিছুতেই রয়েছে তার প্রভাব। কাউন্সিলর সাঈদের সঙ্গেও ছিল তার সখ্যতা। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে পপি এখন এলাকাছাড়া। মোহাম্মদপুর, আদাবর, মিরপুর এলাকায় মাদক ব্যবসার মূল হোতা ইসতিয়াক। নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা পরিচালনার রহস্যের নাম হাবিবুর রহমান মিজান। তিনি ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। নিয়মিত মাসোহারা নিতেন ইসতিয়াকের কাছ থেকে। বিনিময়ে ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা করার অবাধ সুযোগ তৈরি করে দিতেন মিজান। আছে জবর-দখল, ক্যাসিনো বাণিজ্যের অভিযোগ। ১৯৮৯ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। তারপর যুবলীগের রাজনীতিতে মিশে একসময় জনপ্রতিনিধি হয়ে যান তিনি। কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক এখন এই মিজান। বিদেশে রয়েছে বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স। তাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। মোহাম্মদপুর এলাকায় পাগলা মিজান হিসেবে পরিচিত এ কাউন্সিলর এতোদিন কাউকে পরোয়া করতেন না। এলাকায় তার ভয়ে দলীয় নেতাকর্মীরাও তটস্থ থাকতেন। কাউন্সিলর শব্দে ঢাকা পড়েছে অনেকের ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম। তেমনি একজন কাউন্সিলর রয়েছে ঢাকা দক্ষিণে সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুর এলাকার।
স্বাধীনতার পর জনতা ব্যাংক ডাকাতি করার অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। ধানমন্ডি এলাকায় যারা প্রথম ক্যাসিনো বাণিজ্যের শুরু করেন এই কাউন্সিলর তাদের একজন। এলাকায় নানা অপকর্মের হোতা এই কাউন্সিলরের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই কাউন্সিলর চলাফেরা করেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে। পাশ্ববর্তী এলাকার আরেক কাউন্সিলর রয়েছেন যিনি ক্যাসিনো থেকে শুরু করে জবর দখলের হোতা। অবৈধভাবে কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়েছেন গত ১০ বছরে। তিনি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী পরিবারের নেতার ঘনিষ্ঠজন। ঘনিষ্ঠত রয়েছে সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে। পাপের খতিয়ান দীর্ঘ হলেও তা প্রকাশ করতে ভয় পান এলাকার লোকজন।
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রভাবশালী কয়েক কাউন্সিলরের মধ্যে একজন হাজি রজ্জব। ছয় নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর পল্লবী, রূপনগর ও মিরপুর থানা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত। এলাকায় সরকারি জমি দখল করে বস্তি পরিচালনা করে তিনি কয়েক বছরে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে আরও নানা অপকর্মের অভিযোগ। সম্প্রতি চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগার পর তার নামটি সামনে আসে। রূপনগর ও আশপাশ এলাকার পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা ও মাদক কারবারিদের সহায়তারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরিবহন শ্রমিক থেকে মাত্র ১৫ বছরে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন রজ্জব। সম্প্রতি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এলাকায় খুব একটা দেখা যাচ্ছে না তাকে। ঢাকা মহানগর উত্তরের আরেক সুলতান তারেকুজ্জুমান রাজীব। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলরের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ভূমি দখলের মাধ্যমে। মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং এলাকায় ওয়াসার পানির পাম্পের জায়গা দখল করেন তিনি। ২০১৩ সালে জায়গা দখল নিতে যায় যুবলীগ নামধারী আরেক সন্ত্রাসী, দখলবাজ মনিরুজ্জামান। গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে সেদিন। ওই জায়গায় এখন কাউন্সিলর রাজীবের ডুপ্লেক্স বাড়ি।
আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার স্নেহভাজন রাজীব নিয়ন্ত্রণ করেন এলাকার মাদক বাণিজ্যও। কাউন্সিলর শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়েছে তার সব অপকর্ম। যদিও রাজীবের দাবি তিনি ব্যবসা করে সম্পদ গড়েছেন। ঢাকার দুই সিটির এমন ভয়ঙ্কর কাউন্সিলরদের একটি তালিকা ধরে অনুসন্ধান করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এ তালিকায় ১২ জনের নাম রয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দ সংস্থার তথ্যে এসব কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় নাম আছে দক্ষিণ সিটির অন্তত ৯ জনের। প্রাথমিক তালিকায় উত্তর সিটির তিন জন কাউন্সিলরের সম্পদ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে আইন শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের কয়েক জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ জমা পড়েছে।