দুঃখ-দুর্দশা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার উপায়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  যখন তোমার মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভর করবে এবং তোমার হৃদয়কে তা আক্রান্ত করবে তখনই তুমি তোমার রবের সামনে নিবেদিত হও। তাঁর কাছে অভাব প্রকাশ কর। তোমার স্রষ্টার জন্য বিনম্র হও। মিনতি ও প্রার্থনা করে তাঁর আশ্রয় নাও। আল্লাহ বলেন, “এবং স্মরণ কর আইউবের কথা, যখন তিনি নিজের প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেন, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম, তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের মতো আরও দিলাম, আমার বিশেষ রহমতরূপে এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।” (সূরা আম্বিয়া : ৮৩-৮৪)।

পৃথিবী এক পরিস্থিতিতে আবর্তিত হয় না, বরং একাধিক কারণে ও বহুরূপে মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যায় দুঃখ-দুর্দশার নানামাত্রিক অবস্থা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিভিন্ন স্তর। আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ আশ্রয় গ্রহণ ও মাওলার দরবারে বিনম্র মিনতিই যাবতীয় দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা থেকে বাঁচার একমাত্র পরিত্রাণ ও বিকল্পহীন রক্ষাকবচ। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো জানি, তারা যা বলে তাতে আপনার অন্তর সংকুচিত হয়, তাই আপনি নিজের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন। আর আপনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপন রবের ইবাদত করুন।’ (সূরা হিজর : ৯২-৯৯)।
আনুগত্য আনন্দ ও প্রফল্লতার বিষয়। আল্লাহর ভয় খুশি ও প্রশান্তির জিনিস। তাই হে আল্লাহর বান্দা, তুমি তোমার রবের আনুগত্যকে আঁকড়ে ধর। তিনি তোমার জন্য যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার পথ ও সব ধরনের দুরবস্থা থেকে মুক্তির দ্বার তৈরি করে দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য পথ তৈরি করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত পন্থায় জীবিকা দান করেন।’ (সূরা তালাক : ২-৩)। ‘পুণ্যবান লোকরা পরম স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে।’ (সূরা ইনফিতার : ১৩)। এ আয়াত পার্থিব জীবনেও হৃদয়ের স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
যখন তোমাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ঘোর অন্ধকার আবদ্ধ করে রাখবে এবং নানা দুশ্চিন্তার গ্লানি তোমাকে পেয়ে বসবে তখন তুমি নিবিষ্ট মনে গভীরভাবে তোমার রবের কিতাব আঁকড়ে ধরে তা তেলাওয়াত কর। তদনুযায়ী সাড়া দাও ও আমল কর। কেননা তা হৃদয়ের আলো। সব বিপদাপদ থেকে মুক্তির প্রতিষেধক। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ, তোমাদের হৃদয়ে যা আছে তার আরোগ্য ও মোমিনদের জন্য দিশা ও রহমত এসেছে।’ (সূরা ইউনুস : ৫৭)। তিনি আরও বলেন, ‘বলুন, এটা ঈমানদারদের জন্য দিশা ও আরোগ্য।’ (সূরা ফুসসিলাত : ৪৪)। সুতরাং যে তার রবের কালামের সঙ্গে নিজেকে নিবেদিত করেছে এবং যার হৃদয়ে তার জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়েছে তার সব দুঃখ বিদূরিত হয়েছে। তার যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের অবসান হয়েছে।
যখন তোমার মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভর করবে এবং তোমার হৃদয়কে তা আক্রান্ত করবে তখনই তুমি তোমার রবের সামনে নিবেদিত হও। তাঁর কাছে অভাব প্রকাশ কর। তোমার স্রষ্টার জন্য বিনম্র হও। মিনতি ও প্রার্থনা করে তাঁর আশ্রয় নাও। আল্লাহ বলেন, “এবং স্মরণ কর আইউবের কথা, যখন তিনি নিজের প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেন, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম, তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের মতো আরও দিলাম, আমার বিশেষ রহমতরূপে এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’ (সূরা আম্বিয়া : ৮৩-৮৪)।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আকুল মিনতি কর। আন্তরিক সত্যনিষ্ঠ প্রার্থনায় মগ্ন হও, মুখে মুখে প্রকাশ করে, বাস্তব অবস্থার ভাষায়। ভেতরে-বাহিরে বিনীত ভঙ্গিতে হৃদয়মন উজাড় করে। স্রষ্টার তরে সৃষ্টির পরিপূর্ণ নতি স্বীকার করে। প্রভুর জন্য ভৃত্যের পক্ষ থেকে নিশ্চিত বিশ্বাস রেখে যে, তিনি ছাড়া কোনো ঠাঁই নেই, তিনি ছাড়া কোনো পরিত্রাণকারী নেই। আল্লাহ বলেন, “এবং স্মরণ করুন যুন-নূন এর কথা, যখন তিনি ক্রোধভরে বের হয়ে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন আমি তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করব না। অতঃপর তিনি অন্ধকার থেকে আহ্বান করেছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা, সুবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জালিমিন।’ ‘তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তুমি পবিত্র, মহান। আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’ তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা থেকে এবং এভাবেই আমি মোমিনদের উদ্ধার করে থাকি।” (সূরা আম্বিয়া : ৭-৮৮)।
আমাদের রাসুল (সা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে এ দোয়াটি করার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। কোনো মুসলিম কোনো বিষয়ে এ দোয়াটি করলে আল্লাহ অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেন। সংকট দূর করার ও বিপদ থেকে মুক্তির জন্য এটি অন্যতম একটি দোয়া। কেননা এ দোয়াটিতে আছে আল্লাহর একত্ব, বড়ত্ব ও পবিত্রতার বিশাল মর্মবাণী, আছে সৃষ্টিকর্তার হকগুলো আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ত্রুটি, অক্ষমতা ও নিজের প্রতি অন্যায়ের স্বীকারোক্তি। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই, কারণ তাওহিদের পূর্ণতা ও ওহির মাধ্যমে প্রাপ্ত ঈমানের তাৎপর্যগুলো পালন করা ছাড়া হৃদয়ের কোনো স্বাচ্ছন্দ্য নেই, মনের কোনো পরিতৃপ্তি নেই। এজন্য বোখারি ও মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) বিপদ ও সংকটের সময় বলতেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রব্বুল আরশিল আজিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রব্বুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি, রব্বুল আরশিল কারিম।’
দুঃখ-দুর্দশা দূর করার প্রার্থনায় থাকবে আল্লাহর কাছে আহাজারি মিশ্রিত মিনতি, যেখানে উল্লেখ করবে তাঁর সুন্দরতম নামগুলো ও মহান গুণাবলির কথা। যেমন রাসুলুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল হালিমুল কারিম, সুবহানাল্লাহি ওয়া তাবারাকাল্লাহু, রাব্বুল আরশিল আজিম, ওয়াল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।’
দুঃখ-দুর্দশা সংঘটিত হওয়ার আগেই তা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার দোয়া হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়া আউজু বিকা মিনাল আযজি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজু বিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউজু বিকা মিন গালাবাতিত দাইনি ও কাহরির রিজাল।’ ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে দুঃখ-দুর্দশা থেকে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে অক্ষমতা ও অলসতা থেকে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে পানাহ চাই, তোমার কাছে ঋণের চাপ ও মানুষের নিপীড়ন থেকে পানাহ চাই।’ এসব বিষয় দুশ্চিন্তার কারণ। বান্দার মুখে ও হৃদয়ে সবসময় এ দুটি দোয়া থাকবে : ‘আল্লাহু রাব্বি, লা উশরিকু বিহি শাইয়া।’ ‘ইয়া হায়্যু ইয়া কায়্যুম বিরাহমাতিকা নাস্তাগিছ।’
আনন্দ, প্রশান্তি, খুশি ও উৎফুল্লতার সবচেয়ে বড় উপায় হলো, তুমি তোমার রবের সামনে ফরজ কিংবা নফল নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যাবে, নিষিদ্ধ সময়গুলো ছাড়া। এমন বিনম্র নামাজ যাকে আচ্ছাদিত করে রাখে মহাপ্রতাপশালী পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি নতি স্বীকার ও তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষিতা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর।’ (সূরা বাকারা : ৪৫)।
উম্মে সালামাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে নবী করিম (সা.) ঘুম থেকে জেগে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! আজ রাতে কী কী দুর্যোগ অবতীর্ণ হয়েছে? আর কী কী সম্পদের ভা-ার উন্মুক্ত হয়েছে? তোমরা ঘরবাড়ির গৃহিণীদের জাগিয়ে দাও, কেননা দুনিয়ার অনেক আবৃতা আখেরাতে বস্ত্রহীন হয়ে যাবে।’ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘তাদের জাগিয়ে দাও যাতে তারা নামাজ আদায় করে।’ (বোখারি)। এ হাদিস সম্পর্কে ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘অনিষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কার সময় দ্রুত নামাজের দিকে যাওয়া মুস্তাহাব।’ এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখলে সে যেন জেগে যায় এবং নামাজ পড়ে।’ উম্মতের মহান পূর্বসূরিরা এ অনুযায়ীই আমল করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন থেকে এরকমই বর্ণিত হয়েছে।
যাবতীয় বিপদাপদ দূরীভূত করতে ও দুর্যোগ দমন করতে যে বিষয়টির বিস্ময়কর প্রভাব রয়েছে সেটা হলো কথা বা কাজের দ্বারা বিভিন্ন সৎকর্ম ও অনুগ্রহ প্রদান করা, বিশেষ করে দান-খয়রাত করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চই আল্লাহ দান-খয়রাতকারীদের প্রতিদান দেবেন।’ (সূরা ইউসুফ : ৮৮)। ‘তোমরা অনুগ্রহ কর, নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা :  ১৯৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ভালো ভালো কাজ মন্দের আঘাত-আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, গোপনে দান করলে তা রবের ক্রোধকে নিভিয়ে দেয় এবং আত্মীয় বজায় রাখলে আয়ু বৃদ্ধি পায়।’ (তাবরানি)।
তাই তোমরা সৎকর্ম করে, কল্যাণকর বিষয়গুলোর প্রতিযোগিতা করে, ফরজ বিধানগুলো আঁকড়ে ধরে এবং যাবতীয় ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের ওপর অবিচল থাক। তাহলে তোমরা সুখী হবে এবং সফল হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে পুরুষ বা নারী মোমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন প্রদান করব এবং তাদের আমলের সর্বোত্তম প্রতিদান তাদের প্রদান করব।’ (সূরা নাহল : ৯৭)। হৃদয়ের প্রফুল্লতা ও বিপদ দূর করার অন্যতম প্রধান উপায় হলো নবী করিম (সা.) এর জন্য বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা। ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম ওয়া বারিক আলা হাবিবিনা মুহাম্মাদিন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’

২৮ মহররম ১৪৪১ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর