০১ নভেম্বর ২০১৫ (এনবিআর) সিনিয়র সদস্য ফরিদ উদ্দিনকে চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রস্তাব করেছিলেন। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোরও প্রস্তাব ছিল অর্থমন্ত্রীর। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের বাধা ও চাপে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয় পরিবেশ সচিব নজিবুর রহমানকে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই নজিবুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতিহিংসামূলক তৎপরতা শুরু করেন। সাবেক চেয়ারম্যান যেসব কর্মকর্তাকে পছন্দ করতেন প্রথমেই তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। প্রতিমাসে কর্মকর্তাদের টেলিফোন কললিস্ট সংগ্রহ করে হয়রানি, চাপ সৃষ্টিসহ নানা ধরনের দমননীতি শুরু হয়। একই সঙ্গে কোনো কারণ ছাড়াই তুচ্ছ অজুহাতে কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলিসহ বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করা হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, ৮২ ব্যাচের মেধা তালিকার শীর্ষে থাকা সদস্য শুল্কনীতি ফরিদ উদ্দিনকে অর্থমন্ত্রী এনবিআরের চেয়ারম্যান করার লিখিত প্রস্তাব করার কারণে নজিবুর রহমান তাকেই প্রধান শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং অপমানজনক আচরণ করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, ১ম গ্রেডের সচিব মর্যাদাসম্পন্ন এ কর্মকর্তাকেই বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী এনবিআর চেয়ারম্যানকে ভর্ৎসনা করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। এর আগে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেনের স্ত্রী, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত এনবিআরের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য জাহান আরা সিদ্দিকীকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য করেন। ৮১ ব্যাচের সচিব পদমর্যাদার এ কর্মকর্তার অপরাধ ছিল নজিবুর রহমানের অপমান ও অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করা। এসব ঘটনায় রাজস্ব প্রশাসনের সর্বত্র তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এনবিআরের আরেক সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) হোসেন আহমেদ চেয়ারম্যানের আপত্তিকর কার্যকলাপ নিয়ে আপত্তি করেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভায় তিনি এনবিআরের স্বার্থবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করে বক্তব্য দেন। পরিণতিতে হোসেন আহমেদের সঙ্গে এমনই অপমানজনক আচরণ করা হয় যে তিনি বাধ্য হন পদত্যাগপত্র জমা দিতে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে তার পদত্যাগপত্র কার্যকর হচ্ছে। এ ছাড়া কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি এনবিআরের আরেক সদস্য ফিরোজ শাহ আলমকেও অবসরে পাঠানোর অপচেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর আগে সম্মান বাঁচাতে আরেক সৎ কমিশনার মারুফুল ইসলাম স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। রাজস্ব প্রশাসনে কোনো চেয়ারম্যানের সঙ্গে শীর্ষ কর্মকর্তাদের এমন দূরত্ব অতীতে আর কখনও হয়নি। এভাবে একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার উদ্যোগও নজিরবিহীন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, নজিবুর রহমান যে কজন কর্মকর্তাকে তার বিশ্বস্ত মনে করেন তাদের প্রায় সবাই বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও বিতর্কিত। কর্মজীবনেও তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথচ চেয়ারম্যানের হয়ে সব পর্যায়েই তাদের অনাকাক্সিক্ষত খবরদারিতে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাই বিব্রত ও অপমানিত বোধ করছেন। এনবিআরের ১৫ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে তিনজন সদস্য, সিআইসির ডিজি বেলাল উদ্দিন এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ডিজি মঈনুল খান তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। রাত ৯টার পর এসব কর্মকর্তার সঙ্গে চেয়ারম্যান নিয়মিত বৈঠক করেন। সব ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তার ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় এই কজন কর্মকর্তার মাধ্যমে। তারা যেসব কর্মকর্তাকে যখন যেখানে বদলি বা পদোন্নতির সুপারিশ করেন তাই কার্যকর করেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের যে কোনো পরিদর্শন বা কাজে তারাই সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এ নিয়ে রাজস্ব প্রশাসনের সর্বত্র তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে।
শুধু তাই নয়, রাজস্ব প্রশাসনের আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা, যার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে, এনায়েত হোসেন নামের এনবিআরের এ সদস্যকে সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন এনবিআর থেকে সরিয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে শাস্তিমূলক নিয়োগ দেন। সে সময় তিনি ছিলেন সদস্য ভ্যাট বাস্তবায়ন। নজিবুর রহমান তাকে আবার এনবিআরে ফিরিয়ে এনে সদস্য ভ্যাট বাস্তবায়নেরই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। তার স্থলে শাস্তিমূলক নিয়োগ দেয়া হয় সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত এনবিআরের বোর্ড সদস্য খোন্দকার আমিনুর রহমানকে। যাকে শতভাগ সততার জন্য সরকার এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক পদে ডেপুটেশনে নিয়োগ দেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, অবসরে যাওয়ার আগমুহূর্তে এনায়েত হোসেনকে নজিরবিহীনভাবে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন চেয়ারম্যান। এ নিয়েও রয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
এ ছাড়া বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মাহবুবুজ্জামানকে নিয়োগের কয়েক মাসের মাথায় তুচ্ছ অভিযোগে কোনো পদ-পদবি না দিয়ে এনবিআরে সংযুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগও পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অতীতে কোনো কমিশনারকে এভাবে এনবিআরে সংযুক্ত করার নজির নেই। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করে সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখালেও কমিশনার সহিদুল ইসলামকে গুরুত্বহীন চট্টগ্রাম আপিল কমিশনারেটে নিয়োগ দেয়া হয়। দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর ঢাকার বাইরে চাকরি করার পর কমিশনার হুমায়ুন কবীরকে কমলাপুর আইসিডির কমিশনার করা হয়। কিন্তু নিয়োগের কয়েক মাসের মাথায় কোনো কারণ ছাড়াই তাকে কম গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাট গোয়েন্দা ও নিরীক্ষা কমিশনারেটে বদলি করা হয়। এ ধরনের হয়রানি অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার পর্যায়ে হয়েছে একাধিক। এমনও দেখা গেছে নিয়োগের ২-৩ মাসের মাথায় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। আবার কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার পর্যায়ের বহু কর্মকর্তা আছেন যাদের দুই বছরের বেশি নিয়োগ হলেও বদলি করা হচ্ছে না। এসব ঘটনা রাজস্ব আদায়ে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে।
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কাজটি হচ্ছে নিজ দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের নজিরবিহীন এক অভিযোগ। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বা এনবিআরের ক্ষমতাই যথেষ্ট। কিন্তু নজিবুর রহমান ৪১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীনভাবে ডিও লেটার পাঠিয়ে অভিনব অভিযোগ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। (ডিও নং ৪৪৬, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, তারিখ ১৬ এপ্রিল)। এতে কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এই ডিও লেটারে চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, ১. গত ১৫ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৫টায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে একটি সভা আহ্বান করা হয়। এটি প্রথমে এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে কমিটির বাইরের কতিপয় কর্মকর্তা উপস্থিত হন। সবার জন্য উন্মুক্ত না হওয়ায় এবং অন্য সদস্যদের আহ্বান না করায় সভাটিকে গোপন বৈঠক হিসেবে গণ্য করা যায়। রাজস্ব প্রশাসন কর্তৃক গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনাকারীরা ওই বৈঠকের উদ্যোক্তা। ২. অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রধান উৎস কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর প্রশাসনের কার্যাবলী সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ডের একজন সদস্য রুলস অব বিজনেসের বিধিবিধান লংঘন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে পাশ কাটিয়ে রাজস্ব বোর্ডের ১ম সচিবের স্বাক্ষরে বিভিন্ন এসআরও জারি, গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব এসআরও-তে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত/ভেটিয়ের জন্য রাজস্ব বোর্ড থেকে সরাসরি আইন ও লজেস্টিক বিভাগে পাঠানো হলে ওই বিভাগ তা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের মাধ্যমে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু রাজস্ব বোর্ডের কতিপয় সদস্য এ পরামর্শকে চ্যালেঞ্জ করে প্রয়োজনে রুলস অব বিজনেস এবং অ্যালোকেশন অব বিজনেস সংশোধনের দাবি উত্থাপন করেন। এ জন্য দায়ী নেতৃস্থানীয় সদস্য ও কমিশনারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্তভাবে জরুরি বলে মনে করি। বর্ণিত বিষয়সমূহ তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন রাজস্ব বোর্ডে পাঠানোর জন্য পত্রে অনুরোধ করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, নজিরবিহীন এ চিঠি পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে জরুরি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, উল্টো নজিবুর রহমানের কার্যকলাপ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করা হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। নিজ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের এ ধরনের পত্র অসন্তোষকে আরও উসকে দেয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এনবিআরের একাধিক সদস্য এবং কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছি। নজিবুর রহমান এনবিআরের সব শৃংখলাকে ভূলুণ্ঠিত করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গ্র“পিং আর বিভেদ উসকে দিয়েছেন। এক গ্র“পকে দিয়ে আরেক গ্র“পকে শায়েস্তা করছেন। এ অবস্থা অসহনীয়। যা রাজস্ব আদায়ের ওপর মারাÍক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীই চেয়ারম্যানের অন্যায় আচরণ ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ। এভাবে আতংক আর ক্ষোভ নিয়ে কারও পক্ষেই রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী হওয়া সম্ভব নয়। সূত্র যুগান্তর ( ০১ নভেম্বর ২০১৫)
সংবাদ শিরোনাম
নজিবুর রহমানের প্রতিহিংসার শিকার শীর্ষ কর্মকর্তারা
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০৯:০০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ নভেম্বর ২০১৫
- ২৬৭ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ