দনিয়া কলেজে ৪১ কোটি টাকা লুটপাট

হাওর বার্তাঃ রাজধানীর দনিয়া কলেজে বিভিন্ন সময়ে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

গত তিন অর্থবছরে দনিয়া কলেজ তহবিল থেকে ১৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ ২২ শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। শিক্ষকরা মিলেমিশে অবৈধভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার নামে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। ভবন নির্মাণে চুক্তির বাইরে ঠিকাদারকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।

ডিআইএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চাকরি ছেড়ে দেশের বাইরে, মারা গেছেন- এমন শিক্ষকদের নামে সরকারি বেতন-ভাতা তোলা হয়েছে। কলেজের উপাধ্যক্ষ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে বেতন-ভাতা নিয়েছেন দুই জায়গা থেকেই। অতিরিক্ত শাখা বা শিফট না থাকার পরও শিফটের নামে প্রতি মাসে বেতনের বাইরে ছয় লাখ ৮৭ হাজার টাকা নেন। সরকারি চাকরিজীবীদের মতো তারা বাড়িভাড়াও নিচ্ছেন। তাও একবার নয়, মাসে দুবার। এমন ভয়াবহ জালিয়াতি, নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির শনির আখড়ায় অবস্থিত দনিয়া কলেজে।’ গত ছয় বছরে এভাবে লুটপাট হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিআইএ কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক রসময় কীর্ত্তনীয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম কলেজের সার্বিক বিষয় তদন্ত করেন। তারা কলেজে ব্যাপক লুটপাটের প্রমাণ পান। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেই প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইনের দফতরে রয়েছে।

আর্থিক দুর্নীতি

প্রতিবেদনে দনিয়া কলেজের আয়-ব্যয় বিষয়ে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে কলেজটিতে বেসরকারি ব্যয় ছিল ছয় কোটি ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৯৮ টাকা। অথচ কলেজের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়েছে ১৮ কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৪ টাকা। অর্থাৎ ১১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৬ টাকা অপ্রদর্শিত রয়েছে। এ টাকা কোন খাতে ব্যয় হয়েছে বা কোন ফান্ডে জমা আছে, তা দেখাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। এছাড়া গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই কোটির বেশি টাকা অপ্রদর্শিত রয়েছে। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত রয়েছে তিন কোটি টাকা। এ তিন বছরে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা কলেজের তহবিল থেকে গায়েব হয়ে গেছে। এসব টাকা ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপনের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

এছাড়া কলেজে ২০১৩-১৪ অর্থবছর হতে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক থেকে উঠানো এক কোটি ৪০ লাখ ১১ হাজার টাকার কোনো হিসাব কলেজের কাছে নেই। যা আত্মসাৎ বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। ভ্যাট বাবদ এক কোটি দুই লাখ ৪৩ হাজার টাকা কর্তন করা হলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। আয়কর বাবদ ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৭৬৫ টাকা কর্তন করা হলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি।

১৯৯৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বেতন বইয়ের ৩৭ হাজার ২৩০টি রাজস্ব স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়নি। ২০১২ সাল থেকে তদন্তকালীন সময়ে সরকারি ও বেতন বই না থাকায় রাজস্ব স্ট্যাম্পের কোনো হিসাব পায়নি তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০ খাতে টাকা আদায় করে কলেজ। এসব খাতে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয় কোটি নয় লাখ ৯৪ হাজার টাকা আয় হলেও কলেজ তহবিলে জমা দেয়া হয়নি। পুরো টাকাই ব্যয় হয়েছে বলে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে, কীভাবে ব্যয় হয়েছে তার কোনো ভাউচার দেখাতে পারেনি। খাতভিত্তিক আয় হলেও ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। যা সরাসরি আত্মসাতের শামিল।

ভবন নির্মাণে দুর্নীতি

কলেজের ১০তলা একটি ভবন নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ১১ কিস্তিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১০ কোটি দুই লাখ ২১ হাজার টাকায় চুক্তি হলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে ১৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার বেশি। অতিরিক্ত দেয়া হয়েছে ছয় কোটি ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। ঠিকাদারকে চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হলেও চেক রেজিস্ট্রারে লেখা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ১০তলা ভবন নির্মাণের ব্যয় ক্যাশ বইয়ে লেখা নেই।

প্রতিষ্ঠানে ৫০০ জোড়া বেঞ্চ কেনা হয়। এসব বেঞ্চ সরবরাহের পর তা রেজিস্ট্রার খাতায় লেখা হয়নি। আদৌ ৫০০ জোড়া বেঞ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তদন্ত কমিটি।

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

কলেজে ২২ জন শিক্ষক বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পেয়ে এক কোটি ৮৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া আরও কয়েকজন শিক্ষক বিধিবহির্ভূতভাবে ১৯ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৩ টাকা আত্মসাৎ করেন। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যাপক তিনজন ৮৮ লাখ চার হাজার ৮৩ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কলেজের তথ্য অনুযায়ী ১৭৪ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন ২২ জন। তাদের মধ্যে অন্যতম উপাধ্যক্ষ মো. মোশারফ। তিনি ২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর দুই বছর পর তিনি আদালতে মামলা করে স্বপদে ফিরে আসেন। ২০০৯ সালে তিনি মানবিক সাহায্য বাবদ সাত লাখ টাকা কলেজ তহবিল থেকে অনুদান নেন। মামলা চলাকালীন ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মামলার কারণে ওই সময় সরকারি বেতন-ভাতা পাননি। পরে কোর্টের রায় অনুযায়ী, মামলা চলাকালীন বেতন-ভাতা হিসাবে কলেজ থেকে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ১১৫ টাকা নেন। একই সময়ে তিনি উৎসব ভাতা চার লাখ সাত হাজার টাকাসহ অন্যান্য আনুতোষিক সুবিধা বাবদ ২৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮০০ টাকা তোলেন। বিধিবহির্ভূতভাবে তিনি এ খাতে ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা নেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাধ্যক্ষ মো. মোশারফ বিধিবহির্ভূতভাবে কলেজের তহবিল থেকে চিকিৎসা ও এককালীন সুবিধা বাবদ দুই লাখ ১৪ হাজার টাকা নেন। এটিও ফেরতযোগ্য। তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন কলেজ তহবিল থেকে পূর্ণ বেতন-ভাতা নেন। গত ২০০৯ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২৩ লাখ ২০ হাজার ২৮৩ টাকা নেন। অতিরিক্ত ভাতা বাবদ ১৪ লাখ ৪৫ হাজার ও দায়িত্ব ভাতা ছয় লাখ ৫১ হাজার টাকা নেন।

শিফটের নামে অর্থ আত্মসাৎ

কলেজ পর্যায়ে শিফট চালুর নিয়ম নেই। অথচ শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ শিফট ভাতা নিচ্ছেন। এক মাসেই ১১৫ শিক্ষক-কর্মচারী ছয় লাখ ৮৭ হাজার টাকার বেশি শিফট ভাতা নেন। বেতন-ভাতা বাবদ এমপিওভুক্তদের থেকে ২০ টাকা ও নন-এমপিওদের কাছ থেকে ১০ টাকা কেটে রাখা হলেও বেতন বিলে কোনো রাজস্ব ব্যবহার করা হয়নি। শিক্ষক একরামুল হক প্রতি মাসে সরকারিভাবে বেতন-ভাতা বাবদ ৪৩ হাজার ৪২৫ টাকার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কলেজ থেকে নেন ৯৭ হাজার ১৩২ টাকা। এছাড়া প্রতি মাসে ভাতাও নেন ২৫ হাজার টাকা করে। অথচ মূল পদে থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত ভাতা নেয়ার সুযোগ নেই। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহকারী অধ্যাপক সায়রা বেগম বেতন-ভাতা বাবদ সরকারিভাবে প্রতি মাসে নেন ৩৮ হাজার ৭৭৫ টাকা। কলেজ তহবিল থেকে নেন প্রতি মাসে এক লাখ তিন হাজার ৩৯৬ টাকা। এছাড়া দায়িত্বভাতা বাবদ প্রতি মাসে নেন ৪১ হাজার টাকা। অথচ বিধি মতে মূল বেতনের ১০ শতাংশ অর্থাৎ সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা নিতে পারবেন তিনি। অতিরিক্ত নেয়া এসব টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ফেরতযোগ্য। তার জন্য গাড়িরও বরাদ্দ রয়েছে। অথচ অনিয়ম করে গাড়ি বাবদ প্রতি মাসে আরও অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ২৪৮ টাকা নেন।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে দনিয়া কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্য জানতে কলেজে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি এমপিওভুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে স্নাতক স্তর এমপিওভুক্ত হয়। ২০০৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কোড পরিবর্তন করা হয়। উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি স্তরের সর্বশেষ এমপিও হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএ’র পরিচালক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন  বলেন, দনিয়া কলেজে নানাভাবে অনিয়মের মাধ্যমে ৪১ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ, একাধিক শিফটের নামে অর্থ আদায়, বিভিন্ন উন্নয়নের নামে অর্থব্যয় করে, যার প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, আমরা তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ও ডিআইএ- এ তিন প্রতিষ্ঠান বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসেন জানান, দনিয়া কলেজের তদন্ত প্রতিবেদন তার দফতরে রয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূূত্রঃ জাগো নিউজ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর