রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার স্ত্রী মিন্নিকে ২০ দিন পর আটক করে পুলিশ। ১৬ জুন সকালে আটকের পর ওইদিন রাতেই তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২ দিনের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মিন্নি। সেই জবানবন্দির একটি কপি রাইজিংবিডির প্রতিবেদকের হাতে আসে।
মিন্নির সেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হুবহু পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো-
“আমি বরগুনা সরকারি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করি। ২০১৮ সালে বরগুনা আইডিয়াল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করি। আইডিয়াল কলেজে পড়াশানা করাকালীন রিফাত শরীফের সাথে ২০১৭ সালে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়। ওই সময় রিফাত শরীফ বামনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিল। রিফাত শরীফ আমাকে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার মধ্যে নয়ন বন্ড একজন। কলেজে যাওয়া আসার পথে নয়ন বন্ড আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করত। আমি তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় সে আমার বাবা ও ছোট ভাইকে ক্ষতি করার ভয় দেখাত। বিষয়টি আমি রিফাত শরীফকে জানাইনি।
আমি রিফাত শরীফকে ভালোবাসতাম। কিন্তু রিফাত শরীফ অন্য মেয়েদর সঙ্গে সম্পর্ক করার কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করি। এ কারণে রিফাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। আমি ধীরে ধীরে নয়ন বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমি নয়নের মোবাইল নম্বরে আমার মায়ের মোবাইল নম্বর এবং নয়নের দেয়া নম্বর শেষে ৬১১৩ ও একটি নম্বর শেষে ৪৫ দিয়ে নয়নকে কল, ম্যাসেজ এবং ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কল দিতাম। বরগুনা সরকারি কলেজে পড়াকালীন ধীরে ধীরে রিফাত ফরাজী, রিফাত হাওলাদার ও রাব্বি আকনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রেমের সম্পর্কে কারণে নয়ন বন্ডের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। নয়নের বাসায় দু’জনের শারীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি ও ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি প্রথমে জানতাম না।
নয়নের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম এবং আমাদের শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। এরপর গত ১৫/১০/১৮ আমি রোজী আন্টির বাসায় যাওয়ার পথে বিকেল বেলা ব্যাংক কলোনি থেকে নয়ন বন্ড রিকশাযোগে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।
নয়নের বাসায় গিয়ে আমি শাওন, রাজু, রিফাত ফরাজী এবং আরো ৭/৮ জনকে দেখি। শাওন বাইরে গিয়ে কাজী ডেকে আনে এবং নয়নের বাসায় আমার ও নয়নের বিয়ে হয়। তারপর আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে নয়নকে ফোন করে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলি। তখন নয়ন বলে- ওইটা বালামে ওঠে নাই। বালামে না উঠলে বিয়ে হয় না।
এরপরও আমি নয়নের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখি। নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবারের কেউ জানে না। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস আমি মিস করি। তখন নয়নের মোটরসাইকেলে আমি কুয়াকাটা যাই এবং নয়নের সঙ্গে একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করি।
আমি নয়নের বাসায় আসা যাওয়ার সময় জানতে পারি নয়ন মাদকসেবী, ছিনতাই করে এবং তার নামে থানায় অনেক মামলা আছে। এ কারণে নয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয় এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার পূর্বের ভালোবাসার সম্পর্ক আবার শুরু হয়। গত ২৬ এপ্রিল পারিবারিকভাবে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ শারীরিক সম্পর্ক, মোবাইলে কথা-বার্তা, ম্যাসেজ এবং ফেসবুকের মেসেঞ্জারে যোগাযোগ-সবই চলত।
বিয়ের পর জানতে পারি রিফাত শরীফও মাদকসেবী। সে মাদকসহ পুলিশের কাছে ধরা খায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমি রিফাতসহ আমার বাবার বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতাম। নয়ন বন্ডের বিষয় নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হতো এবং রিফাত শরীফ আমার গায়ে হাত তুলতো।
গত ২৪ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দিয়ে বলে, তোর স্বামী, হেলালের ফোন ছিনাইয়া নিয়েছে। পরে রিফাত ফরাজীও আমাকে ফোন দিয়ে বলে, হেলালের মোবাইলটি রিফাতের কাছ থেকে নিয়ে হেলালকে ফেরত দিতে। আমি রিফাত শরীফকে হেলালের ফোন ফেরত দিতে বললে রিফাত শরীফ আমাকে চড় থাপ্পড় মারে এবং তলপেটে লাথি মারে। রাতে মোবাইল ফোনে বিষয়টি নয়নকে জানাই এবং কান্না করি।
পরদিন ২৫ এপ্রিল আমি কলেজে গিয়ে নয়নের বাসায় যাই। রিফাত শরীফকে একটা শিক্ষা দিতে হবে এ কথা নয়নকে বললে নয়ন বলে, হেলালের ফোন নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে রিফাত ফরাজী তাকে মারবে। তারপর আমি বাসায় চলে আসি এবং এ বিষয়ে কয়েক বার নয়ন বন্ডের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার স্বামী রিফাত শরীফকে মাইর দিয়া শিক্ষা দিতে হবে, এ পরিকল্পনা করি।
২৬ এপ্রিল আমি কলেজে যাই এবং সায়েন্স বিল্ডিং এর পাশের বেঞ্চের উপর রিফাত ফরাজী, রাব্বি, আকনকে বসা পাই। রিফাত হাওলাদার পাশে দাঁড়ানো ছিল। তখন আমি রিফাত ফরাজীর পাশে বসি এবং রিফাত ফরাজীকে বলি, ওকি ভাইটু খালি হাতে আসছ কেন? এ কথার জবাবে রিফাত হাওলাদার বলে, ওকে মারার জন্য খালি হাত যথেষ্ট।
এরপর রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসা করি, নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ কলেজে এসেছে কীনা? তখন নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দেয়। সে কোথায় জানতে চাইলে নতুন ভবনের দিকে যেতে বলে এবং ওই সময় নয়ন নতুন ভবনের পাশের দেয়াল টপকায়ে ভেতরে আসে। আমি হেঁটে নতুন ভবনের দিকে যাই এবং নয়নের সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারপিটের বিষয়ে কথা বলি। এরপর রিফাত শরীফ কলেজের ভেতরে আসে এবং আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলের কাছে নিয়ে আসে।
কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে না উঠে সময় ক্ষেপণ করার জন্য পুনরায় কলেজ গেটে ফিরে আসি। রিফাত শরীফ আমার পেছন পেছন ফিরে আসে। তখন রিফাত ফরাজী কিছু পোলাপানসহ আসে। রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছ কেন? রিফাত শরীফ বলে, আমি গালি দেই নাই। ওই সময় রিফাত ফরাজী রিফাতের জামার কলার ধরে এবং রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে। রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়, রিফাত হাওলাদার এবং আরও অনেকে রিফাত শরীফকে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মারধর করতে করতে এবং টেনে হেঁচড়ে ক্যালিক্সের দিকে নিয়ে যায়।
ক্যালিক্সের সামনে তারা রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। আমি তখন সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় নয়ন বন্ড ক্যালিক্সের সামনে এসে রিফাত শরীফকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। মারপিটের মধ্যেই রিফাত ফরাজী টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে যায় এবং রিফাত ফরাজী দু’টি দা ও টিকটক হৃদয় এবং রিফাত হাওলাদার লাঠি নিয়ে আসে।
একটি দা দিয়ে নয়ন বন্ড ও অন্য দা দিয়ে রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে কোপাচ্ছিল। রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখে যাতে রিফাত শরীফ পালাতে না পারে। রিফাত শরীফকে কোপাইতে দেখে আমি নয়ন বন্ডকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। দায়ের কোপের আঘাতে রিফাত শরীফ রক্তাক্ত হয়। সে রক্তাক্ত অবস্থায় পূর্ব দিকে হেঁটে যায় এবং আমি রাস্তায় পড়ে থাকা জুতা পরি। উপস্থিত একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দিলে আমি রিকশা করে তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি।
এরপর আমার বাবাকে ফোন করি। আমার বাবা ও চাচা হাসপাতলে আসে। এরপর রিফাত শরীফকে বরিশাল পাঠানো হয়। আমার কাপড়-চোপড়ে রক্ত লেগে থাকায় আমি বাসায় চলে যাই। পরে আমি জানতে পারি রিফাতের অবস্থা খারাপ। এরপর নয়নকে ফোনে বলি তোমরা ওকে যেভাবে কোপাইছো তাতে তো ও মারা যাবে এবং তুমি আসামি হবা। তারপর ওর অবস্থান জানতে চাই এবং পালাতে বলি। দুপুরের পর খবর পাই রিফাত শরীফ মারা গেছে। “
মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাঠ করে শোনানোর পর এ প্রসঙ্গে তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘মিন্নিকে স্বাক্ষী থেকে আসামি করা এবং রিমান্ড ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় সবকিছুই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের দায় চাপিয়ে দেয়ার একটি বিশেষ পরিকল্পনার অংশ মাত্র। একটি বিশেষ মহলের ফোনে পুলিশের যেমন দরকার তেমনটাই লিখে মিন্নির স্বাক্ষর নিয়েছে। আমরা জেল সুপারের মাধ্যমে আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছি। যা শুনানীর জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। ’
মিন্নির এমন জবানবন্দি সমর্থন করেন আপনারা? এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘সবই পুলিশের সাজানো গল্প। আমার মেয়ে হত্যায় জড়িত ছিল না। বরং স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে যা দুনিয়ার সবাই দেখেছে। এই দায় আমার মেয়ের উপর চাপিয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তাকে বাসা থেকে ডেকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড নেয়া হয়। পরবর্তীতে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়।
১৬৪ ধারায় আদালতের কাছে দেয়া মিন্নির জবানবন্দি প্রসঙ্গে মিন্নির পক্ষের আইনজীবী অ্যডভোকেট মাহবুবুল বারি আসলাম বলেন, ‘মামলার এজাহারের বিবরণ, চার্জশিট, মিন্নির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি এবং ঘটনার ভিডিও ফুটেজে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে। মিন্নি জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছে, যা এখনো নথি সামিলে রয়েছে। আমরা এসব অসঙ্গতিগুলো পর্যালোচনা করে আদালতে উপস্থাপন করব।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে তাকে আটক ও পরে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে জিজ্ঞাসবাদ করা হয়। সে সময় মিন্নি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় যে জবানবন্দি দিয়েছে, পুলিশ তাই এখানে উল্লেখ করেছে। আমরা রিফাত হত্যার মূল রহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় আন্তরিক ছিলাম। এখানে পুলিশ কোনোভাবে প্রভাবিত হয়নি বা কারো স্বার্থ রক্ষারও কোনো সুযোগ নেই।’