আবীর পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। মাসতিনেক আগে নতুন বিয়ে করেছে। তখন থেকেই তার বোলভাল বদলে যেতে লাগলো। বন্ধুরা একদিন বাগে পেয়ে তাকে ধরে বসলো, তাদেরকে বদলে যাওয়ার কাহিনী বলতে হবে। আবির তাদেরকে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। আসলে সেও এখনো তার বদলে যাওয়ার বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছিলো না। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে আর থাকতে না পেরে শেষে মুখ খুলল। -আমি কিভাবে পুরো বিষয়টা খুলে বলবো ঠিক করতে পারছি না। আবীরের দ্বিধা দেখে আফনান বলল: -ঠিক আছে, আমরা প্রশ্ন করি, তুই শুধু উত্তর দিয়ে যা। কিছুই লুকোবি না, বলে দিলাম। -আচ্ছা, এখানে লুকোচুরির কী আছে। -তোর সাথে কি ভাবীর সাথে বিয়ের আগে থেকেই পরিচয় ছিলো? -নাহ, একদম না। -তাহলে তোদের পারিবারিক ধ্যানধারনার থেকে একশ আশি ডিগ্রি বিপরীত মেরুর একটা পরিবারের সাথে কিভাবে তোদের যোগাযোগ ঘটল। -বলছি শোন! তোরা তো জানিস, আমার মাউন্টেনিং মানে পাহাড়ে চড়ার বেশ শখ। বাংলাদেশের প্রায় সব পাহাড়েই চড়া শেষ হয়ে গেছে। আগামী বছর নেপালে যাওয়ার কর্মসূচীও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। নেপাল যাওয়ার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে, আমাদের দলটা কয়েক মাস আগে বান্দরবান গিয়েছিলো। আমরা দলে ছয়জন ছিলাম। আমাদের গন্তব্য ছিলো চিম্বুক পাহাড়। আমরা ট্রেকিং (পর্বতারোহণ) শেষ করে বেস ক্যাম্পে ফিরে এসেছি। এমন সময় তিনজন মানুষ সেখানে এলেন। তারা জানালেন এখানে তাবলীগে এসেছেন। ঢাকা থেকে। আমাদের সাথে কিছু কথা বলতে চান। সাথে আসা দিপীকা আর পারিতা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। একেতো মেয়ে, তার ওপর ভিন্নধর্মাবলম্বী। তাবলীগের তিনজনের একজন বললো: -কোনও সমস্যা নেই। ওনারা একপাশে গিয়ে অপেক্ষা করুক। আমরা সামান্য কয়েকটা কথা বলেই বিদায় নিবো। দিপীকা বললো: -কোনও সমস্যা নেই। আমরা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করছি। একজন তাবলীগি ভাই কথা শুরু করলেন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি এক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এখন ছুটিতে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছেন। তিনি ইসলামের পরিচয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করেছেন, আখিরাত কি, জান্নাত-জাহান্নাম কি, কুরআন, নবীজি (সা.) ও অনেক বিষয়ে, অল্প সময়ের মধ্যেই আলোচনা করলেন। বললেন এখানে আমাদের কাজ শেষ হলে, তাদের সাথে যেন কিছুটা সময় কাটাই। তাহলে তারা ভীষণ খুশি হবে। আমাদের সবাইকে একবেলা খাবারের দাওয়াতও দিলেন। ওনারা দাওয়াত দিয়ে চলে গেলেন। আমরা ক্লান্ত ছিলাম। ক্যাম্পে এসেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আমাদের গাইড ছিলো একজন চাকমা ছেলে। অভিলাষ চাকমা। সে বাজার করতে গিয়েছিলো। পরদিন ছিলো আমাদের ঢাকা ফেরার তারিখ। রাতে শুয়ে শুয়ে আমি তাবলীগের কথাগুলো নিয়ে অনেক ভাবলাম। আমার পাশে শুয়ে থাকা আফনানের সাথেও বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সে হেসেই উড়িয়ে দিল। সকালে উঠে সবাই গোছগাছ করত লেগে গেলো। আমিও সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। সবাই রওয়ানা হওয়ার আগ মুহূর্তে আমি বললাম: -তোরা যা, আমি এখানে কয়েকটা দিন থাকতে চাই। -এখানে থাকবি মানে? -মানে আর কিছু না, আমি তাবলীগের হুযুরদের সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই। গতকাল তাদের কথা শুনে আমার ভেতরে কিছু কৌতূহল আর প্রশ্ন জেগেছে। -ঠিক আছে। তোর ওপর তো জোর চলবে না। তুই সব সময় যা ভাল মনে করিস, সেটাই করিস। তাহলে আমরা চললাম। তখন রামাদান মাস ছিলো। আমি তো রোজা রেখে অভ্যস্ত নই। তাবলীগের ভাইদের সাথে আমিও রোজা রাখলাম। ইফতারের সময় দারূন এক অনুভূতি হলো। এভাবে দশদিন কিভাবে যেন কেটে গেল। অনেক কিছু শিখলাম। জানলাম। দেখলাম। বুঝলাম। সেদিন আমাদেরকে যিনি দাওয়াত দিয়েছিলেন, তিনি হলেন মাওলানা আবদুল্লাহ ভাই। তার সাথে এ কয়দিনে বেশ হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো। তিনি আমাকে বড় আপন করে নিয়েছিলেন। শুধু তিনি কেন, জামাতের সবাই আমাকে আপনের চেয়েও বেশি সমাদর করেছে। একদিন কথা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ভাইকে বললাম: -আমি পরিবারের বড় ছেলে। আব্বু-আম্মু চাচ্ছেন, আমি যেন শিঘ্রি বিয়ে করি। আমার তো চাকুরি খোঁজার দরকার নেই। আমাদের ব্যবসা দেখাশুনা করা লাগবে। এখন বলুন তো, আমি দ্বীনের উপর অটল থাকার জন্য, দ্বীন শেখার জন্য কী করতে পারি? -আপনি একটা দ্বীনদার মেয়ে বিয়ে করুন। তাহলে আপনার দ্বীন শেখা ও দ্বীনের ওপর চলা দুটোই সহজ হয়ে যাবে। -আমাকে দ্বীনদার মেয়ে কে দেবে। আমার পরিবারই বা এমন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিবেন কেন! আমরা ঢাকা ফিরে এলাম। আম্মু বিয়ের জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করলেন। আমি অবদুল্লাহ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি বললেন: -আমার কাছে আপনার চাহিদা মতো একটা পাত্রী আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পাত্রীর পিতা তার মেয়েকে আলিম ছাড়া বিয়ে দেবেন না। তবে চেষ্টা করে দেখতে মন্দ কী! -মেয়েটার ঠিকানা? -সত্যি কথা বলতে লজ্জা লাগছে। তবুও আপনার আন্তরিকতা ও আগ্রহ দেখেই শুধু আমি এমন চিন্তা করেছি। মেয়েটা আসলে আমার ছোট বোন। তার নাম আয়েশা। এখন আব্বু – আম্মু আর ছোটবোন যদি রাজি হন, তাহলে আপনি যেমনটা চান সে রকম একটা মেয়ে আপনি পাবেন হয়তো। আমি অনেক খুঁজেছি, কিন্তু আপনার সাথে কাউকে মেলাতে না পেরে, শেষে এই সমাধানে এলাম। তবে আপনার হাতে সময় থাকলে, আমি আপনার উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করে ফেলতে পারবো। ইনশাআল্লাহ। -না না, কী বলছেন আপনি! এ তো আমার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। -আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আব্বুর সাথে দেখা করতে হবে। আব্বু এখন ই’তিকাফে আছেন। আমাদের মাদরাসার মসজিদে। প্রতি বছরই বসেন। আমি সব গোছগাছ করে আবদুল্লাহ ভাইদের গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। রশিদপুর পৌঁছতে ইফতারির সময় হয়ে গেল। আবদুল্লাহই ভাই বললেন: -আব্বু এখন কথা বলবেন না। তিনি মাগরিবের পর আউয়াবিন আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন। তারাবীহের পর কথা বলবেন আপনার সাথে। আমার আসার ব্যাপারে তাদের পরিবার আগে থেকেই জানতো। তাই তারাবীহের পর আবদুল্লাহই ভাইয়ের আব্বুর সাথে দেখা করতে কোনও সমস্যা হলো না। আমি আমার হালত পুরোপুরি জানাতে চাইলাম। তিনি বললেন: -আমি তো বাবা এখন তোমার সাথে বেশি কথা বলতে পারবো না। এখন কথা বলার সময় নয়। -তাহলে আগামী কাল? -না, আমি ইতেকাফ থেকে বের হওয়ার আগে নয়। এখানে অতি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া অন্য কিছু বলা ঠিক নয়। -তাহলে কি বিয়ের কথা স্থগিত থাকবে? -না, তার প্রয়োজন হবে না। আমি তোমার ব্যাপারে বিস্তারিত শুনেছি। আবদুল্লাহর আম্মুর সাথে পরামর্শও করেছি। আবদুল্লাহর পীড়াপীড়িতে আমরা রাজি হয়েছি, এখানে সম্পর্ক করার ব্যাপারে। এখন হল পাত্রী দেখার বিষয়। এটা সুন্নত এবং তোমার অধিকার। সেটার ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছি। মসজিদ থেকে ঘরে ফিরে এলাম। আমি যদিও ধর্ম সম্পর্কে খুবই কম জানতাম। গত কয়দিনে যা জেনেছিলাম, একজনের কাছে শুনেছিলাম মা হাফেযা হলে, সন্তানদের হাফেয হওয়াটা সহজ হয়। কথাটা শোনার পর থেকেই আমার খুবই আগ্রহ হলো একজন হাফেযাকে বিয়ে করার। আমি অবদুল্লাহ ভাইয়ের কাছে তার বোনের হেফযের বিষয়টা জানতে চাইতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। তারপরও দ্বিধা সরিয়ে বললাম: -আপনার বোন কি কুরআন কারীম হিফয করেছেন? -আরে কুরআন হিফয করাটাই আসল ব্যাপার নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজের জীবনে ইসলামের বাস্তবায়ন করা। -আমি বুঝতে পারলাম না, তার এ কথা শুনে খুশি হবো না কি বেজার হবো। আমাকে একটা সুন্দর করে সাজানো কামরায় বসানে হলো। একটু পরে আবদুল্লাহ ভাই তার বোনকে সাথে করে নিয়ে এলেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। দু’জন মুখোমুখি একটা বড় টেবিলে বসলাম। আমি কেন যেন খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমার লজ্জা দেখে আমি নিজেই অবাক। আমি একটা মেয়ের সামনে লজ্জা পাচ্ছি? ওকে মানে আয়েশাকে দেখলাম আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আবদুল্লাহ ভাই বললেন: -আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন। এটা তো লজ্জা সময় নয়। আপনার কিছু জানার থাকলে আয়েশাকে প্রশ্ন করুন। আমার কিছুই মন আসছিলো না। আজকে পাত্রী দেখা হবে সেটাই তো আমার জানা ছিলো না। আর পাত্রী দেখতে গিয়ে একটা মানুষকে ভর্তি পরীক্ষার মতো নানা প্রশ্নে নাজেহাল করা, যোগ্যতা যাচাই করার জন্য নানারকমের অপমানজনক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়াটা আমি চরমভাবে ঘৃণা করি। মাথাটাকে পুরোপুরি ফাঁকা মনে হলো। সাহস সঞ্চয় করে জানতে চাইলাম: -আপনি কুরআন কারীম কতটুকু মুখস্থ করেছেন? -আমার আমপারা মুখস্থ আছে। আমি আর কোনও কথা খুঁজে পেলাম না। অনুমতি নিয়ে বের হয়ে এলাম। পরদিন ঢাকা ফিরে এলাম। পাত্রী দেখে বের হওয়ার পর, আবদুল্লাহ ভাই বলে দিয়েছিলেন, বিয়ের ব্যপারে আমাদের চূড়ান্ত মতামতটা ফোনে জানালেই হবে। আমি বলেছিলাম: -আমরা দু’জন কি একাকী একবার কথা বলতে পারি, বা কোথাও একদিন বাইরে ঘুরতে বের হলাম? -না, এটা শরীয়ত অনুমোদন করবে না। আর আয়েশাও এতে রাজি হবে না। -তাহলে ফোনে তো কথা বলা যাবে? -না সেটাও প্রয়োজন ছাড়া জায়েয নেই। আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে সেটা আমাকে বলবেন, আমি জানিয়ে দিবো। চাইলে আয়েশার সাথে কথাও বলিয়ে দেবো। আমি বললাম: -আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ঢাকা গিয়ে আব্বু-আম্মুকে জানাই। তারপর মুরুব্বিদের কেউ হয়ত আনুষ্ঠানিকভাবে দেখতে আসবেন। -কেন আপনার কি পাত্রী পছন্দ হয় নি? পাত্রের দেখাটাই তো চূড়ান্ত। তবুও আপনি মুরুব্বীস্থানীয় কাউকে নিয়ে আসতে পারেন। আসার সময় কোনও আয়োজন করে আসার দরকার নেই। ওনারা দেখার পর যদি পছন্দ করেন, তাহলে ওই দিনই বিয়ে হয়ে যাবে। আমাদের ইচ্ছা, বিয়ের আয়োজন আর খরচ যত কম করা ততই ভাল। হাদীসে আছে: যে বিয়েতে খরচ যত কম হবে, সে বিয়ে তত বেশি বরকতময় হবে। আসুন ঘুমিয়ে পড়ি। ভোররাতে সেহেরি খেতে হবে। আবার আব্বুর সাথে কিয়ামুল লাইল মানে তাহাজ্জুদের জামাতে যোগ দিতে হবে। -একটা কথা, আমি জানি হুযুরদের বাড়িতে টিভি থাকে না। আপনাদের বাড়িতেও কি এ জাতীয় কিছু নেই? ঘরের মহিলারা সময় কাটায় কিভাবে? -না নেই। ভাগ্যিস! আপনি এই প্রশ্ন আয়েশাকে করেন নি। ওকে এ ধরনের প্রশ্ন করলে, আপনার সাথে বিয়েতে রাজিই হতো না! আমি ওকে বলেছি, আপনি আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাবলীগে গিয়ে খুবই ভালো হয়ে গিয়েছেন। আর সময় কাটানোর কথা বলছেন? সময় কিভাবে যে কাটে সেটা আপনাকে বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের ঘরটা বলতে গেলে একটা চব্বিশ ঘণ্টার মাদরাসা। আম্মু, ভাইবোন সবাই গ্রামের মহিলাদেরকে পালাক্রমে কিছু না কিছু তা’লীম দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। আমি বাসায় এসে জানালাম। আব্বু-আম্মু দু’জনেই বেঁকে বসলেন। আব্বু তো এক কথায় জানিয়ে দিলেন: -আমি বাপু কোথাও যেতে পারবো না। তোমার জন্য এই মেয়ে উপযুক্ত হবে বলেও মনে হচ্ছে না। তোমার জন্য তোমার চাচাত বোন নাজিয়াই উপযুক্ত। প্রাথমিক কথাবার্তাও এক প্রকার হয়ে আছে। আমি বারবার এখানে বিয়ে করার প্রতি আগ্রহ দেখালাম। শেষে আব্বু বললেন: -ঠিক আছে, তোমার আম্মু আর ছোট মামাকে নিয়ে যাও। তবে জেনে রাখ, যারা বিয়ের আগেই খরচ কমানোর ফন্দিফিকিরে থাকে, তাদের সাথে সম্বন্ধ করা কতটা যৌক্তিক, সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমরা পাত্রী দেখতে এলাম। আয়েশাকে দেখে, তাদের বাড়ির অবস্থা দেখে আম্মু খুবই মুগ্ধ হলেন। যদিও বললেন: -এরা একটু বেশিই ধার্মিক। তুই হজম করতে পারবি কিনা সেটা তোর ব্যাপার। ছোট মামা বললেন: -ভাগ্নে! এদের আন্তরিকতা, আতিথেয়তা সবই ভাল কিন্তু ব্যাপারটা মনে হচ্ছে কচুপাতা আর পানি। -মানে? -মানে আমাদের সাথে মিল হবে কিনা বুঝতে পারছি না। আম্মুর কাছে জানতে চাইলাম: -আম্মু! কুরআন কারীম হিফযের ব্যাপারে কিছু জানতে চেয়েছিলে? -ইশ রে! একদম ভুলে গেছি। কিন্তু ছোট বোনকে একটা কথা বলতে শুনেছি। কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। -কী কথা? -নাওরা! রাতে কিন্তু সূরা মায়িদার মুশাবাহার আয়াতগুলো আমার সাথে ধরাধরি করতে হবে। আর একজন আরেকজনকে পুরো সূরাটা মুখস্থ শোনাবো। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। মুশাবাহার আয়াত মানে কী? আর সূরা মায়েদা তো বোধহয় আমপারায় নেই। শুরুর দিকে আছে বোধহয়। কিন্তু আমাকে তো বলেছে, সে আমপারা মুখস্থ করেছে। তাহলে কি আম্মুকে দেখানোর জন্য এ কথা বলেছে? কী জানি! এ ধরনের লোকদেখানো ব্যাপার তো তাদের মধ্যে থাকার কথা নয়। আরো কয়েকটা বিষয়ে আমার মনে খটকা সৃষ্টি হলো, আবদুল্লাহ ভাইয়ের আব্বু ছোট মামাকে বলে দিয়েছেন: -আপনারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন। আমরা কাজটা ফেলে রাখতে চাচ্ছি না। আর বারবার দেখাশোনাও আমাদের পছন্দ নয়। আমরা বলেছিলাম পরেরবার আসলে, যদি পছন্দ হয়, তাহলে আকদটা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনারা বলছেন, পরে জানাবেন। আমরা বলেছিলাম, আমাদের এখানে কোনও আয়োজন হবে না। বড় ধরনের খাবার-দাবারের অয়োজনও হবে না। কিন্তু আপনারা বলছেন, অনেক মেহমান নিয়ে আসবেন। এই বিষয়গুলো আপনারা আগে ঠিক করুন। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম: -আম্মু! তাদের এত তাড়াহুড়ো করার কারণ কী? -তোর আব্বুকে জিজ্ঞেস কর। আব্বু তো এমনিতেই এখানে সম্বন্ধ করার প্রতি আগ্রহ দেখান নি। শুধু আমার আগ্রহ আর আম্মুর উচ্ছ্বাস দেখেই চুপচাপ আছেন। তার কাছে আমার খটকাগুলোর কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন: -আরে আমি তো আগেই বলেছিলাম। ভেতরে কোনও ঘাপলা আছে। না হলে এত তাড়াহুড়ো কিসের? -আমার মনে হয়, ভাল কাজে দেরী করতে নেই। এজন্যই তারা কাজটা দ্রুত সেরে ফেলতে চাচ্ছেন। আবদুল্লাহ ভাইয়ের আব্বা তো বলেছেনই, বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর দেরি করা ঠিক নয়। -আমি তো এতে ভাল কিছু দেখি না। -কিন্তু আমি তো তাদের মধ্যে সরাসরি খারাপ কিছু দেখিনি। তারা খুবই ধার্মিক। তাদের এসব আচরণ বোধহয় তাদের ভালোভাবে ধর্মপালনেরই একটা অংশ। -ধর্ম পালন মানে কি হাসি-আনন্দ থেকেই বঞ্চিত করা। কি জানি বাপু! এখন তো নবীর যুগ নেই। যুগের দাবি বলেও তো একটা কথা আছে। আমি আর আব্বুর সাথে কথা বাড়ালাম না। আমি ধরে নিলাম এসব কিছু তাদের ধার্মিকতার অংশ। আম্মুর আগ্রহে বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকা হয়ে গেল। কয়দিন পর বিয়েও হয়ে গেল। আমাদের দু’জনের দ্বিতীয়বার দেখা হল বাসর রাতে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে আয়েশা খুবই ক্লান্ত ছিলো। আমি কামরায় প্রবেশ করে সালাম দিলাম। সে সালামের উত্তর দিলো। দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। সে কিছুক্ষণ পর বললো: -আমার কপালের চুলে হাত এই দু‘আটা পড়ুন। সে আমাকে একটা দু‘আ শিখিয়ে দিলো। আমিও তার মুখে মুখে দু‘আ পড়লাম। দু‘আর পরই আমার আর তর সইছিলো না, তাকে জিজ্ঞেস করলাম: -আচ্ছা! বলো তো আয়েশা! তুমি কুরআন কারীম কতটুকু মুখস্থ করেছো? -আল হামদুলিল্লাহ! পুরোটা। -কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, শুধু আমপারাটাই তোমার মুখস্থ আছে। -আমি মিথ্যা বলিনি। সেদিন আমার ত্রিশ পারা শোনানোর দিন ছিলো। সেজন্য পারাটা আমি ভালোভাবে মুখস্থ করেছিলাম। আর নিজেকে আগে বেড়ে হাফেযা বলে পরিচয় দিতে আমার ভাল লাগে না। আজকের রাতটা তো রাগ করার রাত নয়। আমার কথায় রাগ হলে ক্ষমা চাইছি। আসুন, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে বলেছেন: -(আর তোমরা অন্বেষণ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে রেখেছেন: সূরা বাকারা: ১৮৭)। এভাবে হাসি-আনন্দে আমাদের বিয়ের প্রথম মাস কেটে গেছে। আয়েশা এই একটা মাস যেন আমার জন্য তার সবকিছু কুরবান করে দিয়েছিলো। আমি জেনেছিলাম, তারা তাদের বাড়িতে সবাই তাহাজ্জুদ নামায পড়ে, নিয়মিত দীর্ঘ সময় কুরআন তিলাওয়াত করে। নফল নামাজ পড়ে। কিন্তু এই এক মাসে তাকে এসবের কিছুই করতে দেখিনি। সে সারাক্ষণই কিসে আমি খুশি হবো, কী করলে আমার ভাল লাগবে, কোন শাড়িটা পড়লে তাকে বেশি সুন্দর লাগবে, সেলোয়ার কামিসের কোন সেটটা আমার পছন্দ, চুল কিভাবে বাঁধলে আমি খুশি হবো,এ নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। সে আমাকে প্রায় জেরা করে করে জেনে নিল, আমি কী পছন্দ করি, কোন খাবারটা আমার বেশি প্রিয়, কোন পোশাক আমি বেশি পরতে ভালোবাসি, কোন রঙ আমার পছন্দ, কোন সুবাসটা আমার ভালো লাগে, আমার প্রিয় মানুষ কারা। আমার জীবনের যাবতীয় ভালো লাগা আর পছন্দের বিষয়গুলো সে খুটে খুটে জেনে নিল। আমি অবাক হতাম, সে কঠিন পর্দার মধ্যে থেকেও কিভাবে এত সুন্দর করে সাজতে শিখলো! আর এত সুন্দর আচরণই বা কিভাবে শিখলো? রসকষহীন ধমীয় পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেও সে কিভাবে এমন রুচিশীল হলো? বয়েস কত অল্প, কিন্তু তার আচার-আচরণ কী পরিণত! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আয়েশা আমাদের ঘরটাকে ঠিক আমার থেকে সংগ্রহ করা, তথ্যানুসারেই সাজাল। ঘরের পর্দার রঙ বদলে গেলো। খাবার রান্নার ধরন না বদলালেও, স্বাদ বদলে গেলো। যে আব্বু তার কথা শুনতেই চাইতেন না, তাকে পর্যন্ত সে কিভাবে যেন পোষ মানিয়ে ফেলল। আম্মু তো তাকে আগেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন। আম্মুর কোন মেয়ে না থাকাতে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়ে গিয়েছিলো। একমাস পরে আমি অবার অফিসে যেতে শুরু করে দিলাম। এই একমাসে সে কখনো ভুলেও তার বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলেনি। এমনিতেই ফোনে সব সময় মায়ের সাথে কথা বলতো। আমাদের অফিসের কাজে আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হলো। দশ-পনেরদিন থাকতে হবে। বিদায় নিয়ে চলে এলাম কাফকোতে। কর্ণফুলি সার কারখানায়। এখানে একটা ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য। চট্টগ্রামের কাজ শেষ হলে, আমি চুপিচুপি ঢাকা ফিরে এলাম। আব্বু-আম্মু বাসায় নেই। তারা সিলেটে গিয়েছেন। বাসায় শুধু কাজের বুয়া আর আয়েশা। আবদুল্লাহ ভাইও মাঝেমধ্যে এসে দেখা করে যান। বাসায় পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। বাসার কারো ঘুম না ভাঙানোর জন্য, আমি কলিং বেল না বাজিয়ে, চুপিচুপি চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলাম। পুরো ঘরটা নিরব। একেবারে ভেতরে চলে গেলাম। দরজাটা আবজানো। ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ভেতরের দৃশ্যটা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল। আয়েশা জায়ানামাযে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে আর কী একটা দু‘আ পড়ছে, বারবার পড়ছে। সে কিভাবে যেন টের পেয়ে গেল, কামরায় কেউ প্রবেশ করেছে। তাড়াতাড়ি নামায শেষ করলো। সালাম ফিরিয়ে আমাকে দেখে যেন সে আকাশের চাঁদ হাতে পেল। আমার হাতটা এমনভাবে চেপে ধরল যেন আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি। বাকি রাত আমরা কথা বলেই কাটিয়ে দিলাম। রাতও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিলো। সে অনুযোগ করে বললো: -আপনি আসবেন আমাকে আগে জানান নি কেন? -তোমাকে চমকে দেয়ার জন্য এমনটা করেছি। -কিন্তু নবীজি (সা.) বলেছেন: -তোমাদের কেউ সফর থেকে ফিরে এলে, সে যেন রাতের বেলায় দরজায় টোকা না দেয়, যাতে করে স্ত্রীরা প্রয়োজনীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিতে পারে। -আচ্ছা! ভুল হয়ে গেছে। তুমি এমন করে কেঁদে কেঁদে দু‘আ করছিলো কেন? কোনও সমস্যা হয়েছে? -না, সমস্যা হবে কেন? আর আল্লাহর কাছে কি শুধু সমস্যা হলেই দু‘আ করতে হয়? সব সময়ই তার কাছে দু‘আ করাই তো বান্দার উচিত। -কই তোমাকে তো বিয়ের পর এক মাস কোনও অতিরিক্ত নামায-কালাম করতে দেখিনি। -আমি নামায-কালাম করি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে। আপনি কাছে থাকলে, আপনার সন্তুষ্টি, আপনার খিদমতই আমার জন্য আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। -আয়েশা! -কী বলুন! -আমার একটা বিষয় খুবই অবাক লেগেছে। তুমি কিন্তু এই পর্যন্ত একবারও তোমার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলো নি। তোমার আগের কথা মনে পড়ে না? মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? -খুব ইচ্ছে করে। সব সময় ইচ্ছে করে। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর ঘরই স্ত্রীর নিজের ঘর। আর বিয়ের পর আপনিই আমার মুরুব্বি। আমর সবকিছুর দায়-দায়িত্ব আপনার ওপর। আমার কখন বাপের বাড়ি যাওয়া দরকার সেটা আপনিই ভালো বুঝবেন। আমি শুধু শুধু কেন আগে বেড়ে আপনাকে বিব্রত করতে যাবো? আবীর তার গল্প শেষ করে বলল: -এবার তোরাই বল, এমন একটা ফিরিশতার পাশে থেকে আমি কী করে আগের মতো দুষ্ট থাকি? কিভাবে রাতজেগে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই? কিভাবে আগের মতো বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেরাই? বেগানা নারীদের সাথে নিয়ে পাহাড় ডিঙাতে বের হই? আর এমন একটা মানুষের জন্য, সবকিছু উজাড় করে দিতে মন চায় কিনা তোরাই বল!(সংগ্রহীত) লেখাটি পাঠিয়েছেন- হলুদ পাখি (ছদ্ম নাম)
সংবাদ শিরোনাম
এমন বৌ কে না চায়
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০১:৫৭:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ নভেম্বর ২০১৫
- ৩৪০ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ