ঢাকা ০১:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মহররম উৎসব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯
  • ২৭৫ বার

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯: হাওরের সংস্কৃতি থেকে লোকজ নানা উৎসব ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। হাওরের বিভিন্ন এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট দিনে এক সময় মেলা বসতো। এসব  মেলায় সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রা দল আসতো, বসতো নাগরদোলা। নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাওরের সংস্কৃতির সোনালী অতীতের সাক্ষী হয়ে এখনও টিকে রয়েছে অষ্টগ্রামের মহররম উৎসব। হাওরের মানুষ সাংস্কৃতিক আবহে ধর্মীয় এ অনুষ্ঠানটি পালনের জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকেন।

প্রতি বছর পহেলা মহররম থেকে ১২ই মহররম পর্যন্ত অষ্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে যেসব আচার অনুষ্ঠান ও শোক পালন করা হয়, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহররম অনুষ্ঠানের মতো নয়। এটি শিয়াদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অষ্টগ্রামে যারা এ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত তারা সবাই সুন্নী মুসলমান। তাছাড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে অংশ নেন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সাড়ম্বরে মহররম উৎসব উদযাপনের তোড়জোড় চলছে।

অষ্টগ্রামের দেওয়ানবাড়ি বা আঞ্চলিক উচারণে হাবেলী বাড়িকে কেন্দ্র করেই মহররম অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। রেওয়াজ অনুযায়ী মহররমের চাঁদ দেখার আগের রাত থেকেই হাবেলী বাড়ির ইমামবারাকে রঙ-বেরঙের কাগজ ও কাপড়ের ছোট বড় অসংখ্য পতাকায় সাজানো হয়। চাঁদ দেখার পরদিন থেকে আশুরার আগের দিন পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলে জারি গান, শিরনী তৈরি ও বিতরণ, দরগায় তাবুত তৈরি, বাড়ি বাড়ি তাজিয়া তৈরি আর বাদ্য বাজনা সহযোগে মাতম জারি পরিবেশন। অপরদিকে পাল ও মালাকার সম্প্রদায় দুলদুল বা মাটির ঘোড়া ও কাগজের বোরাক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ৯ই মহররম পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলতে থাকে প্রস্তুতিপর্ব। ১০ই মহররম হয় মূল অনুষ্ঠান।

অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই একটি করে মহররমের স্থায়ী দরগা দেখা যায়। দরগাগুলো সাধারণত উঁচু স্থানে মাটি ভরাট করে অনেকটা বেদীর মতো তৈরি করা হয়। অষ্টগ্রামের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে উঁচু একটি মাঠ। এ মাঠটিই কারবালা নামে পরিচিত। আশুরার রাত থেকে পরদিন রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিটি দরগার সামনে চলে শোক ও মাতম জারি। প্রতিটি পরিবারেই তৈরি করা হয় মহররমের বিশেষ শিরনী।

জারিয়াল দল বড় বড় দা, লাঠি, বল্লম, লেজা, তরবারি, বর্শা, ঢাল ও বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, সানাই ইত্যাদি বাদ্য বাজনাসহ শোক ও মাতম জারি গাইতে গাইতে মহল্লা প্রদক্ষিণ করে। রাত ৮টা থেকে মহল্লা প্রধানের নেতৃত্বে এ দলগুলো মিছিল সহকারে যায় হাবেলী বাড়িতে। প্রতিটি দল ইমামবারা ও স্থানীয় মাজারটি একবার প্রদক্ষিণ করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে জারি গান গায়। পরদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হয় তাবুত ও দুলদুল মিছিল, লক্ষ্য কারবালা ময়দান। সন্ধ্যায় শোক, মাতম ও জারি গান হয়। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে সবাই সেখানে জমায়েত হয় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত চলে তাবুত, দুলদুল, তাজিয়া উৎসর্গ এবং মাতম জারি গান।

১০ই মহররমের পরে ১১ই মহররম সকাল ৯টা থেকে মহিলা জারিয়াল দল ও গ্রামের সাধারণ মহিলাদের সমাবেশে কারবালা ময়দানটি জমজমাট হয়ে উঠে। ১২ই মহররম সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে সম্মিলিত মাতম ও জারি। এভাবেই শেষ হয় অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মহররম উৎসব।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মহররম উৎসব

আপডেট টাইম : ১০:০৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯: হাওরের সংস্কৃতি থেকে লোকজ নানা উৎসব ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। হাওরের বিভিন্ন এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট দিনে এক সময় মেলা বসতো। এসব  মেলায় সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রা দল আসতো, বসতো নাগরদোলা। নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাওরের সংস্কৃতির সোনালী অতীতের সাক্ষী হয়ে এখনও টিকে রয়েছে অষ্টগ্রামের মহররম উৎসব। হাওরের মানুষ সাংস্কৃতিক আবহে ধর্মীয় এ অনুষ্ঠানটি পালনের জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকেন।

প্রতি বছর পহেলা মহররম থেকে ১২ই মহররম পর্যন্ত অষ্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে যেসব আচার অনুষ্ঠান ও শোক পালন করা হয়, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহররম অনুষ্ঠানের মতো নয়। এটি শিয়াদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অষ্টগ্রামে যারা এ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত তারা সবাই সুন্নী মুসলমান। তাছাড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে অংশ নেন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সাড়ম্বরে মহররম উৎসব উদযাপনের তোড়জোড় চলছে।

অষ্টগ্রামের দেওয়ানবাড়ি বা আঞ্চলিক উচারণে হাবেলী বাড়িকে কেন্দ্র করেই মহররম অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। রেওয়াজ অনুযায়ী মহররমের চাঁদ দেখার আগের রাত থেকেই হাবেলী বাড়ির ইমামবারাকে রঙ-বেরঙের কাগজ ও কাপড়ের ছোট বড় অসংখ্য পতাকায় সাজানো হয়। চাঁদ দেখার পরদিন থেকে আশুরার আগের দিন পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলে জারি গান, শিরনী তৈরি ও বিতরণ, দরগায় তাবুত তৈরি, বাড়ি বাড়ি তাজিয়া তৈরি আর বাদ্য বাজনা সহযোগে মাতম জারি পরিবেশন। অপরদিকে পাল ও মালাকার সম্প্রদায় দুলদুল বা মাটির ঘোড়া ও কাগজের বোরাক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ৯ই মহররম পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে চলতে থাকে প্রস্তুতিপর্ব। ১০ই মহররম হয় মূল অনুষ্ঠান।

অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই একটি করে মহররমের স্থায়ী দরগা দেখা যায়। দরগাগুলো সাধারণত উঁচু স্থানে মাটি ভরাট করে অনেকটা বেদীর মতো তৈরি করা হয়। অষ্টগ্রামের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে উঁচু একটি মাঠ। এ মাঠটিই কারবালা নামে পরিচিত। আশুরার রাত থেকে পরদিন রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিটি দরগার সামনে চলে শোক ও মাতম জারি। প্রতিটি পরিবারেই তৈরি করা হয় মহররমের বিশেষ শিরনী।

জারিয়াল দল বড় বড় দা, লাঠি, বল্লম, লেজা, তরবারি, বর্শা, ঢাল ও বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, সানাই ইত্যাদি বাদ্য বাজনাসহ শোক ও মাতম জারি গাইতে গাইতে মহল্লা প্রদক্ষিণ করে। রাত ৮টা থেকে মহল্লা প্রধানের নেতৃত্বে এ দলগুলো মিছিল সহকারে যায় হাবেলী বাড়িতে। প্রতিটি দল ইমামবারা ও স্থানীয় মাজারটি একবার প্রদক্ষিণ করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে জারি গান গায়। পরদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হয় তাবুত ও দুলদুল মিছিল, লক্ষ্য কারবালা ময়দান। সন্ধ্যায় শোক, মাতম ও জারি গান হয়। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে সবাই সেখানে জমায়েত হয় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত চলে তাবুত, দুলদুল, তাজিয়া উৎসর্গ এবং মাতম জারি গান।

১০ই মহররমের পরে ১১ই মহররম সকাল ৯টা থেকে মহিলা জারিয়াল দল ও গ্রামের সাধারণ মহিলাদের সমাবেশে কারবালা ময়দানটি জমজমাট হয়ে উঠে। ১২ই মহররম সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে সম্মিলিত মাতম ও জারি। এভাবেই শেষ হয় অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মহররম উৎসব।