হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতি বছর যখন বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট ফিরে আসে, স্মৃতির পাতায় তখন অনেক কথা ভেসে ওঠে। যে নেতা জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হূদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই, একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরকেই হতে হবে’; যে নেতা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ সামনে নিয়ে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে, মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহত্তর স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেন, সর্বোপরি যে নেতার জন্ম না হলে এই দেশ স্বাধীন হতো না, গভীর পরিতাপের বিষয় সেই নেতাকেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তারই প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে বুলেটের নির্মম আঘাতে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট একটি কালো দিন—‘জাতীয় শোক দিবস’। যে নেতার হূদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশের মানুষ। তার হূদয়ের মণিকোঠায় সব সময় বাংলাদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অবস্থান। যাদের মুক্তির জন্য তিনি জীবনের প্রায় ১৩টি বছর পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। আমার দুর্লভ সৌভাগ্য সেই মহান নেতার সান্নিধ্যে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বারবার মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই দিনগুলোর কথা, যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলায় ফাঁসি দেবার চেষ্টা করেছিল। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে সেই মামলার আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেছিলাম।
সেদিনের তুমুল গণ-আন্দোলনের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির কথা উঠেছিল। প্যারোলে মুক্তিদান প্রসঙ্গে সেদিন শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্যারোলে মুক্তি নিতে নিষেধ করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদানে স্বৈরশাসকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সংগ্রামী ছাত্রজনতার গণবিস্ফোরণেই তিনি ‘মুক্তমানব’ হিসেবে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে গণনায়ক শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম।
মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন এবং বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি-‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচন’, ‘এক মাথা এক ভোট’ এবং ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন’-আদায় করেন। বঙ্গবন্ধুর আদায়কৃত দাবি অনুযায়ী তথাকথিত ‘সংখ্যাসাম্য’ বাতিল হয় এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনে সংখ্যাগুরু হিসেবে আমরা জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসন লাভ করি। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফাকে সামনে রেখে আসন্ন নির্বাচনকে গণভোট তথা রেফারেন্ডামে পরিণত করেন। ঐতিহাসিক ’৭০-এর এই নির্বাচনে আমার মতো পাড়াগাঁয়ের এক অখ্যাত ছেলে, সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করেছি—আমাকে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই।
দেশ স্বাধীন করেই বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব শেষ করেননি। দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই, রাস্তা-ঘাট-পুল-কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত। যোগাযোগ-ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্লেন, স্টিমার, কিছুই নেই। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো শত্রুবাহিনী ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তারই একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র সাত মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন।
সংবিধান বলবত্ হওয়ার পর গণপরিষদ ভেঙে জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকার গঠন করেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তিনি ছিলেন মর্যাদাশালী নেতা। যে কারণে তার দক্ষ ও দূরদর্শিতায় স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পায়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের দিনগুলির কথা। সফরসঙ্গী হিসেবে কাছে থেকে দেখেছি প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর।
প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন। সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রাজভবনে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ’৭২-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি চাই ১৭ মার্চ আমার জন্মদিনে আপনি বাংলাদেশ সফর করুন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যাবার আগে আমার অনুরোধ, আপনি আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করবেন।’ ’৭২-এর ১৭ মার্চ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং ১২ মার্চ বিদায়ি কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহূত হয়েছিল।
তারপর ১ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া আমাদের সার্বিক সমর্থন যুগিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্ব-সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পোদগর্নি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো-ক্রেমলিনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেখেছি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো প্রটোকল ভঙ্গ করে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
কারণ সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আর মার্শাল টিটো প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়ায়। সেখানে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য-স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবে প্রায় দেশই বিভিন্ন সম্মেলনে উপস্থিত থেকে তিনি রেখেছিলেন তার সরব উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর ও প্রশংসনীয় নেতৃত্ব।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডনে বিদেশি সাংবাদিকগণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি যে বাংলাদেশে যাবেন, আপনার বাংলাদেশ তো যুদ্ধবিধ্বস্ত-ধ্বংসস্তূপ। কিছুই নেই।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বাংলার মাটি ও মানুষ যদি থাকে, তবে এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই একদিন আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় পরিণত করব।’ আজ বাংলাদেশের যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, তার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর হাতেই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন গঠন এবং তার নির্দেশেই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল।
আজ যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উেক্ষপণ করা হয়েছে, তারও ভিত্তি স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু ’৭৫-এ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। এই সময়ে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। ’৭৪-’৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উত্পাদিত হয়, যা ’৭৩-’৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি।
বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতির পিতা বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশটাকে যখন স্বাভাবিক করেছিলেন এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেঈমান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জানত, পুরো পরিবারটি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অংশ। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনি চক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন। আমরা সেদিন আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা পতাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির—যে অর্থনৈতিক মুক্তি বঙ্গবন্ধু সমাপ্ত করতে পারেন নাই—দায়িত্বভার গ্রহণ করে, নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে আজ তিনি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে, অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্যমুক্ত, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি