হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিছুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে দুই বাংলাতেই তোপের মুখে পড়েন জি বাংলার ‘সা রে গা মা পা’ অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় রানারআপ হওয়া গোপালগঞ্জের ছেলে মাইনুল আহসান নোবেল। তবে নোবেল তো শুধু একটা মন্তব্যই করেছেন। এর আগে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তি জাতীয় সংগীত বদলেই ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়ে এতটা সমালোচনা হয়নি, যতটা হয়েছে নোবেলকে নিয়ে।
মোশতাক আহমেদ
জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় মোশতাক সরকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়া-ফারুক-ডালিম চক্র খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসান। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে। কমিটিকে ‘এক মাসের মধ্যে পরিবর্তিত জাতীয় সংগীত’ প্রস্তাব করতে বলা হয়। দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি তিনটি বৈঠক করে। তারা কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ থেকে যেকোনো একটি জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
জিয়াউর রহমান
মোশতাকের পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতের জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’
প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগ থমকে যায়।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত পাল্টে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তবে এর তেমন কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চতুর্থ দফা উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়। ২০০২ সালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে দুজন যৌথভাবে বলেন, ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন।’
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িতপ্রাাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি ‘অতি গুরত্বপূর্ণ’ বলে সচিবের কাছে পাঠান। সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠান। ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর এই সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।