হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিবন্ধী লিপন, লিপিকা, শিমুল আপন ৩ ভাইবোন। ছোটবেলায় প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে খেলতো দৌড়াদৌড়ি করতো। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত রোগে তারা পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত হয়ে আজ শয্যাশায়ী। ৩ প্রতিবন্ধী ভাইবোনের মধ্যে ভাই লিপন দাস সকলের বড়, মেজো লিপিকা দাস আর সবার ছোট শিমুল দাস। তাদের মধ্যে লিপন দাসের এক পায়ে তেমন একটা শক্তি নেই। তার হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডান পায়ের অংশ ক্রমেই সরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট গ্রুপের একটি গ্রুপের ওষুধ না খেলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। শরীর কেঁপে কেঁপে মাটিতে পড়ে যান। ওষুধ সেবনের পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলতে পারেন। তবে পিচ্ছিল অথবা উঁচু নিচু পথে চলা তার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। এমন অবস্থাতেই তাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে।
পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে শারীরিক অক্ষমতার মধ্যদিয়েও তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। একটি ইঞ্জিনচালিত ভ্যান কিনে গ্রামের হাটখোলা থেকে মোবারকগঞ্জ চিনিকল গেট পর্যন্ত যাত্রী বহনের কাজ করেন। এখান থেকে যে পয়সা রোজগার হয় তা দিয়ে সংসারের প্রতিবন্ধী ভাইবোন স্ত্রী-সন্তানের ৬ সদস্যের সংসার চালান। ছোটভাই শিমুল দাস চিকন দুটি পায়ে ভর দিয়ে মাত্র ২০-৩০ গজ হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মাঝ পথে কয়েকবার আছড়ে পড়তে হয়। আর বোন লিপিকা দাসের বিছানা থেকে সোজা হয়ে বসার শক্তি নেই। এভাবে বিগত ১৮ বছর ধরে রয়েছে শয্যাশায়ী। তারা ৩ ভাইবোন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সিঙ্গী গ্রামের মৃত মনোরঞ্জন দাসের সন্তান। চিকিৎসার অভাব শারীরিক অক্ষমতা আর সাংসারিক অনটনে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরজমিন ৩ ভাইবোনের ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সিঙ্গী গ্রামের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, বাঁশের খুঁটির গাছের ডালপালা দিয়ে চারপাশ ঘেরা মাটি থেকে একটু উঁচু মেঝের পাশাপাশি দুটি ঝুপড়ি ঘর। একটিতে থাকে বড়ভাই আর অন্যটিতে শিমুল আর লিপিকা। বড়ভাই লিপন শয্যাশায়ী না হলেও লিপিকা আর শিমুলের অবস্থা করুণ। দেখা যায় এ ঝুপড়ি ঘরটির মধ্যে ছেঁড়া ময়লা পোশাকে প্রতিবন্ধী ভাইবোন সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। ময়লা আবর্জনা আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তাদের আরো রোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
লিপন দাস জানান, ভাইবোনের মধ্যে তিনি সকলের বড়। ছোটবেলায় তারা সবাই সুস্থ ছিলেন। কিশোর বয়সে হলেই শুরু হয় তাদের অসুস্থতা। প্রথমে হাত এবং পায়ের শিরার সমস্যা দেখা দেয়। পরে এক সময়ে দুর্বল হয়ে পড়ে হাত পায়ে শক্তি কমে হাত পায়ের নিচের অংশ থেকে চিকন হতে শুরু করে। এ পর্যায়ে পঙ্গু হয়ে যায়। তিনি বলেন, একদিন তিনি নিজেও সুস্থ ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন ডান পায়ে শক্তি কমে যাওয়া অনুভব করলেন। পরে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর চিকিৎসার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করার পরও সুস্থ হতে পারলেন না। চিকিৎসকরা বললেন শিরার সমস্যা এ রোগ থেকে একেবারে মুক্তি পাওয়া কঠিন ব্যাপার। তারপরও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে পারলে চলাফেরা করার সক্ষমতা থাকবে।
একদিকে ঘরে রয়েছে আরও অসুস্থ দুটি ভাইবোন। তাদেরও ডাক্তার দেখাতে হবে। আবার সংসারে অভাবের তাণ্ডব সব দিক মিলে নিজের আর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো হয়নি। এখন প্রতিদিন নির্দিষ্ট একজাতীয় ট্যাবলেট না খেলে পর দিন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। তখন সংসারের সকলকে অনাহারে দিন কাটাতে হবে। ফলে তাকে শুয়ে থাকা চলবে না। যত কষ্টই হোক ভ্যানে যাত্রীবহনের জন্য রাস্তায় বের হতেই হবে। ৩ ভাইবোনের সম্পদ বলতে বাবার হতে পাওয়া মাত্র ৪ শতক বসতভিটেই তাদের একমাত্র সম্বল।
বড় ভাই লিপন আরো জানান, এক পা ল্যাংড়া দেখেও আজ থেকে ১৮ বছর আগে মমতা রানী দাস তাকে বিয়ে করেন। বর্তমানে তাদের জয় ও জয়ন্তি নামের ২ শিশু সন্তান রয়েছে। মমতা গৃহস্থালির কাজে পাশাপাশি বাড়িতে সেলাই মেশিনে কাজ করে সংসারে সহযোগিতা করেন। এছাড়াও বড় ভাবি হিসেবে প্রতিবন্ধী লিপিকা ও শিমুলের প্রতিও বেশ আন্তরিক। ওই গ্রামের বাসিন্দা মঞ্জুরুল ইসলাম লিতু জানান, নোংরা পরিবেশে থেকে যেভাবে এরা ২ ভাইবোন কষ্ট করে তা অবর্ণনীয়।
তিনি বলেন, আরেক ভাই নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধী ২ ভাইবোন ও পরিবারের জন্য ভ্যান নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছেন। তিনি বলেন, তারা যেভাবে মানবেতর জীবনযাপন করে তা কল্পনা করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলমগীর হোসেন জানান, সিঙ্গী গ্রামের লিপনেরা ৩ ভাইবোন শারীরিক প্রতিবন্ধী। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। তারা বিনা চিকিৎসায় অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে। ইতিমধ্যে শিমুল ও লিপিকাকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে। আগামীতে লিপনেরও জন্যও একটি ভাতার ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দেন।