হাওর বার্তা ডেস্কঃ বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যার মূল হোতা সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড ছিল শীর্ষ ইয়াবাকারবারি। রাজনৈতিক ও পুলিশ প্রশাসনের প্রশ্রয়ে এলাকার ছিঁচকে চোর থেকে স্বল্প সময়েই ভয়ঙ্কর ‘ইয়াবা ডন’ হয়ে উঠে নয়ন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের সঙ্গে নয়ন বন্ডের ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক সুনাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার এমপি পিতার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়েই একটি মহল এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বরগুনা শহরে কান পাতলেই ভেসে আসে মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের নাম। অনেক মাদককারবারির সঙ্গেই সুনামের ওঠবসের চিত্র পাওয়া যায়। নয়ন বন্ডও ছিল সুনামের লোক। সুনামের চাচাতো শ্যালক অভিজিত তালুকদারের সঙ্গেও নয়নের যাতায়াত ছিল সুনামের অফিস-বাসায়।
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিপুল মাদকসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় নয়ন। ওই একই রাতে পুলিশ অভিযান চালায় কলেজ রোডে সুনাম দেবনাথের প্রতিষ্ঠান সুনাম দেবনাথ ব্লাড ফাউন্ডেশনের অফিসে। পুলিশ যখন ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল, তখন পেছন দিয়ে পালিয়ে যায় দুই-তিনজন।
স্থানীয়রা জানান, নিহত রিফাত শরীফও মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছিল। রিফাত হত্যার পর আলোচনায় আসে নয়ন বন্ডের ‘০০৭ গ্রুপ’ ও ‘টিম সিক্সটি’ নামের দুটি গ্রুপ। টিম সিক্সটির প্রধান হচ্ছে মঞ্জুরুল আলম জন। জনের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদকের পাইকারি বাণিজ্যের অভিযোগ।
জনের বাবা রইসুল আলম রিপন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এই নয়ন ও জনের সঙ্গে সুনামের অনেক ঘনিষ্ঠ ছবি রয়েছে। সুনামের ছত্রছায়ায় এভাবেই ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যান নয়ন।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নয়ন বন্ডের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। সাব্বির আহমেদ থেকে নয়ন বন্ড হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছে বরগুনার রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসন। এ দুটির প্রশ্রয়েই ছিঁচকে চোর থেকে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে উঠেন নয়ন বন্ড। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে- প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও স্থানীয়রা সেটি মানতে নারাজ। তারা বলছেন, নয়ন বন্ডকে ‘মেরে ফেলা’ হয়েছে। নয়ন গ্রেফতার হলে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যেত- এ কারণেই তাকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় পুলিশের অনেক অসাধু কর্মকর্তার কুর্কীতিও সামনে চলে আসত নয়ন বেঁচে থাকলে।
স্থানীয়রা বলছেন, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সঙ্গে পূর্ব সম্পর্কের জেরে নয়ন বন্ড রিফাত শরীফকে খুন করেছে এটি যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য হচ্ছে- নয়নের ‘বন্ড’ হয়ে উঠার পেছনে রাজনীতিবিদরাই দায়ী।
অন্য অপরাধীর মতো নয়নের উত্থানটাও ছিল বেশ চমকের। নয়নের একসময়ের সহপাঠীরা জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে সুনাম দেবনাথ ও থানার কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার আশকারায় সাব্বির আহমেদ থেকে নয়ন বন্ড হয়ে উঠে সে।
নয়নের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর স্থানীয় এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ এবং তার চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে নয়নের সখ্য গড়ে ওঠে। অভিজিৎ ও নয়ন একসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তখন বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়া ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।
তাদের আশ্রয়ে ছিঁচকে চোর থেকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হয়ে উঠে নয়ন। মাদক, নারী, অবৈধ টাকা এসবের সঙ্গে ছিল তার নিত্য আনাগোনা। নিজের বাংলোয় (বিশেষ কক্ষ) ডেকে নিয়ে বহু তরুণীর সর্বনাশ করেছে নয়ন। নারীর পাশাপাশি মাদক নেশায়ও বুঁদ হয়ে পড়েছিল নয়ন।
সন্ত্রাসের পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসায় ছিল তার বড় ভাগ। এসব অপরাধের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে এলাকার নেতৃত্বাস্থানীয়দের নজরে চলে নয়ন। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে এলাকার রাজনৈতিক মহলের। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও নয়নের ওঠবস ছিল চোখে পড়ার মতো।
নয়নের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূর হোসেন জানান, বাবার মৃত্যুর কিছু দিন পর প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। এর পর নয়ন গাঁজা সেবন শুরু করেন। ২০১১ সালে মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই সে ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন মাদকের টাকা জোগাতে মানুষের মুঠোফোন, গহনা ছিনিয়ে নেয়ার মতো ছিঁচকে অপরাধ শুরু করে।
মাদকের টাকার জন্য নয়নের এমন অপরাধ দিন দিন বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচটি মামলা হয়। ভুক্তভোগীরা তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে নয়নের বিষয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন। নয়নও তখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে শুরু করেন। একপর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরাদ হোসেইনের হাত ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়।
নয়নের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর সুনাম দেবনাথ এবং তার চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে নয়নের সখ্য গড়ে ওঠে। অভিজিৎ ও নয়ন একসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় তখন বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়া ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।
হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘০০৭ লাইসেন্স’র নায়কের নামানুসারে নিজের নামের সঙ্গে ‘বন্ড’ যুক্ত করে নয়ন। এর পর সিনেমাটির গল্পের আদলে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী।
নয়নের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, নয়নের ঘরে সাদা দেয়ালে লাল রঙ দিয়ে এক জায়গায় লেখা ০০৭ (নয়নের সন্ত্রাসী গ্রুপের সাংকেতিক নাম)।
প্রসঙ্গত ‘০০৭ লাইসেন্স’ একটি বিখ্যাত হলিউড সিনেমা সিরিজ। সিনেমার মৌলিক গল্প অনুযায়ী ০০৭ হচ্ছে মানুষ হত্যার লাইসেন্স। এতে যিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, তার নাম জেমস বন্ড।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, এই ছবি দেখে নয়ন বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় এর পর নিজেকে ‘০০৭ লাইসেন্স’ সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের নামের সঙ্গে নিজেই যুক্ত করে দেয় ‘বন্ড’ শব্দটি এবং একই সঙ্গে গড়ে তোলেন ০০৭ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী। এই বাহিনী নয়নের হুকুমে চলত। তার নির্দেশমতো অপকর্ম করে বেড়াত।
পুলিশের সঙ্গে ছিল নয়নের নিত্য ওঠবস। শহরের বাসিন্দারা এমনও বলছেন, নয়ন চাইলে যে কাউকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি বা গ্রেফতার করাতে পারত। নয়ন কাজ করত পুলিশের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে।
সন্ত্রাসের পাশাপাশি নারী নেশায় বুঁদ ছিল নয়ন। নয়ন বন্ডের হাতে ঠিক কতজন তরুণীর সর্বনাশ হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই পুলিশের কাছেও। তবে নয়নের ‘বিশেষ কক্ষ’ থেকে উদ্ধার একটি ল্যাপটপে বহু পর্নো ভিডিও পাওয়া গেছে।
কয়েকটি আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পর্নো ভিডিওতে নয়ন বন্ডের সঙ্গে একাধিক তরুণীর বিশেষ মুহূর্তের দৃশ্য রয়েছে। একেক দিন একেক তরুণী নিয়ে সে যে ফুর্তিতে মেতে উঠেছিল তা স্পষ্ট।
পুলিশের সূত্র বলছে, নয়ন বন্ডের ওই বিশেষ কক্ষের গোপন জায়গায় সুকৌশলে আইপি ক্যামেরা (ইন্টারনেট ক্যামেরা) বসানো থাকত।
বিশেষ উদ্দেশে নয়ন বন্ড যাদের ওই কক্ষে আনতেন তারা কেউ ক্যামেরার অস্তিত্ব টের পেতেন না। একবার নয়নের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার পর ওই মেয়ের আর রক্ষা ছিল না।
ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বারবার কিশোরী-তরুণীদের ব্যবহার করত সে। অনেক তরুণী নয়নের হাত থেকে বাঁচতে কলেজ ছাড়তে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন।
অনেকে আবার নয়নের চাহিদামতো মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের হাতে এমন অন্তত ১২ তরুণীর তথ্য আছে বলে জানা গেছে।
নয়ন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কে বা কারা এসব ভিডিও ছড়াচ্ছে তার সন্ধান করতে পারেনি পুলিশ।
নয়ন বন্ডের বাড়ি বরগুনা শহরের ডিকেপি রোডের মাঝ বরাবর একটি সরু গলির শেষ প্রান্তে। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা খালি।
বাড়ি নির্মাণের জন্য সম্প্রতি সেখানে অনেক ইট এনে রাখা হয়েছে। নয়নের বাড়ির মূল দরজার পাশেই একটা ছোট্ট বৈঠক ঘর। নয়ন সেখানেই থাকত। গভীর রাত পর্যন্ত ঘরের দরজা খোলা থাকত। সারা দিন এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরির পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরত।
রাত ১২টার পর তার কক্ষে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যেত। আসতেন পুলিশের সদস্যরাও। প্রতিবেশীরা বলছেন, পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা নয়নকে ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেছে। শহরের অনেকেই মাদকের সঙ্গে যুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের চেনে- জানে। কিন্তু কেউ-ই মুখ খুলতে নারাজ।
শহরের বাজার রোডের আরেক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, নয়নের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত অনেক তরুণীকে পরে পুলিশের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত হওয়ার কথা শোনা গেছে। বিনিময়ে পুলিশের উদ্ধার করা মাদকের ভাগ পেত নয়ন।
এ বিষয়ে সুনাম দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতি করি, বহু মানুষের সঙ্গেই ছবি আছে। তার মানে কি এই যে, তারা চোর হলে আমিও চোর? খবরের কাগজগুলোতে আমার সম্পর্কে যেসব লেখা হচ্ছে তা দেখছি প্রতিদিন। আমার বিষয়ে লেখা হচ্ছে- ‘জানা গেছে’, ‘শোনা গেছে’, ‘একটি সূত্র বলেছে’ এসব। আরে ভাই সূত্রটা কে, তা লিখুন। সাংবাদিকতা তো এখন অনেকদূর এগিয়েছে।
তাহলে জানা গেছে, শোনা গেছে কেন? আমার কোন ভবনে পুলিশি তল্লাশি হয়নি। অভিযোগ থাকলে প্রমাণসহ লিখুন। সঠিক প্রমাণ দিতে পারলে আমি নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেব। সবাই জানে যে আমার বাবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে। তারা আমাদের রাজনীতি ধ্বংস করতে চায়। তারাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। বারবার বলা হচ্ছে কতিপয় ছাত্রলীগ নেতার সংবাদ সম্মেলনের কথা।
ওই সম্মেলনেও কি এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউ দিতে পেরেছে যে, আমি মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত? সংবাদপত্রের মতো একটি মহান প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই সংবাদ প্রকাশ করবে বলে আমি আশা করি।
মাদকের অভিযোগ নিয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হাসান বলেন, ‘যেভাবে মাদকের বিস্তারের কথা বলা হচ্ছে পরিস্থিতি আসলে ততটা ভয়াবহ নয়। তাছাড়া আমরাও প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। ২০১৮ সালে ৬৯৪টি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৮২৫ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১১ হাজারের বেশি। মাদক প্রতিরোধে প্রতিনিয়তই কাজ করছি আমরা। আর এক্ষেত্রে কোনো মহলের তদবির বা পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তারেরও কোনো ঘটনা নেই।’