হাওর বার্তা ডেস্কঃ পীর ফার্সি শব্দ। আরবিতে এটাকে বলা হয় মুরশিদ। অর্থ হলো পথপ্রদর্শক। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ এবং আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থায় চলার পথনির্দেশ করেন। এমনিভাবে মুরিদ শব্দটিও আরবি। অর্থ হলো ইচ্ছা পোষণকারী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ এবং আল্লাহ তায়ালা যেভাবে চান সেভাবে তার আদেশ-নিষেধ পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোনো হক্কানি বুজুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করেন। সুতরাং পীর হবেন শরিয়তের আদেশ-নিষেধ পালন করার প্রশিক্ষণদাতা। আর যিনি সে প্রশিক্ষণ নিতে চান, সেই শিক্ষার্থীর নাম হলো ‘মুরিদ’।
তাই যে ব্যক্তি নিজেই শরিয়তের বিধান অমান্য করে, নামাজ পড়ে না, পর্দা করে না, সতর ঢেকে রাখে না বা শরিয়তের আবশ্যকীয় কোন বিধি-বিধানই পালন করে না, সে ব্যক্তি কিছুতেই পীর তথা মুর্শিদ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কারণ স্পষ্ট, যার নিজের মাঝেই শরিয়ত নেই, সে কীভাবে অন্যকে শরিয়তের ওপর আমল করা প্রশিক্ষণ দেবে বা দেয়ার অধিকার রাখবে। সে নিজেই তো প্রশিক্ষিত নয়। লক্ষণীয় যে, পীর-মুরিদির এ পদ্ধতি রাসুল (সা.) থেকেই চলে আসছে। রাসুল (সা.) সাহাবাদের আল্লাহমুখী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতেন। সাহাবারা রাসুল (সা.) এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতেন।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর, আর সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাক।’ (সূরা তওবা : ১১৯)। উপরিউক্ত আয়াতে কারিমায় স্পষ্টভাবে বুজুর্গদের সাহচর্যে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপর আরেক আয়াতে এসেছে যাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা নিয়ামত দিয়েছেন, তারা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককার বান্দা। (সূরা নিসা : ৬৯)। এ তিন আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককার বান্দারা এবং তাদের পথই সরল, সঠিক তথা সিরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ তাদের অনুসরণ করলেই সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা হয়ে যাবে।
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সৎসঙ্গ আর অসৎসঙ্গের উদাহরণ হচ্ছে মেশক বহনকারী আর আগুনের পাত্রে ফুঁকদানকারীর মতো। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তুমি নিজে কিছু কিনবে। আর যে ব্যক্তি আগুনের পাত্রে ফুঁক দেয় সে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে, অথবা ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না।’ (বোখারি : ৫২১৪, মুসলিম, হাদিস : ৬৮৬০, মুসনাদুল বাযযার : ৩১৯০, আবু দাউদ : ৪৮৩১)। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আজ পির-মুরিদির ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ির শেষ নেই। এ ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলুম দেওবন্দের’ ভারতের শায়খুল হাদিস মাওলানা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি আমাদের সহিহ বোখারির প্রথম খ- পাঠদানের সময় আলোচনার সূত্র ধরে বলেন, বর্তমান সময়ে পীর-মুরিদির অবস্থা খুবই মারাত্মক।
একবাক্যে বলা যেতে পারে, এখনকার পীর-মুরিদ মানেই হলো দোকানদারি। আজকাল এসবের নামে চলছে সর্বত্র রমরমা বিজনেস। সত্যিকার পীর বা বুজুর্র্গ পাওয়া আজকাল খুবই দুষ্কর বিষয়। লক্ষণীয় যে, জান্নাতে যাওয়ার জন্য কারও মুরিদ হওয়া শর্ত নয়, তবে জান্নাতের উঁচু মর্যাদার অধিকারী হতে হলে অবশ্যই কোনো না কোনো খাঁটি আল্লাহর ওলির কাছে মুরিদ হওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা বলে, ‘যে কোনো পীরের কাছে মুরিদ হওয়া ফরজ, যার পীর নেই তার পীর হলো শয়তান’ এটা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস, এ মতবাদের কোনো ভিত্তি নেই।
এসব কথা মনগড়া বৈ কিছুই নয়। কারণ, কয়েকজন সাহাবায়ে কেরাম ছাড়া সব সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.) এর কাছে বায়াতে সুলুক হননি। আবার যারা বলে, ‘ইসলামে পীর-মুরিদির কোন অস্তিত্ব নেই’ তাদের কথাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ, কিছু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.) এর হাতে বায়াত হয়েছেন সেটা কোরআন-হাদিস দ্বারা অবশ্যই প্রমাণিত। তাই তো এক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অভিমত হলো, মুরিদ হওয়া ওয়াজিব (অত্যাবশ্যক) নয় বরং বড়জোর সুন্নতে মুস্তাহাব্বাহ।
হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, কারও কাছে বায়াত হওয়া সুন্নত (মুস্তাহাব), ওয়াজিব নয়। (কিফায়াতুল মুফতি : খ- ২, পৃষ্ঠা ৮০)। মাওলানা মুফতি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) বলেন, মুরিদ হওয়া ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব। (ফাতাওয়া রশিদিয়া-পৃষ্ঠা ২০২)। মুফতিয়ে আযম মাওলানা কিফায়তুল্লাহ (রহ.) বলেন, প্রচলিত ধারায় কোনো শায়খের কাছে বায়াত হওয়া আবশ্যক নয়, বড়জোর মুস্তাহাব। (কিফায়াতুল মুফতি : খ- ২, পৃষ্ঠা ৮৫)।