হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনা এখন নতুন মাদক সাম্রাজ্য। ইয়াবার বড় চালান সমুদ্রপথে দেশে ঢুকে বরগুনায় খালাস হয়। এখান থেকেই বিভিন্ন পথে ঢাকাসহ সারা দেশে পাঠানো হয় ইয়াবার চালান। এ কারণেই বরগুনায় তৈরি হচ্ছে নতুন মাফিয়া চক্র। এলাকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথই এই চক্রের নিয়ন্ত্রক বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বরগুনা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবাই এ এলাকার প্রধান মাদক। তুলনামূলক কম দামেই বরগুনার শহর-গ্রামে ইয়াবা মেলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ হত্যার পেছনেও ইয়াবাই দায়ী। তারা বলছেন, ইয়াবার কারণে নানা ধরনের অপরাধ বেড়েছে। এখানে ইয়াবার সহজলভ্যতা যেভাবে হয়েছে, কদিন পর তা টেকনাফকেও হার মানাবে। কেউ কেউ বরগুনাকে ‘নিউ টেকনাফ’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথই নতুন রুটের ইয়াবা কারবারিদের নিয়ন্ত্রক। স্থানীয় পর্যায়ে ইয়াবা কারবারিরাও তার ঘনিষ্ঠ। রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অন্তত সাত আসামি ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নয়ন বন্ডসহ এসব আসামি সুনামের প্রশ্রয়ে নানা ধরনের অপরাধ করে বেড়াত।
চলতি বছর ২ এপ্রিল ঢাকায় বরগুনা থেকে আসা লঞ্চ সপ্তবর্ণা-১ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৮ লাখ ৪৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতার তিন আসামি তুহিন, সবুজ ও শাহজাহান র্যাবকে জানিয়েছেন, চার-পাঁচ মাস পর পর পাঁচ-সাত লাখ ইয়াবা ঢাকায় নিয়ে আসেন তারা। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান মাছধরার ট্রলারে কক্সবাজার থেকে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী ও বরগুনায় আসে। এর পর সেখান থেকে লঞ্চে করে বাহক দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। এ ছাড়া আশপাশের জেলায় সড়কপথেও ইয়াবার চালান পাঠানো হয়। ইয়াবা পাচার ও পরিবহনের সঙ্গে বরগুনার ট্রলার মালিকদের একটি অংশও জড়িত বলে গ্রেফতার আসামিরা র্যাবকে জানিয়েছেন। এর পর থেকেই মূলত ইয়াবার নতুন রুট হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো নজরে এসেছে।
২৪ জুলাই বরগুনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও এলাকার মাদক সমস্যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। সভায় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুর রশিদ বলেন, বরগুনা এখন মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। যেখানে-সেখানে ইয়াবা-গাঁজা পাওয়া যাচ্ছে। এ এলাকা দিয়ে এখন ইয়াবার বড় চালানও আসছে। মাদকের কারণে নানা অপরাধ বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
তাই দ্রুত মাদক সমস্যা নির্মূল করতে হবে। জানতে চাইলে বরগুনা প্রেস ক্লাব সভাপতি ও খেলাঘর জাতীয় কমিটির সহসভাপতি চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, গত কয়েক বছরে এলাকায় মাদকের সমস্যা অনেক বেড়েছে। এলাকার তরুণসমাজ মাদকে আসক্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বরগুনায় এখন যেখানে-সেখানে ইয়াবা পাওয়া যায়। এটা রোধ করতে হবে। নয় তো একসময় টেকনাফকেও হার মানাবে বরগুনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, তালতলীর শুভসন্ধ্যা ও টেংরাগিরিচর হয়ে ইয়াবার বড় চালান ঢুকছে বরগুনায়। বরগুনা থেকেই সড়ক ও নৌপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে ইয়াবা। খুচরা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কিছু অংশ বরগুনায়ও বিক্রি হয়। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বরগুনার অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর শ্বশুরবাড়ি টেকনাফে। টেনাফের ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে তারাই সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেন।
পাথরঘাটায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কাজ করেন এমন এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সব ট্রলার এ কাজে জড়িত নয়। কিছু ট্রলার ইয়াবার চালান আনার জন্যই তৈরি হয়েছে। মাছ নিয়ে অন্য ট্রলারগুলো আসার আগেই ওই ট্রলারগুলো চলে আসে। আবার কখনো কখনো অনেক দেরি করে আসে। তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশকে ম্যানেজ করেই তারা এসব করে। তাই আমরাও এ বিষয়ে কথা বলি না।’ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কাজ করা এই ব্যক্তি জানান, বরগুনা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের লোকজন এসব কাজে জড়িত। মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের কাছে জানতে চাইলে তিনি এমন অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধে থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে। তিনি সুনাম দেবনাথের লোক। তাই তাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
সুনামের লোকজনের হাতে বিশেষ ট্যাটু : স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সুনাম দেবনাথের সহযোগীদের প্রত্যক্ষ মদদ থাকায় উঠতি ইয়াবা কারবারিদের কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। তাদের বক্তব্যের প্রমাণ দিয়ে এক তরুণ জানান, নয়ন বন্ডের বাঁ হাতে কব্জির নিচে ট্যাটু আঁকা ছিল। অন্য আসামি রিফাত ফরাজী ও সাগরের হাতে একই ট্যাটু দেখা গেছে। একই ট্যাটু আঁকা আছে সুনামের শ্যালক শাওন তালুকদারের হাতেও। এই ট্যাটু তাদের রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করত বলে অভিযোগ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা শহরের মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের দুই সহযোগী মঞ্জুরুল আলম জন ও শাওন তালুকদার। বরগুনা সরকারি কলেজের ভিতরে ও পাশে রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয়ন বন্ড চক্র ইয়াবা বিক্রি করত। শহরের সদর রোডের দায়িত্বে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হায়দার। তানভীর নিজেও মাদকে আসক্ত। তানভীরের ফেনসিডিল সেবনের ছবি গনমাধ্যমের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের সঙ্গে কয়েকজন ইয়াবা কারবারির ছবিও রয়েছে গনমাধ্যমের কাছে।
স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সুনাম দেবনাথ ও শাওন সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ সদস্য টাক রাসেলের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে। তাদের ঘনিষ্ঠ আরেকজন ব্রাঞ্চ রোডের মাওলা মীরের ছেলে অয়ন মীর প্রায় দুই বছর ধরে এলাকাছাড়া। আমতলীতে দেড় হাজার বোতলের একটি ফেনসিডিল চালান ধরা পড়লে অয়নের নাম উঠে আসে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সূত্র জানান, নয়ন, রিফাত ফরাজী ছাড়াও সুনামের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মুসার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে।
ইয়াবার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে মঞ্জুরুল আলম জন ও সুনাম দেবনাথের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। রিফাত হত্যার কয়েক দিন পর থেকেই এলাকাছাড়া জন। আর এলাকায় থাকলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেন না সুনাম দেবনাথ। তার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করে এবং এসএমএস দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।