বিশ্ব ক্রিকেটের নতুন রাজা ইংল্যান্ড

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এমন কিছুর জন্য কি ক্রিকেট বিশ্ব প্রস্তুত ছিল? মোটেও না! বিশ্বকাপের আগের এগারো আসরের ফাইনালে একটি ম্যাচও টাই হয়নি।

শুধু ফাইনালে কেন? বিশ্বকাপে টাই হয়েছে কয়টি? হাতে গোনা চারটি। দ্বাদশ আসরের ফাইনাল পেল সবকিছু। লর্ডসে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ হলো টাই। ক্রিকেট বিশ্ব প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে এমন ফাইনাল দেখল। যেখানে ক্রিকেটের জনকরা হলো রাজা।

রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, উল্লাস সবকিছু ছিল। প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ডে স্নায়ু উঠা-নামা করছিল। শেষ বল পর্যন্ত বলা যাচ্ছিল না কারা জিতবে ফাইনাল।

লর্ডসের ৩০ হাজার আর ট্রাফেল স্কোয়ারের সামনে এক লাখ দর্শকের কন্ঠে ‘গো অন ইংল্যান্ড’। সৃষ্টিকর্তা আজ তাদের কথা শুনল। তাইতো প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের ৪৪ বছর পর শিরোপার আক্ষেপ ঘুচল তাদের। অবশ্য ৯২’র পর তারা এবারই প্রথম ফাইনাল খেলল। গ্রাহাম গুচ, ইয়ান বোথামরা যা পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন স্টোকস, বাটলার, আর্চাররা।

নিউজিল্যান্ডের করা ২৪১ রানের জবাবে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ওই রানই করেছিল স্বাগতিকরা। ১০০ ওভার শেষেও কেউ সুযোগ হাতছাড়া করেননি, কেউ হারার আগে ম্যাচ ছাড়েনি, কেউ অবহেলা করেনি একটি বল, একটি ক্যাচ, একটি ফিল্ডিং।  চাইলে বেন স্টোকস ইনিংসের শেষ ফুলটস বলটি তুলে মারতে পারতেন। কিন্তু বড় মঞ্চের তারকার মনে হয়েছে ওই এক রানই তার কাছে যথেষ্ট! দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে অবশ্য রান আউট হয়েছেন কিন্তু ম্যাচ তো টেনে নিতে পেরেছেন টাইয়ে।

আবার ম্যাচ তো তাদের টাই হওয়ারও কথা ছিল না। যদি না বাই থেকে ওই অতিরিক্ত চার রান পেত। শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১৫ রান লাগত ইংল্যান্ডের।  প্রথম দুই ডট বলের পর তৃতীয় বলে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা হাঁকান স্টোকস। চতুর্থ বল ব্যাটে লাগিয়ে দৌড়ে দুই রান।  গাপটিল থ্রো করেছিলেন ঠিকমতোই।  কিন্তু বল স্টোকসের শরীরে আঘাত করে বেরিয়ে যায় বাউন্ডারির দিকে। ওখানে যোগ হয় আরো ৪ রান, মোট ৬ রান।  শেষ ২ বলে ২ রান নিতে পারেন স্টোকস। ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।

ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম সুপার ওভার। ট্রেন্ট বোল্টের সুপার ওভার থেকে ১৫ রান তুলেছিলেন স্টোকস-বাটলার। আর্চারের বলে নিশাম ছক্কা মেরে জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষটা আর রাঙানো হয়নি। শেষ বলে জয়ের জন্য ২ রান প্রয়োজন। গাপটিল ডিপ স্কয়ারে বল পাঠিয়ে এক রান নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জেসন রয়ের বাজে থ্রোতেও বল দারুণ দক্ষতায় গ্লাভসবন্দি করে উইকেট ভাঙেন বাটলার। শুরু হয়ে যায় উল্লাস। পুরো দল একদিকে, আর্চার একদিকে। তাতে কী, বিশ্বকাপের শিরোপা তো উঠছে তাদের হাতেই।

সুপার ওভারও টাই হলেও ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য জিতেছে ইংল্যান্ড। সুপার ওভারসহ ইংলিশদের বাউন্ডারি ছিল মোট ২৬টি, নিউজিল্যান্ডের ১৭টি।

২০ বছর পর লর্ডসে ফাইনাল। কিন্তু এবারের ফাইনালকে মেলাতে হবে ২৩ বছর আগের ফাইনালের সঙ্গে। লাহোরে অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা ফাইনালে আগে ব্যাটিং করে ২৪১ রান তুলেছিল মার্ক টেলরের দল। ডি সিলভার শতক আর গুরুসিংহার ব্যাটে সহজেই জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলে সিংহের দল। রোববার লর্ডসে আগে ব্যাটিং করতে নেমে ৮ উইকেটে সমান ২৪১ রান তোলে নিউজিল্যান্ড। শিরোপা জয়ের দিনে ইংল্যান্ডের কোনো ব্যাটসম্যান হতে পারেননি ডি সিলভা কিংবা গুরুসিংহা। তবে তাদের একজন স্টোকস ছিলেন। যিনি ৯৮ বলে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে ইংলিশদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জয়ের আশা দেখিয়ে গেছেন। শেষ হাসিটা তাই স্টোকসের প্রাপ্য।

মেঘলা আবহাওয়ার সঙ্গে প্রচন্ড বাতাস। সাত সকালের কন্ডিশন দেখে যেকোনো দলই আগে বোলিং নিতে চাইবে। কিন্তু কেন উইলিয়ামসন হাঁটলেন উল্টো পথে। ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবাক করলেন সবাইকে। অবশ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য যে জেদ ও চ্যালেঞ্জ থাকার দরকার, তা কিন্তু দেখিয়েছেন। আবার ‘ভয়ের’ কারণেও হতে পারে। বিশ্বকাপে যারা ছয়বার তিনশ রান তুলেছে তাদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে বিপদ টেনে লাভ কী!

গতবার বিশ্বকাপে ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়া গাপটিল এ বিশ্বকাপে ফ্লপ। মনে হচ্ছিল বড় ম্যাচের বড় তারকা হয়ে ফাইনালে জ্বলবেন। সেই পথেই ছিলেন। তেড়েফুঁড়ে প্রথম বল চালালেন কিন্তু ব্যাট-বলে হয়নি। পঞ্চম বলে পেয়ে যান প্রথম বাউন্ডারি। চতুর্থ ওভারে জোফরা আর্চারকে ছক্কা-চার মেরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ওকসের বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে বল মিস করে এলবিডব্লিউ হন ১৯ রানে। ২০১৫ সালে ৫৪৭ রান করেও দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি। এবার মাত্র ১৮৬ রান করলেন।

নিউজিল্যান্ডকে অল্পরানে আটকে দেওয়ার নেপথ্যে ছিল উইলিয়ামসনকে থামিয়ে দেওয়া। কাজটা করেছিলেন প্লাঙ্কেট। কিন্তু পুরো দিনে তিনটি ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়া ধর্মাসেনা এবারও বেঁকে বসেন। ডানহাতি পেসারের আবেদন ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীতে মরগান রিভিউ নিয়ে সফল হন। দ্বিতীয় উইকেটে উইলিয়ামসনের সঙ্গে ৭৪ রানের জুটি গড়া হেনরি নিকোলস হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি।

মাঝের ওভারগুলোতে রানের চাকা থামিয়ে রাখা প্লাঙ্কেটের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন ৫৫ রানে।  নিউজিল্যান্ডের মধ্যভাগের ভরসার নাম রস টেলর। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপের ম্যাচে নিষ্প্রভ থেকে গেলেন। অবশ্য ৩১ বলে ১৫ রানে আউট হওয়ার দায়টা টেলর দিতে পারেন ধর্মসেনাকে। মার্ক উডের শর্ট বাউন্স বলে এলবিডব্লিউ দিয়ে তাকে সাজঘরে পাঠান লঙ্কান বিশ্বকাপ জয়ী খেলোয়াড়।

টেলর ফেরার পর নিউজিল্যান্ডের ইনিংস বড় হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবুও নিশাম ২২ গজে নেমে দ্রুত ৩ চার মেরে আশার প্রদ্বীপ জ্বালিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে টিকতে দেননি প্লাঙ্কেট।  ডানহাতি পেসার নিজের তৃতীয় উইকেট শিকার করেন। গ্র্যান্ডহোম হাত খুলে মেরে খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে আউট হন ১৬ রানে।  ৪৯তম ওভার পর্যন্ত ক্রিজে ছিলেন টম ল্যাথাম। কিন্তু তার ৪৭ রানের ইনিংসটি কাটা পড়ে ওকসের স্লোয়ারে। শেষ পর্যন্ত ২৪১ রানে থামে কিউইদের ইনিংস।

বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের পেসাররা ছিলেন দুর্দান্ত। শুরুতে রান থামিয়ে রাখেন ওকস, আর্চার। মাঝে আদিল রশিদ ও প্লাঙ্কেট রানের গতি বাড়তে দেয়নি। আর শেষটা তো আর্চার রাঙিয়েছেন নিজের মতো করে।  প্লাঙ্কেট ৪২ রানে পেয়েছেন ৩ উইকেট।  আর্চার একই রানে ১ উইকেট।  ওকস ৩৭ রানে নিয়েছেন ৩টি।
দুই ওপেনার জেসন রয় ও জনি বেয়ারস্টো ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সবথেকে শক্তির জায়গা। বিশ্বকাপেই তাদের চারটি শতক জুটি, ১৬০, ১২৮, ১২৪ ও ১২৩।  তাদের থেকে আজও এমন ব্যাটিং চাচ্ছিল দল।  শুরুটা মন্দ করেননি দুজন। রয় ৩টি এবং বেয়ারস্টো ১ বাউন্ডারি মেরে নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ এলোমেলো করা শুরু করেছিলেন মাত্র।  কিন্তু হেনরির উত্তর জানা ছিল। রয়কে ১৭ রানে থামিয়ে ইংলিশ শিবিরে প্রথম আঘাতটি করেন তিনি।

এরপর শুরু হয় কিউইদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং। একটা সময় ইংল্যান্ডের রানের চাকা প্রায় থেমেই গিয়েছিল। ধারাবাহিক রান রেট বাড়তে থাকে। তাতে বাড়ছিল চাপ। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে উইকেট তুলে নিতে শুরু করেন বোলাররা। শুরুটা জো রুটকে দিয়ে। স্লো মিডিয়াম বোলার গ্র্যান্ডহোমের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ৩০ বলে ৭ রান করা রুট। বেয়ারস্টো ৫৫ বলে ৩৬ করে ফেরেন ফার্গুসনের আগুনে বোলিংয়ে বোল্ড হয়ে।  অধিনায়ক মরগান হতাশ করেন সবাইকে।  নিশামের বলে তেড়েফুঁড়ে শট খেলতে গিয়ে ফার্গুসনের অসাধারণ ক্যাচে পরিণত হন মাত্র ৯ রানে।  ৮৬ রান তুলেই চার ইংলিশ ব্যাটসম্যান সাজঘরে।

খাদের কিনারা থাকা দলকে পঞ্চম উইকেটে টেনে তোলেন বেন স্টোকস ও জস বাটলার। তাদের ১১০ রানের জুটিতে ম্যাচে ফেরে ইংলিশরা। দুজনই পেয়ে যান হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু নিউজিল্যান্ড তো ছাড়ার পাত্র নয়। ৬০ বলে ৫৯ রান করা বাটলারকে ফেরান ফার্গুসন। এরপর ওকস (২), প্লাঙ্কেট (১০) একই পথ ধরেন। কিন্তু স্টোকস তো ছিলেন। অপ্রতিরোধ্য এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের হার না মনোবলই ইংল্যান্ডকে দিয়েছে শিরোপা।

ঐশ্বর্য, ঐতিহ্য, আভিজাত্য সবই ছিল ইংরেজদের। বিলাসবহুল একেকটি স্থাপনা মনে করিয়ে দেয় ক্রিকেটের প্রতি তাদের নিবেদনের কথা। এত কিছু যাদের আছে, তাদের একটি বিশ্বকাপের শিরোপা থাকবে না, তা কি করে হয়! আগের এগারো আসরে হয়নি, এবার তো হলো। এখন বুক উচিঁয়ে তারা বলতে পারবে, আমরা ক্রিকেটের রাজা।  এক সময় তারা বিশ্ব শাসন করত। এখন তারা ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর