ঢাকা ০৯:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৯২ বছর বয়সেও সাইকেল চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন বৃদ্ধা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:২২:১৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০১৯
  • ২৫৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। শ্রম, মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। এরই মধ্যে দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জি কর্মকাণ্ডে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে তারা। এই ধারাবাহিকতা এখন শুধু শহরে নয় উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামেও যুক্ত আছেন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও মানব সেবায়। নানা রকম যুদ্ধ পাড়ি দিয়ে একমাত্র নিজের সাহসিকতায় অনেক নারীর সফলতার গল্প আমরা শুনেছি। তবে আজ জানাবো অন্যরকম এক গল্প।

গ্রামের সবাই যাকে চিনেন নানী নামে। তিনি হলেন জহিরন বেওয়া। বয়স ৯২ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু মনের উদ্যমতা, সাহসিকতা, কর্মের দক্ষতা-সখ্যতা কমেনি তার। স্থায়ীয় এমপিও কারো কাছে অপরিচিত হলেও গ্রামের সবার কাছে নানী জহিরন বেওয়া এক পরিচিত নাম।

৯২ বছর (তার দাবি) বয়সী জহিরন বেওয়া লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউপির সীমান্তবর্তী গ্রাম তালুক দুলালীর মৃত সায়েদ আলীর স্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর আগে স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়া এ সংগ্রামী নারী তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার সংগ্রাম শুরু করেন। আট বছর আগে বড় ছেলে দানেশ আলী ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করায় ভেঙ্গে পড়েন জহিরন বেওয়া। ছোট ছেলে তোরাব আলীর (৫৯) সংসারে এই সংগ্রামী নারী এখনো সচল, সজাগ আর কর্ম উদ্যামী হয়ে বেঁচে আছেন।

দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সংসারে অভাব-অনাটন ছিল প্রতিক্ষণের চিন্তা। সমাজের কথা উপেক্ষা করে ১৯৬৮ সালে জহিরন পরিবার পরিবল্পনার অধিন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষযে চয়মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহন করে চুক্তিভিত্তিক মাসিক মজুরিতে কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মে যোগ দেন। নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতেন। ২শ’ থেকে ৩শ’ অবশেষে ৫শ’ টাকা মাসিক মজুরিতে ১০ বছর চাকরি করে অবসরে যান জহিরন। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি।

জহিরন বেওয়া সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি শুধু সাধারণ রোগ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, বমি শারীরিক দুর্বলতাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। চিকিৎসার জন্য আমাকে কোনো অর্থ দিতে হয় না, তবে আমি বাজারমূল্যে তাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টাকা আয় হয়।

তিনি আরো বলেন, আদিতমারী উপজেলার ৩০টি গ্রামে প্রায় দুই হাজারের বেশি পরিবারের সঙ্গে রয়েছে আমার যোগাযোগ। আমি প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে কমপক্ষে সাতটি গ্রামের ৭০টি বাড়িতে যাই এবং তাদের খোঁজখবর নিই। এমনটি দাবি করে জহিরন বেওয়া জানান, গত ৫০ বছরে তিনি কোনো রোগে আক্রান্ত হননি।

আদিতমারীর গ্রামবাসীরা জানান, গত ৪৫ থেকে ৫০ বছর ধরে জহিরন বেওয়াকে দেখছি তিনি সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ কোনো অসুখ-বিসুখ হলে আমরা তার কাছেই চিকিৎসা নিই। আর তিনি কখনোই আমাদের কাছে টাকা নেননি। মাঝে মধ্যে ওষুধও বিনামূল্যে দেন।

তারা জানান, উনি এখন গ্রামের সবার জাতীয় নানী। সবাই তাকে নানী বলেই ডাকে, হয়তো ছেলে দেখলে তাকে নানী বলে ডাক দেয়, ছেলের বাবাও দেখলে নানী বলে ডাকে। অনেকে আবার আদর করে উনাকে নানী বুড়ি বলে ডাকেন। আমাদের এই অঞ্চলে সবাই নানী বুড়ি বললে জহিরন বেওয়াকে এক নামে চিনে, এমনকি আমাদের এমপিরে কেউ চিনুক না চিনুক কিন্তু এই নানী বুড়িকে আশেপাশের সব লোক এক নামে চিনে।

তারা আরো জানান, নানীকে ভালোবেসে অনেকে পরামর্শ দেয়-নানী তোমার বয়স হইছে, এখন সাইকেল চালানো বাদ দাও, বাড়ি বাড়ি যাওয়া বাদ দাও, রাস্তা ঘাটে কখন কি ঘটে যায় কে জানে। তবে শুনেছি, নানী এসব বাদ দিতে পারেন না, উনার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। সকাল হলেই উনি ক’টা ভাত মুখে তুলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যান। তারপর, আশেপাশের গ্রামের সবার খোঁজ খবর নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন। নানী যদি কখনো নিজে অসুস্থ থাকেন, উনার খোঁজ খবর নিতে উনার নিজের বাড়িতে লোকজনের ঢল নামে।

ভেলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, জহিরন বেওয়া নিজেকে সবসময় হাসি-খুশি রাখেন আর গ্রামবাসীকেও আনন্দ দিয়ে হাসি-খুশি রাখেন। তাই জহিরন বেওয়া গ্রামের সবার কাছে জনপ্রিয়, হয়ে উঠেছেন সবার নানী, লালমনিরহাট তথা বাংলার নানী। আমরা তাকে বাংলা নানী বলে সম্বোধন করি আর এতে তিনি বেশ খুশি থাকেন।

জহিরন বেওয়ার নাতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি বার বার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দাদিকে সাইকেল চালিয়ে বাইরে যেতে না দিতে কিন্তু পারছেন না। দাদি কষ্ট করে তার ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন তেমনি আমাদের মানুষ করার ক্ষেত্রেও তার অবদান রয়েছে।

আমরা হয়তো বইয়ে পড়েছি বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা- কিন্তু এমন অন্তরালে লুকিয়ে থাকা নানীদের অবদান তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কেউ তার কাজের ব্যপ্তি নিয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছেন, কেউবা নানীর মত ছোট্ট পরিসরের আলোকিত সেবক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

৯২ বছর বয়সেও সাইকেল চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন বৃদ্ধা

আপডেট টাইম : ০৬:২২:১৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। শ্রম, মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। এরই মধ্যে দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জি কর্মকাণ্ডে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে তারা। এই ধারাবাহিকতা এখন শুধু শহরে নয় উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামেও যুক্ত আছেন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও মানব সেবায়। নানা রকম যুদ্ধ পাড়ি দিয়ে একমাত্র নিজের সাহসিকতায় অনেক নারীর সফলতার গল্প আমরা শুনেছি। তবে আজ জানাবো অন্যরকম এক গল্প।

গ্রামের সবাই যাকে চিনেন নানী নামে। তিনি হলেন জহিরন বেওয়া। বয়স ৯২ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু মনের উদ্যমতা, সাহসিকতা, কর্মের দক্ষতা-সখ্যতা কমেনি তার। স্থায়ীয় এমপিও কারো কাছে অপরিচিত হলেও গ্রামের সবার কাছে নানী জহিরন বেওয়া এক পরিচিত নাম।

৯২ বছর (তার দাবি) বয়সী জহিরন বেওয়া লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউপির সীমান্তবর্তী গ্রাম তালুক দুলালীর মৃত সায়েদ আলীর স্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর আগে স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়া এ সংগ্রামী নারী তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার সংগ্রাম শুরু করেন। আট বছর আগে বড় ছেলে দানেশ আলী ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করায় ভেঙ্গে পড়েন জহিরন বেওয়া। ছোট ছেলে তোরাব আলীর (৫৯) সংসারে এই সংগ্রামী নারী এখনো সচল, সজাগ আর কর্ম উদ্যামী হয়ে বেঁচে আছেন।

দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সংসারে অভাব-অনাটন ছিল প্রতিক্ষণের চিন্তা। সমাজের কথা উপেক্ষা করে ১৯৬৮ সালে জহিরন পরিবার পরিবল্পনার অধিন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষযে চয়মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহন করে চুক্তিভিত্তিক মাসিক মজুরিতে কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মে যোগ দেন। নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতেন। ২শ’ থেকে ৩শ’ অবশেষে ৫শ’ টাকা মাসিক মজুরিতে ১০ বছর চাকরি করে অবসরে যান জহিরন। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি।

জহিরন বেওয়া সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি শুধু সাধারণ রোগ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, বমি শারীরিক দুর্বলতাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। চিকিৎসার জন্য আমাকে কোনো অর্থ দিতে হয় না, তবে আমি বাজারমূল্যে তাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টাকা আয় হয়।

তিনি আরো বলেন, আদিতমারী উপজেলার ৩০টি গ্রামে প্রায় দুই হাজারের বেশি পরিবারের সঙ্গে রয়েছে আমার যোগাযোগ। আমি প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে কমপক্ষে সাতটি গ্রামের ৭০টি বাড়িতে যাই এবং তাদের খোঁজখবর নিই। এমনটি দাবি করে জহিরন বেওয়া জানান, গত ৫০ বছরে তিনি কোনো রোগে আক্রান্ত হননি।

আদিতমারীর গ্রামবাসীরা জানান, গত ৪৫ থেকে ৫০ বছর ধরে জহিরন বেওয়াকে দেখছি তিনি সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ কোনো অসুখ-বিসুখ হলে আমরা তার কাছেই চিকিৎসা নিই। আর তিনি কখনোই আমাদের কাছে টাকা নেননি। মাঝে মধ্যে ওষুধও বিনামূল্যে দেন।

তারা জানান, উনি এখন গ্রামের সবার জাতীয় নানী। সবাই তাকে নানী বলেই ডাকে, হয়তো ছেলে দেখলে তাকে নানী বলে ডাক দেয়, ছেলের বাবাও দেখলে নানী বলে ডাকে। অনেকে আবার আদর করে উনাকে নানী বুড়ি বলে ডাকেন। আমাদের এই অঞ্চলে সবাই নানী বুড়ি বললে জহিরন বেওয়াকে এক নামে চিনে, এমনকি আমাদের এমপিরে কেউ চিনুক না চিনুক কিন্তু এই নানী বুড়িকে আশেপাশের সব লোক এক নামে চিনে।

তারা আরো জানান, নানীকে ভালোবেসে অনেকে পরামর্শ দেয়-নানী তোমার বয়স হইছে, এখন সাইকেল চালানো বাদ দাও, বাড়ি বাড়ি যাওয়া বাদ দাও, রাস্তা ঘাটে কখন কি ঘটে যায় কে জানে। তবে শুনেছি, নানী এসব বাদ দিতে পারেন না, উনার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। সকাল হলেই উনি ক’টা ভাত মুখে তুলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যান। তারপর, আশেপাশের গ্রামের সবার খোঁজ খবর নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন। নানী যদি কখনো নিজে অসুস্থ থাকেন, উনার খোঁজ খবর নিতে উনার নিজের বাড়িতে লোকজনের ঢল নামে।

ভেলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, জহিরন বেওয়া নিজেকে সবসময় হাসি-খুশি রাখেন আর গ্রামবাসীকেও আনন্দ দিয়ে হাসি-খুশি রাখেন। তাই জহিরন বেওয়া গ্রামের সবার কাছে জনপ্রিয়, হয়ে উঠেছেন সবার নানী, লালমনিরহাট তথা বাংলার নানী। আমরা তাকে বাংলা নানী বলে সম্বোধন করি আর এতে তিনি বেশ খুশি থাকেন।

জহিরন বেওয়ার নাতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি বার বার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দাদিকে সাইকেল চালিয়ে বাইরে যেতে না দিতে কিন্তু পারছেন না। দাদি কষ্ট করে তার ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন তেমনি আমাদের মানুষ করার ক্ষেত্রেও তার অবদান রয়েছে।

আমরা হয়তো বইয়ে পড়েছি বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা- কিন্তু এমন অন্তরালে লুকিয়ে থাকা নানীদের অবদান তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কেউ তার কাজের ব্যপ্তি নিয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছেন, কেউবা নানীর মত ছোট্ট পরিসরের আলোকিত সেবক।