হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভোটে জেতাই শেষ কথা নয়। নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে বিজেতাকে ভোটাররা কী চোখে দেখছেন, সেটাও ভাবতে হয়। এমনটাই মনে করেন ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। মনে করিয়ে দিলেন, সব রাজনৈতিক দল ভারতে চিরকাল যে সমান সুযোগ পেয়ে এসেছে, সেই সুনাম নষ্ট হয়েছে। সমতার সেই নীতি ধরে রাখতে হবে। বৈষম্য সরাতে হবে, বিশেষত যেখানে শাসকদলই সব সুবিধে পাচ্ছে, বাকিরা নয়। শাসকদলই যেখানে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রধানদের মনোনীত করে, নির্বাচন কমিশনের গঠনেও যেখানে শাসকেরই বড় ভূমিকা, সেখানে সমতা রক্ষা করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত এই অধ্যাপকের খেদ, ভারত নানা দিক দিয়ে এক সফল গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছিল, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমান নজরে দেখা হত। কিন্তু ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন সেই সুখ্যাতি নষ্ট করেছে। যুক্তিগ্রাহ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে, যে শাসকদল নানা বিশেষ সুযোগ–সুবিধে পেয়েছে। অবশ্য কেবল নির্বাচন কমিশনকেই দায়ী করেননি অমর্ত্য। বলেছেন, সরকারি দূরদর্শনও একইভাবে পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছে। ভোটের আগে বিজেপি–কে যতটা সময় টিভির পর্দায় থাকতে দেওয়া হয়েছে, কংগ্রেস তার অর্ধেক সময়ও পায়নি।
নির্বাচনী খরচ জোগাড়ের ক্ষেত্রেও শাসকদল এবং বিরোধীদের মধ্যে যে ব্যাপক বৈষম্য এবার দেখা গেছে, অমর্ত্য তার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, বিরোধীদের হাতে যে বিত্ত, যে সামর্থ্য ছিল, তার থেকে, এমনকী কংগ্রেসের থেকেও এবার বেশি আর্থিক ক্ষমতা ছিল বিজেপির। ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের যে ক্ষমতা, সরাসরি তার কথা না বললেও নির্বাচনী পুঁজি জোগাড় এবং খরচের ওপর নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রণের অত্যন্ত প্রয়োজন আছে বলে মত দিয়েছেন অমর্ত্য। বলেছেন, নির্বাচনী সাফল্যকে ঘরে এবং বাইরে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই এই নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ভারতে এবারের ভোটে বিজেপি, তথা নরেন্দ্র মোদির সাফল্যকে সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম যে বাঁকা চোখে দেখেছে, অমর্ত্য তার উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস্’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’, ইংল্যান্ডের ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘অবজার্ভার’, ফ্রান্সের ‘ল্য মন্ডে’, জার্মানির ‘ডি ৎসাইট’, ‘হারেৎস’–এর মতো বিখ্যাত সব কাগজ, অন্যদিকে সিএনএন, বিবিসি, সবাই একবাক্যে সমালোচনা করেছে মোদির নির্বাচনী কৌশলের। যে কায়দায় বিজেপির এই বিরাট জয় এল এবং যেভাবে বিভিন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতায় প্ররোচনা জুগিয়েছে মোদির দল, তার তীব্র নিন্দা করেছে এইসব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
নিজের লেখায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। ব্রিটিশদের অনুসরণে ভারতে যে নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে, তাতে যে দল সবথেকে বেশি ভোট পেয়েছে, তারাই নির্বাচিত হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট তারাই পেয়েছে। এবারের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থীরা বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে জয়ী হলেও তারা ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩৭%। অর্থাৎ দেশের ৬৩% ভোট বিজেপি পায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নেই তাদের পক্ষে। অমর্ত্য সেন প্রশ্ন করেছেন, বিরোধী দলগুলো কি এটা নিয়ে ভাবছে? তাদের কি মনে হচ্ছে না, নির্বাচনের আগে নিজেদের মধ্যে আরও বেশি ঐক্য দরকার ছিল? বিজেপি–বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে জোট করতে কংগ্রেসের কি আরও বেশি সুসংহত উদ্যোগ জরুরি ছিল না?
যেমন উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বা বহুজন সমাজ পার্টির সঙ্গে? দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সঙ্গে? মহারাষ্ট্রে প্রকাশ আম্বেদকরের পার্টির সঙ্গে? বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল জোট গড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের কি উচিত ছিল না আরও এক পা এগিয়ে কানহাইয়া কুমারের মতো জাতীয় স্তরে স্বীকৃত একজন নবীন নেতাকে জায়গা করে দেওয়া?