অর্থসম্পদ ব্যয়ে মোমিনের লক্ষ্য

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে-কোনো সম্পদ সে ব্যয় করবে, যে কাজেই তা ব্যয় করবে, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হবে কি না, এ বিষয়টি তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না কিছুতেই। অর্থাৎ জীবনের বৈধ যত প্রয়োজন, সর্বক্ষেত্রেই তো আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির আশা করতে পারি। খাবারদাবার, কাপড়চোপড়, বাসাবাড়ি, প্রয়োজনীয় অলংকরণ, গৃহস্থালির আসবাবপত্র এসবের কোন বিষয়টি এমন, যেখানে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার সুযোগ নেই?

আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যে মোমিন হয়, নিজেকে তাঁর কাছে পূর্ণরূপে সঁপে দিয়ে যে মুসলিম হয়, সে তো তাঁর সন্তুষ্টির বাইরে গিয়ে কোনো কাজই করতে পারে না। এ জীবনে যত কিছু সে করবে, সবকিছুতেই সে সন্ধান করে বেড়ায় পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টি। ঘরে-বাইরে ঘুমে-জাগরণে সদা-সর্বত্র তার একটাই লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কী করে হাসিল করা যায়। ভোরে ঘুম থেকে জেগে অজু করে নামাজে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে যেমন সে আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, তেমনি দুনিয়ার জীবনে টিকে থাকার জন্য যখন সে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করে, আবার নিজের, স্ত্রী-সন্তানের এবং অন্য আরও অনেকের ভরণপোষণের জন্য যখন ওই অর্থ সে ব্যয় করে, তখনও সে খুঁজে ফেরে দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটাই মোমিনের পরিচয়, মোমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা এ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে ‘যে সম্পদই তোমরা খরচ কর, তা তোমাদের নিজেদের কল্যাণেই (অর্থাৎ তোমরা নিজেরাই এর সওয়াব ও পুরস্কার ভোগ করবে)। আর তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষণ না করে কিছুই ব্যয় কর না। যা কিছুই তোমরা ব্যয় কর, তোমাদের এর প্রতিফল পূর্ণরূপেই দেওয়া হবে এবং তোমাদের জুলুম করা হবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭২)।

এখানে দ্বিতীয় বাক্যটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষণ করেই তোমাদের সম্পদ ব্যয় করে থাক। সম্পদ ব্যয়ের এক্ষেত্রে কোনো শর্ত নেই, তা দ্বীন প্রচারের কাজে হতে হবে কিংবা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য হতে হবে ইত্যাদি। উন্মুক্তভাবে এখানে বলা হয়েছে মোমিনের সম্পদ ব্যয়ের কথা। তবে যে-কোনো সম্পদ সে ব্যয় করবে, যে কাজেই তা ব্যয় করবে, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হবে কি না, এ বিষয়টি তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না কিছুতেই। অর্থাৎ জীবনের বৈধ যত প্রয়োজন, সর্বক্ষেত্রেই তো আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির আশা করতে পারি। খাবারদাবার, কাপড়চোপড়, বাসাবাড়ি, প্রয়োজনীয় অলংকরণ, গৃহস্থালির আসবাবপত্র এসবের কোন বিষয়টি এমন, যেখানে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার সুযোগ নেই? উপরোক্ত আয়াতটিতেও এ কথাই বলা হয়েছে মোমিন যা কিছুই ব্যয় করবে, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি তাতে হাসিল হলো কি না, তা দেখে ব্যয় করবে। এ সন্তুষ্টি যদি কোনো ক্ষেত্রে অর্জিত না হয়, তাহলে সেখানে সে যেন একটি পয়সাও ব্যয় না করে। মোমিন সম্পদ ব্যয় করলে এ নিয়তেই করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই খরচ কর না কেন, তার প্রতিদান তুমি পাবেই, এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে খাবারের যে নলাটি তুলে দাও, তোমাকে এজন্যও পুরস্কৃত করা হবে। (বোখারি : ৫৬)।

একজন পুরুষ আল্লাহর নামে একজন পর-নারীকে যেভাবে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নেয়, এরপর তার ভরণপোষণের দায়িত্ব আল্লাহ স্বামীর কাঁধে অর্পণ করেন, সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বামী যখন অর্থ উপার্জন করে এবং উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে, তখন এটা তো শুধু দুনিয়া নয়, নিজের চাহিদা পূরণ করা নয়, এটা দ্বীনেরই অংশ। এ উপার্জন ও ব্যয় সবটাই আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। তবে কথা একটাই সবকিছুই হতে হবে আল্লাহর বিধান মেনে। তাঁর বিধান যদি লঙ্ঘিত হয়, হালাল-হারামের ভেদাভেদ যদি উঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা আনুগত্যই হবে কী করে, আর এতে তাঁর সন্তুষ্টিই হাসিল হবে কীভাবে!

আল্লাহর পথে, আল্লাহর বিধান মেনে মোমিন যখন নিজের অর্থসম্পদ ব্যয় করে, তখন তার আরও একটি উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে পাক কোরআনে। তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য বিধিবিধানের ক্ষেত্রেও যেন অবিচলতা অর্জন করা যায়, আনুগত্যের প্রতিটি পদক্ষেপে যেন অটল থাকা যায়। নিজের ঈমান ও আমল টিকিয়ে রাখার জন্য এ অর্জনও অসামান্য, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের উপস্থাপন এমন অর্থাৎ যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় এবং নিজেদের (দ্বীনের পথে) সুসংহত করার লক্ষ্যে। (সূরা বাকারা : ২৬৪)।
এ দুনিয়ার একটি স্বাভাবিক রীতি যে-কোনো ক্ষেত্রে কেউ যখন নিজের শারীরিক শ্রম ব্যয় করে, কিংবা রক্ত-ঘামে উপার্জিত অর্থ বিলিয়ে দেয়, তখন ওখানে সে একপ্রকার আপনত্ব অনুভব করে, নিজেকে সেখানে সে প্রাসঙ্গিক মনে করে এবং সেখানকার যাবতীয় বিধিনিষেধও সহজে সে মেনে নিতে পারে। একটু কষ্ট বরণ করে নেওয়ার পর আরও অনেক কষ্ট ভোগ করতে সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। আল্লাহর বিধানকে সামনে রেখে, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের মহান লক্ষ্যে কেউ যখন নিজের সম্পদ ব্যয় করবে, তখন দ্বীনের অন্যান্য শাখা এবং বিধানও তার জন্য সহজ হয়ে যায়। সে অর্জন করতে পারে দ্বীনের ওপর অবিচলতা।

কেউ কেউ অবশ্য উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় এবং নিজেদের আন্তরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মোমিন যখন তার সম্পদ ব্যয় করবে, তখন সে যেমন পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টির আশায় থাকবে, তেমনি তার হৃদয়-মনে থাকবে আল্লাহ তায়ালার ঘোষিত পুরস্কারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। ঈমান তো বিশ্বাসেরই নাম। পরকালে পরিপূর্ণরূপে প্রতিদান পেতে চাইলে আন্তরিক এ বিশ্বাসটুকুও অপরিহার্য।

এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় এবং নিজেদের দ্বীনের পথে অবিচল করে তোলার লক্ষ্যে যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে দয়াময় প্রভুর নির্দেশিত পথে, পবিত্র কোরআনে তাদের একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছে। কোরআনের ভাষায় যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় এবং (দ্বীনের পথে) নিজেদের সুসংহত করার লক্ষ্যে, তাদের দৃষ্টান্ত হলো যেন সমতল উঁচু ভূমিতে অবস্থিত একটি বাগান, এতে ভারি বৃষ্টিপাত হয়। ফলে তা দ্বিগুণ ফল দেয়। আর ভারি বৃষ্টি যদি না-ও হয় তবে হালকা বৃষ্টিই তার ফল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে। আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা বাকারা : ২৬৫)।

বাগানটি যেহেতু উঁচু টিলায় এক সমতল ভূমিতে অবস্থিত, তাই বৃষ্টি হলেই পানি সেখানে প্রথমে পড়ে এবং সমতল হওয়ার কারণে সব পানি সেখান থেকে গড়িয়ে পড়েও যায় না। বাগানের গাছগুলো ফলবান হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পানি সেখানে থেকে যায়। ফলে অন্যান্য গাছের তুলনায় ওই বাগানের গাছগুলোতে দ্বিগুণ ফল পাওয়া যায়। আর যদি কখনও ভারি বৃষ্টিপাত না হয়, তখন হালকা বৃষ্টিতেও ওই বাগানের গাছে ফল আসে। মোমিনের দানও এমনই। সে যখন তার সম্পদ ব্যয় করবে, কোথাও দান করবে, তখন ইখলাস ও নিষ্ঠা তো থাকতেই হবে। ইখলাসের পরিমাণ যত বেশি হবে তার প্রতিদানও তত বেশি হবে। ইখলাসের পূর্ণতা নিয়ে অল্প দান করেও পুণ্যে ও প্রতিদানে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারে কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদের দানকে। আর মোমিনের দানসদকায় ইখলাস যেহেতু থাকবেই; তাই তা প্রতিদানও বয়ে আনবেই। শূন্য হাতে ফিরে আসার আশঙ্কা তার নেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর